নির্বাচনি ইশতেহারে প্রত্যাশা
প্রকাশিত : ১৮:৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩
দেশে রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, ফ্লাইওভার ইত্যাদি নির্মাণের ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। এখন এগুলোর সংরক্ষণ ও মেরামতের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। গ্রাম-গঞ্জের মানুষও আজ রাস্তাঘাট তেমন চায় না। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও লেগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া। এখন তাদের প্রধান দাবি, ছেলেমেয়েদের চাকরির ব্যবস্থা করা। একই সঙ্গে দেশের হাট-বাজার, ব্যবসাকেন্দ্র ইত্যাদির উন্নতি সাধন করতে হবে। জেলা-উপজেলায় সরকারি-বেসরকারিভাবে গুদামঘর ও কোল্ড স্টোরেজ গড়ে তুলতে হবে। যাতে পেঁয়াজসহ বিভিন্ন ফসল নষ্ট বা অপচয় না হয় এবং আমরা পরনির্ভরতা থেকে বের হয়ে আসতে পারি। প্রয়োজনে এ ব্যাপারে মেগা প্রজেক্ট গ্রহণ করতে হবে
পৃথিবীতে যখন মন্দা পরিস্থিতি বিরাজমান, তখনো বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমশ মানবিক উন্নয়নের গতিধারায় সম্পৃক্ত। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ৭ জানুয়ারি, ২০২৪ তারিখে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনকে উপলক্ষ্য করে নির্বাচনি ইশতেহার ঘোষণা করতে যাচ্ছে। এতে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার বিষয়টি প্রাধান্য পাচ্ছে। স্মার্ট (Smart) শব্দের বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এতে নির্দিষ্ট, পরিমাপযোগ্য, অর্জনযোগ্য, প্রাসঙ্গিক ও সময়সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট রূপরেখা থাকতে হবে।
স্মার্ট বাংলাদেশের প্রধান ভিত্তিভূমি হবে তরুণ যুবসমাজ। এই তরুণেরা যাতে চাকরি পায় কিংবা স্বকর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে, ইশতিহারে তার দিকনির্দেশনা থাকতে হবে। আমরা মনে করি, ইশতেহারে বেকার ভাতার কথাও উল্লেখ করতে হবে। এই মুহূর্তে যুবসমাজের সংখ্যা হচ্ছে প্রায় সোয়া ৫ কোটি। এই বিপুলসংখ্যক তরুণকে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় শিক্ষিত করার ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের মান উন্নত করতে হবে। আমরা ঘরে ঘরে যখন চাকরির ব্যবস্থা করতে পারলাম না, তখন তরুণদের উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য উত্সাহিত করলাম। কিন্তু সফল উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ কতটা উন্নত করতে পারলাম, তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
একটি দেশের ৪৩ শতাংশ নাগরিককে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। আমাদের দেশে এই সংখ্যা হচ্ছে মাত্র ১৬ শতাংশ। অবশ্য এটি বাড়াতে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। স্কিল ফর এমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (SEIP)-এর আওতায় অতিরিক্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রয়াস অব্যাহত রাখতে হবে। উদ্যোক্তার কর্মসংস্থানের জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিতে ঢাকা স্কুল অব ইকোনোমিকস থেকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট এন্টারপ্রাইজ ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামটি নির্বাচনের পর অন্তর্ভুক্তকরণ এবং সিপ্টের আওতায় একটি ইকোনমিক ইনকিউরেটর ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকসে অন্তর্ভুক্তকরণের ব্যবস্থা করতে হবে। আগামী দিনের যুবসমাজের জন্য কর্মসংস্থান গুরুত্বপূর্ণ। প্রবৃদ্ধির সঙ্গে কর্মসংস্থানের বিষয়টি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত করা গেলে আখেরে রাষ্ট্রের লাভ হবে।
দেশে রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, ফ্লাইওভার ইত্যাদি নির্মাণের ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। এখন এগুলোর সংরক্ষণ ও মেরামতের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। গ্রামগঞ্জের মানুষও আজ রাস্তাঘাট তেমন চায় না। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও লেগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া। এখন তাদের প্রধান দাবি, ছেলেমেয়েদের চাকরির ব্যবস্থা করা। একই সঙ্গে দেশের হাট-বাজার, ব্যবসাকেন্দ্র ইত্যাদির উন্নতি সাধন করতে হবে। জেলা-উপজেলায় সরকারি-বেসরকারিভাবে গুদামঘর ও কোল্ড স্টোরেজ গড়ে তুলতে হবেম যাতে পেঁয়াজসহ বিভিন্ন ফসল নষ্ট বা অপচয় না হয় এবং আমরা পরনির্ভরতা থেকে বের হয়ে আসতে পারি। প্রয়োজনে এ ব্যাপারে মেগা প্রজেক্ট গ্রহণ করতে হবে।
আশা করা যায়, ইতিপূর্বেকার নির্বাচনি ইশতেহারে যেভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করা হয়েছিল, এবারও সেটি বহাল থাকবে। তা বাস্তবায়নে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ বিভিন্ন জাতীয় প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করতে হবে। করোনার অভিঘাত, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে বিভিন্ন অত্যাবশকীয় পণ্যের সাপ্লাই চেইন নষ্ট হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের জাতীয় অর্থনীতিও ক্ষতি হয়েছে। এখনো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর অভিঘাত থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় নির্বাচনি ইশতেহারে প্রত্যাশা করছি। দেশের অর্থনৈতিক চাকা গতিশীল থাকলে জনগণের তেমন অভিযোগ থাকবে না। তারা যেন খেয়ে-পরে ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারেন। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সব মানুষের অংশীদারিত্বের ব্যবস্থা করতে হবে। বেসরকারি চাকরি-বাকরিতে নিরাপত্তার বিধান করতে হবে। বেসরকারি খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।
দেশে মানব উন্নয়নের ক্ষেত্রে সরকার সম-অংশীদারিত্ব নিশ্চিতের ব্যবস্থা করে চলেছে। লিঙ্গ অনুসারে সমতাভিত্তিক কর্মশক্তির অংশগ্রহণ নিশ্চিতের কথাও ইশতেহারে প্রত্যাশা করছি। পাশাপাশি পুরুষেরা যাতে মিথ্য মামলায় হয়রানি না হয়, সে জন্যে পুরুষ নির্যাতন প্রতিরোধের উপায় সংবলিত পদক্ষেপের ঘোষণা নির্বাচনি ইশতেহারে থাকবে বলে আশা করছি। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ সম্প্রসারণের
উপায় ও পদক্ষেপসমূহের কথা উল্লেখ থাকতে হবে। দেশের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য সরকার যে সোশ্যাল সেফটি নেটের ব্যবস্থা করেছে, সেটি যেন অব্যাহত থাকে এবং এর ফল প্রাপ্যতা যেন সহজ হয় এবং তা যেন হয় ন্যাযতাভিত্তিক।
দেশে রপ্তনিমুখী শিল্পায়নের পাশাপাশি আমদানি বিকল্পায়ন শিল্প প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। রপ্তানিমুখী শিল্প পোশাক খাত ছাড়াও ওষুধ, অপ্রচলিত পণ্য ও হালকা শিল্প প্রতিষ্ঠার দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। রপ্তানি আয় যাতে দেশে সঠিকভাবে আসে, সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে এবং কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। পণ্য বহুধাবিভক্তকরণের জন্য সমন্বিত কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
দেশের ব্যাংকিং খাতে যেসব সমস্যা বিদ্যমান রয়েছে, সেগুলো দূর করার জন্য এই খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার তাগিদ দিতে হবে। বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হারের ক্ষেত্রে অবশ্যই ম্যানেজড ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেইট চালু রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে। পণ্যের দাম ইচ্ছেমতো ব্যবসায়ীরা যাতে বাড়াতে না পারেন, গড়ে তুলতে না পারেন সিন্ডিকেট, এর জন্য নির্বাচনি ইশতেহারে তার সমাধান বাতলে দিতে হবে। যেসব ব্যাংক দুর্বল, তাদের নিয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, সে জন্য পদ্ধিতগত ব্যবস্থা থাকতে হবে। ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। পুঁজিবাজার নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে। সাময়িক ভিত্তিতে কোনো পরিকল্পা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন না করে বরং সমন্বিত বর্সসূচির আওতায় পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
দেশে শ্রমনিবিড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। পুঁজিনির্ভর শিল্প কেবল সীমিত ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা থাকতে হবে। নইলে দেশের বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে রোবোটিক অটোমেশন ঘটতে পারে। তাহলে দেশের শ্রমজীবী ও মেহনতি মানুষের ক্ষতি হবে। এ জন্য প্রয়োজন হচ্ছে সুষ্ঠু পরিকল্পনা। বাংলাদেশের চাষযোগ্য ভূমি বাঁচানোর পদক্ষেপ থাকতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে এই সরকার যে বিপ্লব সাধন করেছে, তা অব্যাহত রাখতে হবে। আশা করব ইন্ডাস্ট্রি ৪.০-এর বদলে ইন্ডাস্ট্রি ৫.০ বাস্তবায়নের পদক্ষেপ থাকবে ইশতেহারে। কেননা, উন্নত বিশ্ব বর্তমানে ইন্ডাস্ট্রি ৫.০ বাস্তবায়ন করছে।
সর্বোপরি, সাধারণ মানুষ প্রত্যাশা করছে, বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান ঘুষমুক্ত হোক। দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন অধরা থাকতে পারে না। বর্তমান সরকারপ্রধান পেটে ভাতে রাজনীতির দর্শনে বিশ্বাসী। মিথ্যা অভিযোগ ও হয়রানি করে বিভিন্ন পদ্ধতিতে যারা টাকা আদায় করে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। কমিউনিটি ক্লিনিক, এম-হেলথ ও ই-হেলথ ব্যবস্থার পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন, ওষুধশিল্পের উন্নতি এবং সেবা খাতের মানোন্নয়ন দরকার। এছাড়া পর্যটনশিল্প বিকাশের ব্যবস্থা থাকতে হবে। একটি অসাম্প্রদায়িক মর্যাদাবান রাষ্ট্র গড়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই গঠনমূলক কর্মসূচি থাকবে বলে আশা করছি। আমাদের শিক্ষা হোক বাস্তবনির্ভর ও জীবন গড়ার হাতিয়ার।
লেখক :অর্থনীতিবিদ, আইটি বিশেষজ্ঞ ও সাবেক উপাচার্য, প্রেসিন্ডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
এমএম//
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।