নৈতিক শিক্ষা মূল্যবোধের কারিগর
প্রকাশিত : ১৫:৪৮, ১৭ জুন ২০১৯
শিক্ষা মানুষকে বিকাশিত করে। গাছ যেমন ডালপালা ছড়িয়ে বড় আকার ধারণ করে নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়। তেমনি শিক্ষা মানুষের অস্তিত্বকে জাগিয়ে তোলে। প্রতিটি স্তরে সেই মানুষের চিহ্ন থাকে যার ভেতর শিক্ষা রয়েছে। আর নৈতিকতা এই শিক্ষাকে উঁচু স্তরে নিয়ে যায়। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্বের আসনে অধিষ্ঠিত করে। সততা, ন্যায়পরায়ণতা, দৃঢ়তা, আদর্শবাদী মনোভাবে নৈতিকতার স্বরুপ প্রকাশিত হয়।
মানুষের বড় সম্পদ হলো মূল্যবোধ। নৈতিক শিক্ষা মূল্যবোধের কারিগর। সৎ ও সুন্দর জীবন যাপনের জন্য নৈতিক শিক্ষা অপরিহার্য। যার ভেতর নৈতিক শিক্ষার গুণগুলো রয়েছে সে দৃঢ়তার সঙ্গে আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠেন।
নৈতিকতার ইংরেজি Morality. ল্যাটিন শব্দ মোরালিটাস থেকে আগত। যার অর্থ ভদ্রতা, সঠিক আচরণ, ভাল বা সঠিক এবং খারাপ বা ভুল বিষয়সমূহের মধ্যে পৃথকীকরণ। নৈতিকতাকে একটি আদর্শিক মানদণ্ড বলা যেতে পারে যা বিভিন্ন অঞ্চলের সামাজিকতা, ঐতিহ্য, সংষ্কৃতি, ধর্ম প্রভৃতির মানদণ্ডের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। আবার অনেক ক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে পৃথিবীর জন্য কল্যাণকর বিষয়সমূহকেও নৈতিকতা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়।
নৈতিকতা-মূল্যবোধ মানুষের জীবনের এমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার যে, এটা ক্ষতিগ্রস্ত হলে দেখা দেয় নানামুখী প্রতিক্রিয়া। যার পরিণতি হতে পারে পাপবোধ, অস্থিরতা, দুশ্চিন্তা, অশান্তি। যদিও অধিকাংশ মানুষই স্বীকার করতে চান না- এসব ভোগান্তির কারণ হচ্ছে তাদেরই অনৈতিক, অবিবেচনাপ্রসূত, দুর্নীতিপরায়ণ ও প্রতারণাপূর্ণ আচরণের ফলাফল।
কোনো একটি কাজ শুরু করতে গিয়ে এর প্রয়োজনীয়তা কিংবা এর ভালো-মন্দ পরিণতি চিন্তার আগে আমরা হয়তো ভাবি, কাজটি করে আমাকে কী কী সুবিধা পাব বা আমি এতে কতটুকু লাভবান হবো? কিন্তু নৈতিক শিক্ষার মানুষ কখনো এ রকম ভাববে না। কাজটি কাউকে কষ্ট দিবে কি না বা ক্ষতিকর কিনা, সামগ্রিকভাবে কল্যাণকর কিনা এসব চিন্তা করেই সে কাজ করবে।
নৈতিকহীনতা শারীরিক অসুস্থতার পাশাপাশি মানসিক অশান্তি ও অসুস্থতা সৃষ্টি করে। সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, একজন মানুষের সার্বিক সুস্থতার জন্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো তার চারিত্রিক দৃঢ়তা, সততা এবং সমুন্নত নৈতিক চেতনা।
বর্তমানে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও মনের শক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে যথাযথ নৈতিক শিক্ষাকেই গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।
দৈনন্দিন জীবনে আমরা যা করি, সোজা কথায়, আমাদের অন্তর্গত সত্তার প্রকৃত ধরনটিই আসলে আমাদের চরিত্র। আর ভালো ও উন্নত চরিত্রের অন্যতম প্রধান শর্তটাই হলো ভালো কাজ। তা যত কঠিন আর ঝুঁকিপূর্ণই হোক না কেন। আর আপনি নিজে যে আচরণ অন্যের কাছে প্রত্যাশা করেন না, তা অন্যের সঙ্গে করাটা কখনোই সৎ-চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ নয়।
মনোবিদরাও বলছেন, যদি অন্যের কাছ থেকে ভালো আচরণ প্রত্যাশা করেন তবে আপনিও তাই করুন। এতে আপনার একটা অনুপম চারিত্রিক দৃঢ়তা গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পারিপার্শ্বিক পরিমণ্ডলেও আপনি পরিচিত হয়ে উঠবেন একজন সত্যিকারের ভালো মানুষ হিসেবে। ফলে চারপাশের পরিবেশও আপনার জন্যে ক্রমশ হতে থাকবে সুখকর, আনন্দময় এবং নিশ্চিতভাবেই কর্মোপযোগী।
সামাজিক প্রভাব বা প্রতিপত্তি যাই হোক না কেন, শুধু সদাচরণের পথ ধরেই সবার দৃষ্টিতে হয়ে উঠতে পারেন একজন ব্যতিক্রমী মানুষ। আপনার এই নৈতিকতাসম্পন্ন মূল্যবোধ অন্যদেরও প্রভাবিত করবে নিঃসন্দেহে।
গবেষকরা বলছেন, চরিত্র-শিক্ষার শুরু হওয়া উচিত শৈশব থেকেই। আর এ দায়িত্ব মা-বাবার একার নয়। আত্মীয়-পরিজন, শিক্ষক এমনকি সমাজের প্রতিটি মানুষের। অর্থাৎ শিশু যাদেরই সংস্পর্শে আসবে সকলের কিছু না কিছু ভূমিকা রয়েছে শিশুর চরিত্র গঠনে।
এর জন্য শিশুর উপর কিছু চাপিয়ে দিয়ে নয়, ভীতিকর পন্থায়ও নয়, বইয়ের ভাষায়ও নয়। সহজভাবে নিজে করে শিশুকে দেখানো, যাতে শিশুটি অতি সহজে বুঝতে পারে। যেমন ভাল বাক্য বিনিময়, সহযোগিতা করা, সত্যের ওপর দৃঢ় থাকা, সম্মান প্রদর্শন, আত্মনির্ভরশীল হওয়া ইত্যাদি।
আপনার অজান্তেই শিশু তার ক্ষুদে চোখ, কান, মনস্তত্ত্ব দিয়ে সে নীরবে প্রত্যক্ষ করছে আপনার সমস্ত আচরণ ও কথাবার্তা। এগুলো কিন্তু শিশু অনুকরণ করে থাকে। সন্তানের দৃষ্টিতে যদি অনুকরণীয় হতে চান, তবে তাকে যা করতে বলছেন নিজেও তাই করুন। তাকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে শেখান ক্ষমা আর সমমর্মিতার মতো মহৎ গুণগুলো। এতে তার অন্তর্গত সত্তা ক্রমশ বিকশিত ও আলোকিত হয়ে উঠবে।
এছাড়াও গল্প বলার ছলে শিশুকে কোনো কিছু শেখানোটা বেশ কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে শিশু-মনোবিজ্ঞানীদের অনুসন্ধানে। প্রতিদিন না হোক, সপ্তাহে অন্তত যে-কদিন যখনই সময় পান আপনার শিশু সন্তানটিকে সময় দিন। আমাদের নৈতিক সংস্কৃতির আবহে রচিত চিরন্তন গল্প, ঘটনা, উপাখ্যানগুলো তাকে শোনান। এর মর্মকথা তাকে বুঝিয়ে বলুন।
গল্পগুলোর অন্তর্নিহিত নৈতিক শিক্ষা তাকে পরিশ্রমী, বাস্তববাদী ও চরিত্রবান হতে অনুপ্রাণিত করবে। আর এভাবেই তার সঙ্গে গড়ে উঠবে আপনার এক চমৎকার বোঝাপড়ার সম্পর্ক। গল্পের শেষে তার কাছ থেকে এ বিষয়ে মতামত জানতে চান। জিজ্ঞেস করুন, সে কী বুঝল কিংবা গল্পের কোন অংশটি তার সবচেয়ে ভালো লেগেছে এবং কেন? এতে আপনিও তাকে সহজেই বুঝতে পারবেন।
প্রযুক্তির আগ্রাসন আর শত কাজের ব্যস্ততায় শিশুর চরিত্র গঠনে বর্তমানে আমরা প্রায় নিষ্ক্রিয় ভূমিকাই পালন করেছি। কিন্তু যেসব মা-বাবা সচেতনভাবে এ লক্ষ্যে সন্তানদের সময় দিচ্ছেন তারা নিঃসন্দেহে বুদ্ধিমান ও সফল। এ উদ্যোগ একদিকে যেমন তাদের সন্তানদের মাঝে সমমর্মিতা, সহানুভূতি ও সামাজিক দায়িত্ববোধের জন্ম দিচ্ছে তেমনি এর ফলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সুস্থ, সৎ ও আত্মনির্ভরশীল নাগরিক সৃষ্টির মাধ্যমে উপকৃত হবে দেশ ও সমাজ।
তথ্যসূত্র : শিশুর উপর বিভিন্ন গবেষণা এবং ইন্টারনেট।
এএইচ/