ঢাকা, শুক্রবার   ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪

পটিয়ার বিশিষ্ট লোককবি সুফীসাধক আস্কর আলী পণ্ডিত

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১০:৪৩, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | আপডেট: ১২:৩২, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

‘না রাখি মাটিতে না রাখি পাটিতে, না রাখি পালঙ্কের উপরে, সিঁথির সিঁন্দুরে রাখিব বন্ধুরে ভিড়িয়ে রেশম ডোরে, কী জ্বালা দিয়ে গেলা মোরে নয়নের কাজল পরানের বন্ধুরে, না দেখিলে পরান পোড়ে, কী দুঃখ দিয়ে গেলা মোরে, নয়নের কাজল পরানের বন্ধুরে না দেখিলে পরান পোড়ে’। গানের কথাগুলো শুনলে যে কারো হৃদয় ছুঁয়ে যাবে।

ভাঙা হৃদয়ের জন্য গানটি হবে মনের দাওয়াইয়ের মতো। গানটি লিখেছেন প্রয়াত লোককবি সুফীসাধক আস্কর আলী পণ্ডিত। তিনি ১৮৫৫ সালে (মতান্তরে ১৮৪৬) সালে চট্টগ্রামের পটিয়া শোভনদণ্ডী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন, আবার কেউ কেউ বলে তাঁর গ্রাম সাতকানিয়ার পুরাণগড়। পিতার নাম মোশারফ আলী। পিতামহের নাম ডোমন ফকির। তাঁর পুরুষদের বাড়ি ছিল সাতকানিয়ার বাজালিয়া গ্রামে। তার এক ভাই আমিরজান এবং চার বোনেরা হলেন রহিমজান, ফুলজান, সাহেব জান ও মেহেরজান। নয় বছর বয়সেই আস্কর আলী পণ্ডিতের বাবা মারা যান। 

আস্কর আলী ছিলেন একাধারে গায়ক, গীতিকার, সুরকার, পদকার, পুঁথিকার ও কণ্ঠশিল্পী। তিনি বেশ কিছু বইও রচনা করেছেন। যেমন- বর্গাশাস্ত্র, নন্দবিহার, নন্দবিলাস, গীত বারমাস, সতী সঙ্গিনী, হাদিস বাণী ও নাটক কাজীর পাট। সুফিসাধক আস্কর আলীর পুঁথিগত বিদ্যা সম্পর্কে বিস্তারিত জানা না গেলেও যে তাঁর আধ্যত্মিক ও গায়েবি এলম ছিল সেটা বুঝা যায়। জ্ঞান চৌতিসায় তিনি লিখেছেন- ‘ধনজন হীন বিদ্যা শিখিতে না পারি, কিঞ্চিত দিলেক প্রভু সমাদর করি’।

আস্কর আলী পণ্ডিতের ‘জ্ঞান চৌতিসা’ পুঁথি নামে একটা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তার জীবদ্দশায় পুঁথিটি প্রকাশিত হয়নি তার মৃত্যুর পর পুঁথিটি সর্ব প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালে। কবি বলেন- ‘পুন সেই পুস্তক রচিতে হৈল মতি, শ্রীযুক্ত আবদুল হাদি করিল আরতি’। জ্ঞান চৌতিসা মূলত প্রণয় কাহিনীকাব্য। 

আস্কর আলী পণ্ডিত শেষ বয়সের রচনা করেন ‘পঞ্চসতী প্যারজান’ কবি লিখেছেন- ‘দন্ত ছিল জুবা কালে ইক্ষু খাই শুতি, তখনে কহিছি রাস চৌতিসার পুঁথি। দন্ত গেল ঝরিয়া বয়স হইল শেষ, অম্ল রস পানে এবে পিত্ত হৈল বেশ’।

সুফিসাধাক আস্কর আলীর পণ্ডিতের পূর্বপুরষদের মধ্যে বেশ কয়েকজন সুফিসাধক দরবেশ ছিলেন। তিনি পারিবারিক ও সামাজিক গৃহস্থালী কাজ করতেন। এছাড়া তিনি ছিলেন একজন ধর্মপরায়ন মুসলামান সারাক্ষণ ইবাদত বন্দেগিতে মশগুল থাকতেন। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের গীতিকার আবদুল গফুর হালী আস্কর আলী পণ্ডিতের সাহচর্য পেয়েছিলেন। গফুর হালী আস্কর আলী পণ্ডিতের প্রতি খুব সম্মান দেখাতেন।

কথিত আছে আস্কর আলী যেভাবে সুফিসাধক হয়ে উঠেন। প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে আস্কর আলী পণ্ডিতের ঘরে বসতো ইসলামিক গানের আসর (ধারা)। রমজান মাসের এক বৃহস্পতিবারে রাতে চায়ের দোকানে বসে তার ভক্ত ও সাথীদের বললেন, তোমরা আগামী বৃহস্পতিবার আসবা না। ধারা বন্ধ থাকবে। তবে তোমরা শুক্রবারে সবাই এসো। সবাই কিছুটা বিস্মিত ও অবাক হলেন। হঠাৎ সুফি সাধক একথা কেন বললেন? সবার মনে কৌতূহল। সেদিন রাতে সবাই চলে গেলেন। একজনকে বললেন আপনি যাবেন না। আপনার সাথে কিছু কথা আছে। আপনি কাউকে বলবেন না। আপনি আজ রাতে কবর স্থানে গিয়ে আমার জন্য একটা কবর খনন করবেন। ১৯২৭ ইং ১২৮৮ মঘি ২৭ ফাল্গুন বৃহস্পতিবার আস্কর পণ্ডিত তারাবী নামায আদায়ের পর চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিলেন। আড্ডার মাঝে বন্ধু বান্ধবদের সাথে গানও গাইলেন। সবার কাছ থেকে হাসি মুখে বিদায় নিলেন। বাসায় গিয়ে পুত্র বধূকে বললেন, আমার জন্য পাটি আর চাদর ধুয়ে রাখতে বলেছিলাম রেখেছো কি? ধুয়ে রাখলে সে গুলো নিয়ে এসো। পুত্রবধূ পরিচ্ছন্ন পাটি আর চাদর নিয়ে এলো।

অতঃপর সুফি ও লোককবি আস্কর আলী পণ্ডিত বললেন, ‘এগুলো বিছিয়ে দাও পূর্ব পশ্চিম নয় উত্তর দক্ষিণ করে বিছিয়ে দাও। বিছানা করার পর বললেন, আমার মেয়েকে ডেকে আনো। মেয়েকে পাশের বাড়ি থেকে খবর দিয়ে ডেকে আনা হলো। মেয়েকে বাবার পাশে বসতে বললো। মেয়ে বসল আস্কর আলী তার মেয়েকে বললেন, “আমার ডান পাশে খনন করে দেখ মাটির নিচে একটা ঘডি বা কলসি আছে। কলসি ভর্তি রৌপ্য মুদ্রা আছে। এ মুদ্রা মা তোমার জন্য, তুমি তোমার নিজের জন্য এ মুদ্রা ব্যয় করো। বাম পাশে খনন করে দেখ আরেকটি ঘডি ভর্তি রৌপ্য মুদ্রা আছে। এ মুদ্রা দিয়ে আমার জন্য একটা জেয়াফতের আয়োজন করো।” এই কথা বলে তিনি চাদরমুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লেন। দু-চার মিনিট পড় সবাই দেখল কোন সাড়া শব্দ নেই। মেয়ে জামাই চাদর তুলে দেখলেন। তার শ্বশুর বাপজান আর এ জগতে নেই। রাত্রিকালে গ্রামবাসীর ঢল নামল আস্কর আলী পণ্ডিত কে দেখতে। 

প্রয়াত পুঁথি গবেষক মুহাম্মদ ইসহাক চৌধুরী আসকর আলী সম্পর্কে বলতে গিয়ে জানান, ‘যে মৃত্যুকে চিনতে পারেনি সে কি ফকির হলো। আস্কর আলী মৃত্যুকে চিনতে পেরেছিল বলে তিনি ফকির সুফি হয়েছেন’। 

আস্কর আলী পণ্ডিতের তিন স্ত্রী। প্রথম স্ত্রী রাহাতুন নেছা, দ্বিতীয় স্ত্রী মিছরি জান ও তৃতীয় স্ত্রী আতর জান।

১৯২৬ সালের পবিত্র রমজান মাসের কোন এক রজনীতে চিরতরে না ফেরার দেশে চলে যান তিনি।

আস্কর আলী পণ্ডিতের উপার্জনের পন্থা ছিলো; নিজের প্রায় দেড় দ্রোণ ধানিজমি এবং কবিরাজি চিকিৎসক ছিলেন। তাঁর গান ও কাহিনিভিত্তিক কাব্যের প্রধান বিষয় মানুষ। মানুষকে কেন্দ্র করে তাঁর চিন্তায় ও আদর্শে দার্শনিক প্রত্যয়ের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

২০১১ সালে আস্কর আলী পণ্ডিতের স্মারকগ্রন্থে (তৎকালীন বন ও পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী থাকাকালীন) বর্তমান তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এমপি তাঁর বাণীতে লিখেছেন- আস্কর আলী পণ্ডিত এ জনপদের একজন সুফীসাধক। উঁচুমাপের এই লোককবি আমাদের কাছে সমধিক আত্মার মিলনস্থল। তাঁকে এক বৃহৎ প্রতিষ্ঠান বলা চলে।

তাঁর সময়কালের এবং মৃত্যু-পরবর্তীকালের লোককবিরা গান-পুঁথি প্রভৃতি রচনায়, এমনকি নিজেদের গানে সুর সংযোজনে তাঁর প্রভাব এড়াতে পারেন নি। রমেশ শীল, সেকান্দর গাইন, খায়েরুজ্জমান পণ্ডিত ও মুন্সি আমিন শরীফ প্রমুখ লোককবি পণ্ডিতের দরবারে নিয়মিত যাওয়া-আসা করতেন। বিবিধ বিষয়ে তত্ত্ব-জ্ঞান আহরণ করতেন। এমনও প্রমাণ আছে, কবিয়াল রমেশ শীল পণ্ডিত সকাশে পাল্টাগানের তালিম নেন। অথচ চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের সুধীসমাজের কাছে প্রাপ্য সম্মান তিনি পান নি। 

তাঁর মৃত্যুর পর প্রায় পৌনে এক শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও তাঁর রচিত পুঁথি-গান সংগ্রহ-সংরক্ষণ ও প্রচার-প্রসারের কোন উদ্যোগ কোনভাবে গ্রহণ করা হয়নি। বাংলা সাহিত্যের অসামান্য কথাশিল্পী ও বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফা জীবদ্দশায় অনেক সাহিত্য-সেবীকে পণ্ডিতের পুঁথি-গান সংগ্রহের অনুরোধ জানান।

এক বাণীতে বর্তমান জাতীয় সংসদের হুইপ (২০১৮-২০২৩) সামশুল হক চৌধুরী লিখেছেন- “ছোটবেলা থেকে তিনি আস্কর আলী পণ্ডিতের গানের সাথে পরিচিত। তাঁর ধ্যান ও জ্ঞানের একাংশ তাঁকে ঘিরে। আমি আজ এলাকার জনপ্রতিনিধি। তাই তাঁর প্রত্যেক বাণী ও ব্রত প্রচারে এক গভীর টান অনুভব করি।”

তিনি আরও বলেন, “দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বড়োমাপের সুফীসাধক ও লোককবি হওয়া সত্ত্বেও স্বদেশে তিনি উপযুক্ত মূল্যায়ন পান নি। জোটে নি কোন পদক বা পুরস্কার। তাঁকে নিয়ে কোন গবেষণাকর্ম সম্পাদনের কোন প্রতিষ্ঠানও উদ্যোগ কখনো নেয় নি।”

আস্কর আলী পণ্ডিত এই অঞ্চলে সাহিত্যসাধনায় এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করে গেছেন।

সূত্র: গৌরব গাথা, পটিয়া উৎসব ২০২২ স্মারক
এসএ/
 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি