নিখুঁততম মানুষ
প্রকাশিত : ০৮:১২, ১ মে ২০২০
প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরী এ দেশে প্রায় সবার কাছে ‘জেআরসি’ স্যার নামে পরিচিত। রাষ্ট্র তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে সম্মান দিয়েছে, তবে তিনি তাঁর অনেক আগে থেকেই এ দেশের প্রায় সবার ‘স্যার’। একজন মানুষ কী পরিমাণ সত্যিকারের কাজ করতে পারে, তা প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরীকে নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস হতে চায় না। আজ (মঙ্গলবার) ভোরে ঘুম থেকে উঠেই খবর পেয়েছি তিনি আর নেই। খবরটা পাওয়ার পর থেকেই এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করছি। তাঁর কথা নয়, আমাদের নিজেদের কথা মনে হচ্ছে। স্বার্থপরের মতো মনে হচ্ছে, এখন আমাদের কী হবে? কে আমাদের দেখেশুনে রাখবে? কে আমাদের বিশাল মহিরুহের মতো ছায়া দিয়ে যাবে? বিপদে-আপদে কে আমাদের বুক আগলে রক্ষা করবে? আমাদের স্বপ্নগুলো সত্যি করে দেওয়ার জন্য এখন আমরা কার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকব?
আমি জানি তাঁর শূন্যস্থান পূরণ করার মতো কেউ নেই। অনেকেই আছেন যারা একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে দক্ষ, কিন্তু জীবনের ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের সবগুলোতে সমানভাবে দক্ষ এবং তাদের সবগুলোর মাঝে এক ধরনের বিস্ময়কর সমন্বয় আছে এ রকম মানুষ আমি খুব বেশি দেখিনি। তাঁর প্রায় অলৌকিক মেধার সঙ্গে যোগ হয়েছিল সত্যিকারের বাস্তব অভিজ্ঞতা। সবচেয়ে বড় কথা তিনি ছিলেন শতভাগ খাঁটি মানুষ, সব মিলিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন এ দেশের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য, সবচেয়ে নির্ভরশীল একজন মানুষ। কর্মজীবনে প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরী ছিলেন একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। এ দেশের সব বড় বড় ভৌত-অবকাঠামোর সঙ্গে তিনি কোনো না কোনোভাবে যুক্ত ছিলেন। তার পাশাপাশি এ দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিকাশের যে উদ্যোগ সেখানেও তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আমাদের দেশের গণিত অলিম্পিয়াডের যে আন্দোলন সেখানেও তিনি আমাদের সামনে ছিলেন। এ দেশের সবাই জানে, যে কোনোভাবে তাঁকে যদি কোনো একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব দিয়ে দেওয়া যেত, তারপর আর সেটি নিয়ে কারও মাথা ঘামাতে হতো না।
প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারের সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৯৮ সালের দিকে যখন তিনি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তনে সমাবর্তন বক্তা হিসেবে এসেছিলেন। এটি বিস্ময়কর যে, ঘটনাক্রমে তাঁর সঙ্গে আমার শেষ কথাটিও হয়েছে সেই সমাবর্তনের বক্তব্যটি নিয়ে। অল্প কিছুদিন আগে আমাকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আমি কোনোভাবে তাঁর সেই বক্তব্যটির একটি কপি সংগ্রহ করে দিতে পারব কিনা, তিনি তাঁর নিজের কাছে সেটি খুঁজে পাচ্ছেন না। কাগজপত্র সংরক্ষণের ব্যাপারে আমার থেকে খারাপ কেউ হতে পারে না, কিন্তু আমার কোনো কোনো সহকর্মী সে ব্যাপারে অসম্ভব ভালো। সে রকম একজন আমাকে প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরীর সমাবর্তন বক্তব্যটি বের করে দিয়েছিলেন, আমি সেটাই তাঁকে পাঠিয়েছিলাম। প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরী সেটা পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে একটা ইমেইল পাঠিয়েছিলেন, সেটাই তাঁর সঙ্গে আমার শেষ যোগাযোগ। তিনি আমাদের সঙ্গে আর নেই খবরটি পাওয়ার পর সুদীর্ঘ ২২ বছর পর আমি তাঁর সমাবর্তন বক্তব্যটি আবার পড়েছি। আমি এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করেছি প্রায় দুই যুগ আগে তিনি কত নিখুঁতভাবে আমাদের দেশের সমস্যা এবং সম্ভাবনাগুলো চিহ্নিত করেছিলেন। সমস্যা চিহ্নিত করে তিনি সেগুলো নিয়ে অভিযোগ করে তার দায়িত্ব শেষ করে দেননি, তিনি তার সম্ভাব্য সমাধানগুলোর পথ দেখিয়ে ছাত্রছাত্রীদের অনুপ্রাণিত করেছিলেন। তথ্যপ্রযুক্তির নানা বিষয়ে তিনি ছিলেন স্বপ্নদ্রষ্টা। ‘কম্পিউটার সফটওয়্যার এবং তথ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ সেবা রপ্তানির সম্ভাবনা এবং সমস্যা’ চিহ্নিত করার জন্য একটি কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে তিনি যে রিপোর্ট দিয়েছিলেন সেটি ব্যবহার করে আমাদের দেশের তথ্যপ্রযুক্তির ভিত্তি গড়ে উঠেছিল। সমাবর্তন বক্তব্যে তিনি আমাদের ছাত্রছাত্রীদের সে বিষয়গুলো নিয়ে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। (ঘটনাক্রমে এর ঠিক ২০ বছর পর জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারের অনুরোধে আমি তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে সমাবর্তন বক্তার বক্তব্য দিয়েছিলাম। তাঁর বক্তব্যের তুলনায় আমার বক্তব্য ছিল সারবস্তুহীন প্রায় ছেলেমানুষি বক্তব্য)! আমি ভিন্ন শহরের ভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলাম, কিন্তু নানা ধরনের কাজের কারণে তাঁকে আমি যথেষ্ট কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। তাঁর সঙ্গে কথা বললেই বোঝা যেত এই সহজ-সরল অনাড়ম্বর মানুষটি কত তীক্ষè বুদ্ধিমত্তার মানুষ। শুধু যে তীক্ষè বুদ্ধিমত্তা তা নয়, তিনি ছিলেন অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী। প্রফেসর মোহাম্মদ কায়কোবাদের একটি বইয়ের নাম ‘গণিতের সমস্যা ও বিজ্ঞানীদের নিয়ে গল্প’, সেই বইয়ে তিনি পৃথিবীর অনেক বড় বড় বিজ্ঞানী এবং গণিতবিদের সঙ্গে প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরীর নাম উল্লেখ করে তাঁর অসাধারণ স্মৃতিশক্তির কিছু উদাহরণ দিয়েছেন। সেগুলো অবিশ্বাস্য। যেমন : তিনি ঢাকা কলেজে তাঁর ১২০ জন সহপাঠীর নাম এবং রোল নম্বর ৫০ কিংবা ৬০ বছর পরও হুবহু বলে দিতে পারতেন। একবার জাপান সরকারের উদ্যোগে ব্যাংককের একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরীর সঙ্গে আমার যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। তখন বেশ কয়েকটি দিন তাঁকে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। নানা বিদেশির ভিতর শুধু আমরা দুজন বাংলাদেশের, তাই বেশ কয়েকটি দিন আমি তাঁর সঙ্গে খুব অন্তরঙ্গভাবে কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলাম। তখন অসাধারণ প্রতিভাবান একজন অত্যন্ত সফল মানুষের ভিতরকার সহজ-সরল মানুষটির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। সেই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরীর উপস্থাপনার কারণে, বলা যায় তিনি একাই পুরো সম্মেলনটি নেতৃত্ব দিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। এ রকম একজন মানুষকে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে নেতৃত্ব দিতে দেখলে যে কোনো মানুষের বাংলাদেশ সম্পর্কে ধারণা পাল্টে যেতে বাধ্য। তিনি প্রায় অলৌকিক একটা মস্তিষ্কের অধিকারী ছিলেন এবং তিনি নিজে সেটাকে শানিত রাখতেন, কখনোই এই মহামূল্যবান জিনিসটির অপব্যবহার করেননি। অন্য কিছু করার না থাকলে তিনি আপনমনে সুডোকোর জটিল ধাঁধা সমাধান করে যেতেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলা কিংবা তাঁর কথা শোনা একটা আনন্দময় অভিজ্ঞতা, পৃথিবীর এমন কোনো চমকপ্রদ তথ্য নেই যেটি তিনি জানতেন না। একজন মানুষ কেমন করে এত কিছু জানতে পারে তা তাঁকে নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস হতে চায় না।
আমার জন্য তাঁর সম্ভবত এক ধরনের দুর্ভাবনা ছিল। সিলেটের বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করতে গিয়ে যখন মাঝে মাঝেই নানা ধরনের বিপদের মুখোমুখি হতে শুরু করেছি তখন একবার তিনি আমাকে ফোন করে আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, আমি ঢাকা চলে আসতে চাই কিনা। তত দিনে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের জন্য এক ধরনের মায়া জন্মে গেছে, তাই আমি আর সিলেট ছেড়ে যাইনি। আমার মতো এ রকম আরও কত মানুষকে তিনি না জানি কত বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন।
মনে আছে একবার তিনি আমাকে ফোন করে আমার বাসার ঠিকানা জানতে চাইলেন, আমি কারণ জিজ্ঞাসা করলাম, স্যার বললেন, তিনি তাঁর মেয়ের বিয়ের কার্ড দিতে আসবেন। ঢাকা শহরে শুধু বিয়ের কার্ড দেওয়ার জন্য একজনের বাসায় যাওয়ার মতো দুঃসাধ্য কাজ আর কী হতে পারে। আমি স্যারকে বললাম, কার্ড দিতে হবে না, আমাকে শুধু বিয়ের দিনক্ষণটি জানিয়ে দিন আমি হাজির হয়ে যাব। কিংবা খামের ওপর ঠিকানা লিখে কুরিয়ার করে দিন, আমি পেয়ে যাব! স্যার রাজি হলেন না, তিনি আমাদের বাঙালি ঐতিহ্য মেনে নিজের হাতে মেয়ের বিয়ের কার্ডটি পৌঁছে দেবেন। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের এই অতি গুরুত্বপূর্ণ মানুষটি নিজে আমার বাসায় এসে তাঁর মেয়ের বিয়ের কার্ডটি আমার হাতে তুলে দিয়ে গেলেন। (জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারের এই মেধাবী মেয়েটি এমআইটিতে তার বাসায় দাওয়াত করে আমাদের পুরো পরিবারকে রান্না করে খাইয়েছিল। করোনাভাইরাসের কারণে পুরো পৃথিবী আটকা পড়ে আছে, মেয়েটি এখন নিশ্চয়ই কত মন খারাপ করে কোনো দূর দেশে বসে আছে। ছেলেটিও এখানে নেই, শুধু স্যারের স্ত্রী আছেন। তাঁর জন্য খুব মন খারাপ হচ্ছে, কারণ তিনি শুধু স্যারের স্ত্রী নন, বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনের আমাদের সবার এমি আপা)।
আমি জানি না, জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারের মাথায় মৃত্যুচিন্তা এসেছিল কিনা। আন্তর্জাতিক আন্তবিশ্ববিদ্যালয় প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতাটি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ২০২১ সালে বাংলাদেশে হবে। এ আয়োজন করার মূল কাজটি তিনি করেছিলেন। তাঁর একজন আপনজন যখন একবার তাঁকে এ প্রতিযোগিতাটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিল তখন তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, জানি না, তখন আমি বেঁচে থাকব কিনা।
তিনি কি অনুমান করেছিলেন যে আর বেশিদিন থাকবেন না? এই নিখুঁততম মানুষটি ছাড়া আমরা কেমন করে এ দেশের তরুণদের নিয়ে, কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে আনন্দ-উচ্ছ্বাস করব?
লেখক : শিক্ষাবিদ।
এসএ/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।