ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২১ নভেম্বর ২০২৪

নির্বাচনে নিরপেক্ষ সরকারের ভূমিকা কতটুকু?

সাইফ উদ্দিন আহম্মেদ

প্রকাশিত : ১৭:৪৩, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | আপডেট: ১৭:৪৮, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২

বির্তক আমাদের পছন্দ। যেকোনো বিষয় নিয়েই আমরা বিতর্ক করতে পছন্দ করি। বর্তমান বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কের বিষয় হচ্ছে, সার্চ কমিটি ও নির্বাচন কমিশন গঠন। পৃথিবীর অনেক দেশেই এই ধরনের নির্বাচন কমিশন গঠনের সংবাদ গণমাধ্যমে খুব একটা গুরুত্বসহাকারে প্রকাশও হয় না। শুদ্ধ গণতন্ত্রের দাবিদার দেশ খোদ যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনে ভোট দেয়ার জন্য ভোটারকে নিজে গিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। সেখানে বাংলাদেশের মতো দেশে ভোটার নিবন্ধনের এই দায়িত্ব পালন করে রাষ্ট্র। 

বিগত মাসখানেক যাবত বলতে গেলে দেশের সকল জনগণের আলোচনা ও মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে নির্বাচন কমিশন গঠন। আলোচনার সূচনা হয়েছে বেশ কিছুদিন আগে থেকেই। মহামান্য রাষ্ট্রপতি বিগত দুইবারের মত এবারও নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে এ বিষয়ে আলোচনা শুরু করলে এই বিষয় উঠে আসে গণমাধ্যমের প্রধান শিরোনামে। মহামান্য রাষ্ট্রপতির সংলাপে অধিকাংশ দল অংশ নিলেও অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি সেই আলোচনায় সাড়া দেয়নি। অংশগ্রহণকারী একাধিক দল ও বিএনপির মূল দাবি ছিল সংবিধানের আলোকে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ নিয়ে একটি আইন করার। 

যেহেতু ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বর্তমান কমিশনের মেয়াদ, তাই একটি নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের আগে আইন করার মতো যথেষ্ট সময় আছে কিনা সে বিষয়ে প্রশ্ন উঠলে প্রস্তাবকারীরা বলেছেন, এই আইন অল্প সময়ে এমন কি রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারি করেই করা যায়। 

প্রথমে সরকারের পক্ষ থেকে যথেষ্ট সময় নেই বলা হলেও আওয়ামী লীগের সাথে রাষ্ট্রপতির সংলাপের পরই সুর পাল্টায় তারা। মন্ত্রিসভায় অনুমোদন করা হয় নির্বাচন কমিশন গঠন আইনের খসড়া। বিতর্ক ভিন্ন মাত্রা পায় সেখান থেকেই। যারা আইন করার পক্ষে ছিলেন তারাও সুর পাল্টাতে শুরু করলেন। তড়িঘড়ি আইন করার অপরাধে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে শুরু করল সরকারকে। আইনে বিগত দুটি সার্চ কমিটিকে নাকি ইনডেমনিটি দেয়া হয়েছে। সেটা নিয়েও গরম হলো বিতর্কের মঞ্চ। 

সাধারণ মনে প্রশ্ন জাগে সার্চ কমিটিতো কোনো নির্বাচন পরিচালনা করেনি, দেশও পরিচালনা করেনি, কোনো নির্বাহী কার্যক্রমও বাস্তবায়ন করেনি। তাহলে তাদের ইনডেমনিটি দেয়ার প্রশ্ন আসে কেন? নির্বাচনে কোনো অনিয়ম হয়ে থাকলে সেটা করেছে নির্বাচন কমিশিনদ্বয়। সার্চ কমিটিকে বৈধতা দিলে সেটা কিভাবে নির্বাচন কমিশনের কাজকে ইনডেমনিটি দেয়া হয় বিজ্ঞ সমালোচকরা কিন্তু পক্ষজুড়ে আলোচনা করেও সেই ব্যাখ্যা দিতে পারলেন না। যদি ধরেই নিই সেটা নির্বাচন কমিশন নিয়োগের বৈধতার কারণে তাহলে বড় প্রশ্ন আসে সার্চ কমিটি গঠন প্রক্রিয়ার আগে সরাসরি যেসব নির্বাচন কমিশন গঠন হয়েছিল সেগুলো কি ইনডেমনিটির ঊর্ধ্বে থেকে গেল? বির্তকপ্রিয় জাতি এই নিয়েও গণমাধ্যমের খোরাক দিলেন বেশ কিছুদিন।     

যাই হোক, আইনের মান, ধরণ নিয়ে নানা প্রশ্ন থাকলেও জাতীয় সংসদে পাস হলো সেই আইন। আইন অনুযায়ী গঠন করা হলো সার্চ কমিটি। কমিটির সদস্যদের নাম নিয়েও হয়ে গেল ছোটখাট বিতর্ক। সার্চ কমিটির কাছে নাম আসা শুরু হওয়ার আগেই দাবি উঠল, যে সকল নাম কমিটির কাছে আসবে সকলের নাম প্রকাশ করতে হবে। সার্চ কমিটি ৩২২ জনের নাম প্রকাশ করলে বিতর্ক আবারও দিক পরিবর্তন করল। গণমাধ্যমে নাম প্রকাশ নিয়ে যারা মন্তব্য করেছেন, তাদের প্রায় সাবাই বলেছেন কাজটা ঠিক হয়নি। এখানে অনেকের নাম এসেছে, যারা নিজেরাই জানেন না তাদের নাম সার্চ কমিটির কাছে এসেছে। এভাবে তাদের নাম সরাসরি প্রকাশ করায় তারা বিব্রত হয়েছেন। আবার এমন মতবাদও আসল যে, অনেক গুণী ব্যক্তির নাম কিছু কম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নামের সাথে থাকায় তাদের অপমান করা হয়েছে। 

এ বিষয়ে একটি হাস্যরসের গল্প মনে আসল। এক লোক তার অফিসের একজন অধস্তনকে চেয়ারে বসে থাকতে দেখে ধমক দিয়ে বলল, তুই আমার সামনে চেয়ারে বসে আছিস কেন? তৎক্ষণাৎ অধস্তন দাঁড়িয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পরে সেই বস আবার ধমক দিয়ে বলল, তুই এমন তালগাছের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? অধস্তন নিরুপায় হয়ে বলল, বসে ছিলাম বলে ধমক দিলেন। এখন দাঁড়িয়ে আছি বলে ধমক দিলেন। আমি তাহলে কি করব? লোকটি এবার আরও জোরে ধমক দিয়ে বলল, তুই ‘কি’ ও করবি না। বর্তমান বাংলাদেশের অবস্থা যেন হয়েছে সেই রকম- বিতর্ক এড়াতে হলে ‘কি’ ও করা যাবে না।

আমার বিবেচনায় সার্চ কমিটির কাছে সবচাইতে অদ্ভুত দাবিটি নিয়ে এসেছিল তারা, যাদের নামের সাথেই আছে সুশাসন। অর্থাৎ সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন। তাদের দাবি ছিল সার্চ কমিটিতে আসা নামগুলো নিয়ে গণশুনানি করতে হবে। মানুষ যেহেতু দোষগুণ মিলেই হয়। তাই গণশুনানি মানেই তার গুণের সাথে দোষগুলোও আলোচনা হবে। সাংবিধানিক একটি পদে নিয়োগের আগে একজন বিশিষ্ট মানুষকে কোনো কাজ করার আগেই যেহেতু কাঠগড়ায় তুলে ফেলবেন, তখন সে নির্বাচন কমিশনে বসে কি করে দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন? আর নাম প্রকাশ করাতেই যেখানে বিশিষ্টজনদের অপমান করা হয়েছে সেখানে এই গণশুনানির পরে লোকগুলো কি ঘর থেকে বের হতে পারতেন? সুজনের অভিপ্রায়- গণশুনানি হলে সম্ভাব্য নির্বাচন কমিশনারদের নিয়ে জনগণ নাকি তাদের মতামত ব্যক্ত করতে পারবে। তখন জনগণের মতামত বিবেচনায় নিয়ে সার্চ কমিটি নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেবেন। 

প্রশ্ন হলো- জনগণের কতজন কাকে ভালো বললেন, কতজন মন্দ বললেন, সেটা নির্নয় করবে কে? এই প্রক্রিয়া শুরু হলে হয়ত নির্বাচন কমিশন নিয়োগের জন্য এক সময় নির্বাচন করতে হতো। কারণ বেশি সংখ্যক জনগণের মতামতকেই গণতন্ত্রে গুরুত্ব দেয়া উচিৎ। সার্চ কমিটি সুজন এর দাবিকে আমলে নেয়নি। তা না হলে গণশুনানির পর কেউ হয়ত গণশুণানি করায় তার মানহানি হয়েছে মর্মে মামলাও ঠুকে দিতে পারতেন। 

এবার কিছুটা তাত্ত্বিক বিষয়ে আলোচনা করা যাক। রাজনীতিতে অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল এই প্রক্রিয়ার সাথে ঘোষণা দিয়ে যুক্ত হওয়া থেকে বিরত থেকেছে, তাদের যুক্তি পরিষ্কার- আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনই নিরপেক্ষ হয়নি এবং হবে না। তাই নির্বাচন কমিশন নিয়োগের বিষয়ে তাদের আগ্রহ নেই, আগ্রহ নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের বিষয়ে। 

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন বিষয়ে ‘নির্বাচন কমিশন’-এর ক্ষমতা অসীম। নির্বাচনের সময় সরকারের নির্বাহী বিভাগ নির্বাচন কমিশনকে পাশ কাটিয়ে বা তাদের অনুমোদন ছাড়া কিছুই করতে পারে না। নির্বাচনে যেসব সরকারি কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করেন বা করবেন তাদের বিষয়ে সকল সিদ্ধান্ত নেবেন নির্বাচন কমিশন। রিটার্নিং অফিসার তথা জেলা প্রশাসক থেকে শুরু করে কাউকেই নির্বাচন কমিশনের মতামত ছাড়া সরকার পদায়ন, বদলী কিছুই করতে পারবে না। 

তাহলে প্রশ্ন আসে, নির্বাচনকালীন সময়ে সরকার যেহেতু নির্বাচন কমিশনের অনুমোদন ছাড়া একজন পুলিশ কনস্টেবলকেও বদলী করতে পারেন না, তাহলে নিরপেক্ষ সরকার নির্বাচনে ভূমিকা কতটুকু থাকবে? ধরে নিলাম বিএনপির দাবি মেনে নিয়ে দেশে নির্বাচনকালীন সময়ে একটি নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা হলো। তখন কি সাংবিধানিক নিয়ম-কানুন বদলে যাবে? তখনও তো সকল কিছু নির্বাচন কমিশনের কথাতেই চলবে। 

বিপক্ষের যুক্তি হচ্ছে, দলীয় সরকার কমিশনের কথা না শুনে তাদের পছন্দের লোক দিয়ে নির্বাচন পরিচালনা করে থাকেন, যেখানে নির্বাচন কমিশনের পুতুলের মতো বসে থাকা ছাড়া কিছুই করার নেই। এ রকম হয়ে থাকলে সেটা তো সংবিধান লঙ্ঘন। দলীয় সরকার হয়ত তাদের স্বার্থে সংবিধান লঙ্ঘন করতে পিছ-পা হয় না। কিন্তু নিরপেক্ষ সরকারও কি সংবিধান লঙ্ঘনের পথে হাঁটবে? নিশ্চয়ই না। 

হাইপোথেটিক্যালি দেখলে, বর্তমানে আওয়ামী লীগ যদি তাদের পছন্দের লোক দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করে ফেলে আর বিএনপির কথা মতো নির্বাচনের সময় যদি নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা হয় তাহলে নির্বাচনে কার ভূমিকা বেশি থাকবে? যদি আওয়ামী লীগের পছন্দের নির্বাচন কমিশন সরকারকে নিরপেক্ষ কর্মকর্তাদের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যুক্ত করতে পরামর্শ বা অনুমোদন না দেয় তাহলে নিরপেক্ষ নির্বাচনটা হবে কিভাবে? তখন কি নতুন আরেকটি নির্বাচন কমিশন গঠন হবে? এটা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। চাইলেই যখন তখন নির্বাচন কমিশন ভেঙ্গে দেয়া বা গঠন করা যায় না। 

সরলভাবে চিন্তা করলে এই কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে বিএনপি তথা বিরোধীদেরই সম্পৃক্ত হওয়া জরুরি ছিল। কেননা তাদের দাবি অনুয়ায়ী নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা হলেও নির্বাচন কিন্তু হবে এই কমিশনের অধীনেই। এই বাস্তবতা কি বিএনপি বুঝে ভুল করেছে? নাকি বিতর্ক প্রিয় জাতির জন্য সামনের নির্বাচনে বিতর্ক তৈরির বীজ বপণ করে রাখল? 

লেখক: চলচ্চিত্র নির্মাতা ও গণমাধ্যমকর্মী।

এনএস//


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি