ঢাকা, রবিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

পটিয়ার বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব মাওলানা নূরুল হক শাহ (র.)

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৮:৩৫, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | আপডেট: ০৮:৩৭, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

Ekushey Television Ltd.

ধর্মীয় শিক্ষায় উচ্চশিক্ষিত যে সব ব্যক্তি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছিলেন এবং সরকারের রক্তচক্ষুকে ভয় না করে কারাবরণকে মাথা পেতে নিয়েছিলেন তাঁদের অন্যতম মাওলানা মুহাম্মদ নূরুল হক শাহ (র.)। পারিবারিক অভাব-অনটনকে উপেক্ষা করে সমাজসেবা ও ধর্মীয় শিক্ষার প্রসারেও অনন্য ভূমিকা পালন করেন তিনি। ‘পটিয়া শাহচান্দ আউলিয়া মাদ্রাসা’ তাঁর কীর্তির উজ্জ্বল স্বাক্ষর।

মাওলানা নূরুল হক (র.)-এর জন্ম ১৮৮৯ সালের ১১ এপ্রিল পটিয়া উপজেলার বাহুলী গ্রামে। তাঁর বাবা মাওলানা সৈয়দ আবদুস সামাদ ও মা সৈয়দা আকিমুন্নেসা। জন্মের মাত্র তিন বছর পর মাতৃহারা হলে তিনি সৎ-মা ও জেঠিমার স্নেহ ও তত্ত্বাবধানে লালিত-পালিত হন। তিনি আরবি, বাংলা, উর্দু ও ফারসি বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন তাঁর জ্যাঠা মাওলানা সৈয়দ মকবুল আহমদ শাহ-প্রতিষ্ঠিত মক্তবে। প্রাথমিক শিক্ষা শেষে মুহাম্মদ নূরুল হক তাঁর ছোট মামা হাফেজ সৈয়দ মুহাম্মদ জকী উদ্দিন শাহর তত্ত্বাবধানে থেকে হাফেজে কুরআন ও ক্বারী উপাধি লাভ করেন। তিনি উনিশ শতকের ১০-১১ সালের দিকে চট্টগ্রাম মোহসেনিয়া মাদ্রাসা থেকে (বর্তমানে হাজি মুহাম্মদ মুহসিন কলেজ) দাখিল ও আলিম পাশ করেন। এরপর কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসা থেকে ১৯১৫ সালে ফাজিল (এফ এম) ১৯১৭ সালে কামিল (এমএ) পাস করেন। তিনি কোরআন, হাদীস, তাফসীরসহ ধর্মীয় নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের পর বাংলা-ইংরেজি শিক্ষায়ও দক্ষতা অর্জনের প্রয়োজন অনুভব করেন এবং সে অনুযায়ী পড়ালেখা করে এন্ট্রান্স পাশ করেন।

মাওলানা নূরুল হকের কর্মজীবন শুরু ১৯১৯ সালের ৫ মে চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে হেড মাওলানা পদে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে। তাঁর যোগ দেওয়ার পর থেকে সেখানকার শিক্ষায়-জ্ঞানে পিছিয়ে থাকা মুসলমান ছাত্রদের মেধার স্ফুরণ দেখা যায় এবং তারা বৃত্তি প্রাপ্তিতেও এগিয়ে যেতে থাকে। এপর্যায়ে বিদ্যালয় কমিটির পক্ষ থেকে (১৯২১ সালে) তাঁকে মুসলমান ছাত্রদের বৃত্তি বাতিল করার জন্য চাপ দেওয়া হলে তিনি তাতে অস্বীকৃতি জানিয়ে পদত্যাগ করেন। এরপর হেড মাওলানা হিসেবে যোগ দেন পটিয়া আবদুস সোবহান রাহাত আলী উচ্চবিদ্যালয়ে। 

জানা যায়, এর আগে মুসলমান ছেলেদের শিক্ষার প্রসারের লক্ষ্যে উচ্চবিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠায় মাওলানা আবদুস সোবহানকে নানাভাবে সহযোগিতা করেন মাওলানা নূরুল হক। তিনি বাহুলীর যে মক্তবে প্রাথমিক শিক্ষা নেন সেটিকে এলাকার বাসিন্দা তৎকালীন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ফজলুল করিমসহ অন্যদের সহযোগিতায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রূপান্তর করেন। মাওলানা নূরুল হক অত্যন্ত সাদামাটা জীবন-যাপন করতেন। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ছনের ছাউনি দেওয়া মাটির ঘরে পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন তিনি। তাঁর মুরিদ-ভক্তরা উপহার হিসেবে যা দিতেন তা তিনি নিজে ভোগ না করে মাদরাসা-এতিমখানায় বিলিয়ে দিতেন।

মাওলানা নূরুল হক ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক-সমাজ সচেতন রাজনীতিক-সংগঠক। ১৯০৫ সালে স্বদেশি আন্দোলনের অংশ হিসেবে গঠিত ‘চট্টল হিতসাধিনী সভা’ এবং ১৯২০ সালে শুরু হওয়া ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনের অংশ হিসেবে কলকাতায় অনুষ্ঠিত কংগ্রেস অধিবেশনে ও পরবর্তীকালে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন তিনি। বিদেশি কাপড় বর্জন করে দেশি কাপড় পরিধানের সুযোগ তৈরির লক্ষ্যে তিনি বাহুলী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে একটি তাঁতশিল্প স্থাপন করেন । ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের দায়ে তাঁর প্রতিষ্ঠিত তাঁতঘর থেকে ১৯২২ সালে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিন মাস পর মুক্তি পেয়ে আবারও সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ নেন এবং ১৯২৩ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের প্রতিনিধি-সভায় যোগ দেন। সমসাময়িক রাজনৈতিক নেতা ও সংগঠকদের মধ্যে যতীন্দ্রমোহন সেন, মহিমচন্দ্ৰ দাশ, মাওলানা মনিরুজ্জমান ইসলামাবাদী, জালাল আহমদ, কাজেম আলী মাস্টার, কল্পনা দত্ত, ব্যারিস্টার সানাউল্লাহ, আবদুল হক দোভাষসহ অনেকের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ব্রিটিশ আমলের শেষ দিকে মুসলিম লীগকে সংগঠিত করার কাজে যুক্ত হলেও পাকিস্তান সৃষ্টির পর তিনি কোনো পদে থাকতে রাজি হননি।

সমাজসেবায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন মাওলানা নূরুল হক। কৃষকদের স্বনির্ভর করে তোলা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অবিভক্ত চট্টগ্রামের চকরিয়ায় অবস্থিত দেশের সবচাইতে বড় সমবায় প্রতিষ্ঠান ‘বদরখালী সমবায় কৃষি ও উপনিবেশ সমিতি’ প্রতিষ্ঠা ও বিকাশে তাঁর ভূমিকা ছিল প্রধান। ১৯২৮ সালে তিনি এর সম্পাদক ছিলেন। তাঁর সবচেয়ে বড় কীর্তি হলো ‘পটিয়া হযরত শাহচান্দ আউলিয়া মাদ্রাসা'র প্রতিষ্ঠা। ধর্মীয় শিক্ষা, নীতি-নৈতিকতা এবং ইসলামী, বিশেষ করে সুন্নী আকিদায় মানস গঠনের লক্ষ্যে ১৯২৮ সালে তিনি এ মাদ্রাসার গোড়াপত্তন করেন এবং ১৯৫২ সাল পর্যন্ত অধ্যক্ষ পদে দায়িত্ব পালন করেন। স্থানীয় ও আশপাশের এলাকার শিক্ষানুরাগী অনেকে তাঁর আহ্বানে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠায় সাড়া দিয়ে সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন। বাঁশ, ছন, মাটির কাঠামোয় স্থাপিত সেই মাদ্রাসা এখন বিশাল আয়তনের পাকা দালান ও উচ্চ শিক্ষায়তনে পরিণত হয়েছে।

১৯৫২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর এই মহান গুণী ব্যক্তি ইন্তেকাল করেন।

সূত্র: গৌরব গাথা, পটিয়া উৎসব ২০২২ স্মারক
এসএ/


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি