ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪

নীরব ঘাতক ডায়াবেটিসে ভুগছেন না তো?

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১২:৩৮, ৪ মার্চ ২০২০ | আপডেট: ১২:৫২, ৪ মার্চ ২০২০

ডায়াবেটিস রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. শারমিন ইসলাম। ছবি: একুশে টেলিভিশন

ডায়াবেটিস রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. শারমিন ইসলাম। ছবি: একুশে টেলিভিশন

জটিল ব্যাধি ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গের নানাবিধ জটিলতার সৃষ্টি করে। এ থেকে একজন মানুষ সারা জীবনের জন্য পঙ্গুও হয়ে যেতে পারেন। ডায়াবেটিস সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা যত বাড়ছে, শহরকেন্দ্রিক ও আধুনিক জীবনযাত্রার কারণে সব বয়সীর মধ্যে এ রোগের আক্রান্তের হারও বাড়ছে। আজকাল ডায়াবেটিস এতো বেশি মহামারি আকার ধারণ করেছে যে, এই রোগটি সম্পর্কে না জানলেই নয়। 

সব পরিবারেই কারো না কারোর ডায়াবেটিস আছে। গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের প্রায় ৮.৫% মানুষ ডায়াবেটিসে ভুগছেন।
শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনযাপন ও নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলার মাধ্যমে এ ঘাতক ব্যাধি থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব৷ 

ডায়াবেটিসের নানা বিষয় নিয়ে একুশে টেলিভিশনের সঙ্গে কথা বলেছেন রেজিয়া তালেব হাসপাতালের ডায়াবেটিস রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. শারমিন ইসলাম। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন মুছা মল্লিক।
 
একুশে টেলিভিশন: ডায়াবেটিস রোগটি কি? 
ডা. শারমিন  ইসলাম: অগ্নাশয়ে যে ইনসুলিন তৈরি হয়, সেই ইনসুলিন যদি ঠিকভাবে কাজ না করে অথবা এই ইনসুলিন   ক্ষরণে বা তৈরিতে যদি ব্যাঘাত ঘটে (সেটা যেকোন কারণেই হতে পারে। যেমন- জেনেটিক কারণ, পরিবেশগত কারণ অথবা অগ্নাশয়ের কোন সমস্যা হলে) তখনই রক্তে সুগারের পরিমাণ বেড়ে যায়, যাকে আমরা বলি ডায়াবেটিস।

একুশে টেলিভিশন: কখন ডায়াবেটিস নির্ণয় হয়? 
ডা. শারমিন ইসলাম: অগ্নাশয়ে ইনসুলিন তৈরি হয় একটা বিশেষ কোষ থেকে, যার নাম বিটা। যখন এই বিটা কোষ অনেকটাই ধংস হয়ে যায় অথবা বিটার কাজ করার ক্ষমতা যদি কমে যায় তাহলেই ডায়াবেটিস প্রকাশ পায়। 

একুশে টেলিভিশন: ডায়াবেটিস কত ধরনের হতে পারে?
ডা. শারমিন ইসলাম: ডায়াবেটিসকে আমরা সাধারণত চার ভাগে ভাগ করে থাকি। তবে আমাদের দেশে টাইপ ১ এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেশি। 

একুশে টেলিভিশন:  টাইপ ১ ডায়াবেটিস সম্পর্কে জানান। 
ডা. শারমিন ইসলাম: টাইপ ১ ডায়াবেটিস (type 1 diabetes mellitus/insulin dependent diabetes) এটি হয় যখন অগ্নাশয়ের (pancreas) ইনসুলিন তৈরির কোষ অথাৎ বিটা কোষ (beta cell) অটো ইমিউন মেকানিজম (auto immune mechanism) এর মাধ্যমে বেশিরভাগই ধংস (destruction) হয়। এই জন্য যখন টাইপ ১ ডায়াবেটিস ধরা পড়ে তখন শরীরে ইনসুলিন থাকে না বললেই চলে বা থাকলেও তা খুবই সামান্য পরিমাণে থাকে। এইজন্যই টাইপ ১ ডায়াবেটিস রোগীদের বাহির থেকে ইনসুলিন দিতে হয়। যার কোন বিকল্প নাই। যে কোন বয়সে টাইপ ১ ডায়াবেটিস হতে পারে। তবে সাধারণত বাচ্চাদের/কম বয়সে এটি বেশি হয়। এর সূত্রপাত হয় আকস্মিকভাবে, তাই চাইলেই আমরা বাধা দিতে বা থামাতে পারি না।

একুশে টেলিভিশন: টাইপ ২ ডায়াবেটিস সম্পর্কে বলুন।
ডা. শারমিন ইসলাম: টাইপ ২ ডায়াবেটিস (type 2 diabetes/non-insulin dependent diabetes)। Insulin resistance and relative insulin deficiency এর জন্য টাইপ ২ ডায়াবেটিস হয় এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যাই বেশি। টাইপ ২ ডায়াবেটিস রোগীদের ইনসুলিন তৈরি হয় কিন্তু তা পরিমাণে কম (তবে টাইপ ১ এর থেকে বেশি বা এর বিটা কোষ টাইপ ১ এর তুলনায় বেশি থাকে) অথবা তা ঠিক ভাবে কাজ করে না। তাই টাইপ ২ ডায়াবেটিসে অনেক সময় ইনসুলিন দিতে হয় না, যার জন্য আমরা টাইপ ২ ডায়াবেটিসকে non insulin dependent diabetes বলে থাকি। সাধারণত বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে টাইপ ২ হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। আর টাইপ ২ হওয়ার আগে pre diabetic stage (impaired fasting glucose-IFG and impaired glucose tolerance -IGT) pass/পার করে। ২৫% IFG এবং ৩০% IGT ডায়াবেটিসের দিকে অগ্রসর হয় আর বাকিরা এই অবস্থায় থাকে অথবা নরমালে চলে আসে। তাই চাইলেই আমরা ডায়াবেটিস হওয়ার আগে তাকে বাধা দিতে পারি কিন্তু সাধারণত টাইপ ২ ডায়াবেটিসের লক্ষণ ধরা পরে ডায়াবেটিস হওয়ার অনেক সময় পর।

একুশে টেলিভিশন: জিডিএম (GDM/Gestational diabetes mellitus) কি? 
ডা. শারমিন ইসলাম: প্রেগন্যান্সি পিরিয়ডে যদি সুগার বেড়ে যায় তবে আমরা তাকে GDM/gestational diabetes mellitus বলে থাকি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ডেলিভারির কিছুদিনের মধ্যেই সুগার কমে আসে অর্থাৎ ডায়াবেটিস আর থাকে না। 

একুশে টেলিভিশন: কি কি কারণে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেড়ে যায়? 
ডা.শারমিন ইসলাম: বিভিন্ন কারণে ঝুঁকি বাড়তে পারে। তবে সাধারণত - 
• বংশের কারো যেমন বাবা-মা, দাদা-দাদি বা নানা-নানির এ রোগ থাকে, তাদের আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেশি। 
• যারা খাবার গ্রহণের পর পর্যাপ্ত ব্যায়াম করে না। 
• যারা নিয়মিত চিন্তিত, উদ্বিগ্ন ও টেনশনে থাকেন।
• নেশাজাতীয় খাবার গ্রহণ। 
• দীর্ঘদিন স্টেরয়েড ওষুধ দ্বারা চিকিৎসা চলার কারণে। 
• শারিরীক পরিশ্রম না করা।
• বয়স ও উচ্চতার তুলনায় যাদের ওজন বেশি থাকে তারাই এ রোগে বেশি আক্রান্ত হতে পারেন।

একুশে টেলিভিশন: কিভাবে একজন মানুষ বুঝতে পারবে তিনি এ রোগে আক্রান্ত? 
ডা. শারমিন ইসলাম: ডায়াবেটিস হলেই এর লক্ষণ প্রকাশ পাবে এমন কোন কথা নেই। বিশেষ করে বয়স্ক ব্যক্তিদের ডায়াবেটিসের লক্ষণ নাও থাকতে পারে। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও রক্ত, প্রসাব পরীক্ষার মাধ্যমে এ রোগ ধরা পড়ে। তবে সাধারণভাবে যে লক্ষণগুলো থাকে তা হলো - 
• ক্ষুধা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাবে। বার বার খেয়েও মনে হবে ক্ষুধা লাগছে এবং শরীরে শক্তি পাওয়া যাচ্ছে না। 
• অত্যাধিক পানির পিপাসা থাকে। পেট ভরে পানি খেলেও গলা শুকনো মনে হয়। 
• ঘন ঘন প্রসাবের চাপ হবে। 
• মিষ্টি খাবারের প্রতি আকর্ষণ বাড়বে। এছাড়া নানাবিধ উপসর্গ দেখা দিতে পারে।

একুশে টেলিভিশন: একজন ডায়াবেটিস রোগী প্রাথমিক অবস্থায় কি কি পরীক্ষা করবেন? 
 ডা.শারমিন ইসলাম:  বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা রয়েছে। তার মধ্যে আছে Fasting plasma glucose/Fasting blood glucose (FPG/FBS), Random plasma glucose/Random blood glucose (RPG/RBS), Oral glucose Tolerance test( OGTT) and HbA1c. তবে OGTT পরীক্ষাই সব থেকে ভালো ডায়াবেটিস ডায়াগনোসিসের ক্ষেত্রে।

একুশে টেলিভিশন: কিভাবে করা হয় এই OGTT পরীক্ষা? 
ডা. শারমিন ইসলাম: পরীক্ষা শুরু করতে হবে সকালে, তবে তার আগে সারারাত (৮-১৪ ঘন্টা) খালি পেটে থাকতে হবে এবং
পরীক্ষার আগের তিন দিন কোন ধরনের বাধা থাকবে না কোন কিছু খেতে। ১৫০ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার নিতে হবে।
সকালে খালি পেটে রক্ত নেওয়ার পর ৭৫ গ্রাম glucose ২৫০-৩০০ এমএল পানিতে মিশিয়ে খেতে হবে এবং পাঁচ মিনিটে শেষ করতে হবে। ১২০ মিনিট হয়ে গেলে দ্বিতীয়বারের মতো রক্ত নিতে হবে।
এই পরীক্ষায় যদি খালি পেটে সুগার >7.0 mmol/L এবং ২ ঘন্টার পর সুগার >11.1 mmol/L আসে তাহলে ডায়াবেটিস ধরা হবে। মনে রাখতে হবে যেকোন একটিও যদি নরমালের থেকে বেশি পাওয়া যায় তাহলে ডায়াবেটিস হিসেবে গণ্য হবে। এমন
নয় যে ২টিই বেশি আসবে অথবা বেশি আসলেই ডায়াবেটিস। যে কোন একটি বেশি আসলেও ডায়াবেটিস হিসেবে ধরা হবে।

একুশে টেলিভিশন: ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর কি ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে? 
ডা. শারমিন ইসলাম: ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ না থাকলে শরীরে বিভিন্ন অঙ্গ বিশেষ করে কিডনি, চোখ, স্নায়ুতন্ত্র, হার্ট ও রক্তনালিকাগুলো ক্রমশ নষ্ট হতে থাকে এবং এক সময় তা অকার্যকর হয়ে যায়। বারডেম হাসপাতালের সমীক্ষা অনুযায়ী প্রতিমাসে গড়ে দুজনের বেশি রোগীর পা কেটে ফেলতে হয়। এছাড়া প্যারালাইসিস এ রোগের অন্যতম জটিল বিষয়গুলোর
একটি।

একুশে টেলিভিশন: ডায়াবেটিস রোগীরা কি কি খাবার খাবেন?  
ডা. শারমিন ইসলাম: সব রকমের শাক যেমন- পালং, লাল, পুঁইশাক, ফুলকপি, বাঁধাকপি, মুলা, ওলকপি, কাঁচা টমেটো, কাঁচা পেঁপে, বেগুন, শসা, উচ্ছে, করলা, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, ধুন্দল, পটল, চালকুমড়া। এছাড়া কঁচি ডাবের পানি, লেবু, জাম্বুরা, আমড়া, জামরুল, আমলকি, ভিনেগার ও আচার ইত্যাদি। 

একুশে টেলিভিশন: কোন খাবার নিষেধ আছে কি?
ডা.শারমিন ইসলাম: সাধারণত চিনি, চিনি দিয়ে তৈরি করা খাবার, কেক, পেস্ট্রি, জ্যাম, জেলি, গ্লুকোজ, গুড়, খেজুরের রস, মধু, দুধ, বিভিন্ন ধরনের কোমল পানীয় ইত্যাদি।  

একুশে টেলিভিশন: ধন্যবাদ আপনাকে। 
ডা. শারমিন ইসলাম: আপনাকেও ধন্যবাদ।

এএইচ/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি