পতাকার লালবৃত্তে বাবার রক্ত লেগে আছে : নুজহাত চৌধুরী
প্রকাশিত : ১১:৪৮, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৭ | আপডেট: ১২:৫৪, ২২ জানুয়ারি ২০১৮
শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আব্দুল আলীম চৌধুরীর মেয়ে ডা. নুজহাত চৌধুরী।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল। কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা পেয়ে ভোর থেকে হাজারো মানুষ শহরের রাস্তায় বেরিয়ে পরেন। বিজয়ের বাঁধভাঙ্গা জোয়ারে নিজেকে শামিল করতে ছুটছে এদিক ওদিক। অনেকের হাতে বিজয়ের পতাকা। সেই মিছিলে অনেকের শামিল হওয়ার ছিলো। মুক্তিযুদ্ধে বাঙ্গালীর বিজয়ের ঠিক আগ মুহূর্তে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা জাতিকে মেধাশূন্য করতে বুদ্ধিজীবীদের রাতের আধাঁরে ধরে নিয়ে যায়। তারা বুঝতে পেরেছিলো জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করলে এদেশ কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে ১৪ ডিসেম্বর তারা ইতিহাসের এক নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালায়। বুদ্বিজীবী হত্যায় নেতৃত্ব দেয় রাজাকার, আলবদর, আল শামস।
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর যাদের ধরে নেওয়া হয়েছিলো তাদের মধ্যে শহীদ ডা. আবদুল আলীম চৌধুরী অন্যতম। তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর চিকিৎসকও ছিলেন।
১৬ ডিসেম্বরের বিজয় মিছিলে ডা. আবদুল আলিমকে খু্ঁজতে ছুটে যান তার সহধর্মিনী শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী ও দুই মেয়ে ফারজানা চৌধুরী ও নুজহাত চৌধুরী। কিন্তু কোনো মিছিলেই ডা. আলীমের দেখা মিলেনি আর। কখনোই ফিরবেন না তিনি। স্বাধীনতার চার দশকেরও বেশি সময় ধরে তাঁর স্মৃতিকে বুকে ধারণ করে আছেন শহীদ বুদ্ধিজীবী আলীম চৌধুরীর পরিবার। আপনজনকে হারানোর এই ব্যথা আজীবন বয়ে বেরাতে হবে তাদের।
স্বাধীন বাংলাদেশ চাওয়ায় ১৫ ডিসেম্বর সূর্য উদিত হওয়ার আগের বিকালে ডা. আবদুল আলীম চৌধুরীকে ধরে নিয়ে যায় আল বদর বাহিনী। বিজয়ের দু’দিন পর অর্থাৎ ১৮ ডিসেম্বর রায়ের বাজার বৌদ্ধভুমিতে তাঁর লাশ খুঁজে পাওয়া যায়। ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের নারকীয়তা ও বাবার স্মৃতি নিয়ে ইটিভি অনলাইনের মুখোমুখি হয়েছেন শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আবদুল আলীম চৌধুরীর মেয়ে ডা. নুজহাত চৌধুরী। তিনি জানাচ্ছেন সেসব দিনের কথা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কাজী ইফতেখারুল আলম তারেক।
ইটিভি অনলাইন : শহীদ বুদ্বিজীবী দিবস ও আপনার বাবা ডা. আলীম চৌধুরী একইসূত্রে গাঁথা। একটিকে বাদ বাদ দিয়ে অন্যটি ভাবা যায় না। আপনার মুখে একটু শুনতে চাই?
ডা. নুজহাত চৌধুরী : আমার বাবা ডা. আলীম চৌধুরী একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্বে শহীদের একজন। বাবার সঙ্গে ৭১ এর সম্পৃক্ততা অত্যন্ত নিবিড় ছিলো। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। তিনি পেশাগত জীবনে চক্ষু চিকিৎসক ছিলেন।
ইটিভি অনলাইন : বাবাকে যখন পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা ধরে নিয়ে যায় তখন আপনি অনেক ছোট। যদি কোনো স্মৃতি মনে থাকে শেয়ার করার মতো?
ডা. নুজহাত চৌধুরী : দেশে যখন যুদ্ধ শুরু হয় তখন আমি খুবই ছোট। তেমন কিছু মনে নেই। আমার সঙ্গে আমার বাবার কোনো ছবি নাই। আমার কাছে বাবা মানেই বাবা। বিকল্প কিছু হতে পারে না। আমি নিজেও দু’ বাচ্চার মা। মানুষ যখন বাবার কথা বলে তখন বুকের ভিতরে শূন্যতা বাড়ে। জাতীয় পতাকার লাল বৃত্তে বাবার রক্ত লেগে আছে। বাবাকে খুঁজি প্রিয় পতাকায়, মানুষের ভিড়ে, বিজয় মিছিলে। কিন্তু বাবা আর ফিরে আসে না।
ইটিভি অনলাইন : আমরা জানি তাঁকে বিজয়ের ঠিক আগ মূহুর্তে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই স্মৃতি যদি মনে করতে পারেন?
ডা. নুজহাত চৌধুরী : আমার বাবা খুবই মেধাবী ছিলেন। আপনি জানেন যে, এদেশের বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে বুদ্বিজীবীরা আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন। যার কারণে দিনের পর দিন আন্দোলন ক্রমাগতভাবে বেগবান হয়েছিলো। সেই আন্দোলনের একজন একনিষ্ট কর্মী ছিলেন আমার বাবা। সেই আন্দোলনের বেশিরভাগই ছিলেন আওয়ামী লীগার। সেজন্যে তিনি খুব চিহ্নিত ব্যক্তি ছিলেন।
৭১ এ ওনি যেহেতু সরব ছিলেন সেজন্য অনেক ভীতু লোকও সেসময় আলীম চৌধুরীর গাড়িটা দেখলে গেইট বন্ধ করে দিতন। আলিম চৌধুরীর সঙ্গে সম্পর্ক আছে এটা যদি প্রকাশ পায়, যদি ওদের সমস্যা হয়। ওনি তেমন চিহ্নিত ব্যাক্তি ছিলেন। আগস্ট মাসের শেষের দিকে আমাদের বাসায় পিডিবির মতিন একজন লোককে নিয়ে আসলেন। তিনি হলেন মাওলানা মান্নান। যিনি ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি মূলত বাবাকে হত্যা করার জন্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন।
বাবা আবদুল আলীম চৌধুরী ও মা শ্যামলী নাসরিন চৌধুরীর সঙ্গে ডা. নুজহাত চৌধুরী। বাবার সঙ্গে নুজহাতের স্মৃতি বলতে শুধু এই ছবি-ই।
বিজয়ের আগের দিন রাতে আমাদের দরজা নক করেন। বন্ধুকধারী ক’জন এসে বাবাকে নিয়ে যান। আমার মা বাবাকে ফেরত চাইলে তিনি বলেন, তিনি ফিরে আসবেন। হয়তো যুদ্ধে কেউ আহত হয়েছেন সেজন্য তাকে নিয়ে গেছেন। সেসময় তিনি নিজেকে আল বদর বাহিনীর সদস্য হিসেবে পরিচয় দেন। পাকিস্তানিরা তো আর বুদ্বিজীবীদের চিনতো না, এরাই চিনিয়েছে।
ইটিভি অনলাইন : তারপর কি হলো?
ডা. নুজহাত চৌধুরী : আমার চাচা ও মা মিলে শহরের সবখানে বাবাকে খুঁজে ফিরলেন। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো। চারদিকে বিজয়ের আনন্দে মানুষ ঘর থেকে বের হয়ে এলো। হাতে পতাকা নিয়ে মিছিল হলো। কিন্তু বিজয়ের আনন্দে নিজেদের সামিল করতে পারেনি আমার পরিবার।
আমার চাচা মিছিলের মধ্যে বাবাকে খুঁজেছেন। তারপর ১৮ তারিখ রায়ের বাজার বৌদ্ধভূমিতে পেছনে হাত বাঁধা অবস্থায় বাবার লাশ খু্ঁজে পাওয়া গেল। পাকিস্তানিদের নিশ্চিত পরাজয় বুজতে পেরে তাদের এ দেশীয় দোসররা এদেশকে মেধাশূণ্য করবার লক্ষ্যে বুদ্বিজীবীদের হত্যার নেশায় মেতে উঠে। এতে নেতৃত্ব দেয় রাজাকার, আল বদর, আল শামসসহ শান্তিবাহিনীর লোকজন। এই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্বাধীন বাংলাদেশ চাওয়ার অপরাধে বিজয়ের সূর্য উদিত হওয়ার আগে ১৪ ডিসেম্বর চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে যায়।
সারারাত নির্মম নির্যাতনের পরে যখন পূবের আকাশে ভোরে স্বাধীনতার সূর্য উদিত হচ্ছে তখন বাবাকে ওরা বেয়োনেট চার্জ করে। ওরা ব্রাশ করে বুকটা ঝাঁঝরা করে দেয়।
আমি আমার বাবার বুকে ঘুমাতাম। যে বুকের উপরে ঘুমাতাম সেই বুকের ভেতরে স্বাধীন দেশের স্বপ্ন ছিলো। ওরা সেই বুকে বেয়োনেট চার্জ করেছে। ব্রাশ করে ঝাঁজরা করে দিয়েছিল। আর আমার বুকে চিরদিনের জন্যে শূণ্যতা ভরে দিলো। এই শূণ্যতা কতটুকু তা আমি জানি। যারা ৭১ এ স্বজন হারিয়েছেন তারাই ভালো বলতে পারবেন এই বেদনা কতদূর। কি ভীষণ বেদনা নিয়ে বয়ে চলি। আমার এত বয়স হয়ে গেলো। অথচ,এই বেদনার অশ্রু আজও থামাতে পারলাম না।
ইটিভি অনলাইন : আপনার বাবার অনুপস্থিতিতে কিভাবে ৭১ পরবর্তী দিনগুলি পাড়ি দিলেন?
ডাঃ নুজহাত চৌধুরী : আমার বুঝ হওয়ার পর যদি এমন দেখতাম যে, মুক্তিযুদ্বের চেতনায় বাংলাদেশ চলছে তাহলে নিজেদের এত অসহায় লাগতো না। আমরা শহীদ পরিবার গুলিতো কিছু চাইতে যায়নি কারো কাছে। ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্টে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আরও অনিরাপদ হয়ে গেলাম।
বাবার হত্যাকারী সেই খুনি মান্নানকে জিয়াউর রহমান ডেকে নিয়ে প্রতিমন্ত্রী বানান। গাড়িতে স্বাধীন দেশের পতাকা তুলে দেন। এরশাদ পূর্ণ মন্ত্রী বানান। এই হলো তাঁর পুরষ্কার। সে তো মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতো, তেমন উল্লেখযোগ্য কেউ ছিলো না।
ইটিভি অনলাইন : তৎকালীন রাজনৈতিক বৈরী পরিবেশে কিভাবে ‘প্রজন্ম ৭১’ সংগঠনটি গঠন করলেন এবং বিচারের দাবিতে সোচ্চার হলেন?
ডা. নুজহাত চৌধুরী: নব্বই দশকে যখন দেশে একটু কথা বলার স্কোপ তৈরি হলো আমরা যখন একটু বড় হলাম। তখন আমার বয়স বিশ- একুশ। তখন শহীদ পরিবারের সন্তানদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সবাই একএিত হতে লাগলাম। সেই প্রেক্ষাপটে গঠিত হলো ‘প্রজন্ম ৭১’।
এমন সময় আমরা যুদ্বাপরাধীদের এবং জামায়াতের বিচার চাওয়া শুরু করি।অনেকে বলেছিলো জামায়াত অনেক শক্তিশালী হয়ে গেছে। তাদের ডালপালা, শিকড় গজিয়েছে। তাদের প্রতিহত করা সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধুর হত্যার কিছু বছর পর মৃত্যুকে মাথায় নিয়ে দেশে ফেরেন জননেএী শেখ হাসিনা। দেশে এসে অসীম সাহসিকতাপূর্ণ মনোভাব নিয়ে তিনি হাল ধরেন। এর পরে কালক্রমে বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার করেন। যুদ্বাপরাধীদের বিচারের আওতায় এনে বিচার করছেন।
ইটিভি অনলাইন : বুদ্বিজীবীদের হত্যাকান্ডের মূল হোতা বেশ ক`জন যুদ্বাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। আপনাদের অনুভুতি কি?
ডা. নুজহাত চৌধুরী : দেখুন, আমার মাকে খুশি করতে আমি চোখের ডাক্তার হয়েছি। বাবার শূণ্যতায় মায়ের চোখে অশ্রু মুছতে পারি নাই। এতো চেষ্টা করি মায়ের চোখের অশ্রু থামে না। প্রধানমন্ত্রীকে দেখলে স্বস্তি লাগে। তিনি ছাড়া তো আমাদের দুঃখ বুঝবার কেউ নেই। ছোটবেলায় আমরা প্রায় বঙ্গবন্ধুর ৩২ নাম্বার বাড়িতে যেতাম। বঙ্গবন্ধু দুঃখের সঙ্গে বলছিলেন ওরা আমার চোখের ডাক্তারটাকেও (ডা. আলীম চৌধুরী) মেরে ফেলছে। আলীমকে যারা মেরেছে আমি নিজ হাতে তাদের বিচার করবো। সে সময় তিনি আর পেলেন কই? তার মেয়ে জননেএী শেখ হাসিনাই আমাদের বাবাদের হত্যাকারীদের বিচার করেছেন। আমাদের কাছে শেখ হাসিনাই বাংলাদেশ।
ইটিভি অনলাইন : আসছে বিজয় দিবসে জাতির কাছে কি প্রত্যাশা করেন?
ডা. নুজহাত চৌধুরী : আমাদের বাবারা হাসিমুখে মৃত্যু মেনে নিয়েছিলেন এই বিশ্বাসে যে, একদিন দেশটা স্বাধীন হবে। পতাকার মাঝে লাল যে অংশ আছে সেখানেও আমার বাবার রক্ত লেগে আছে। সব রক্ত দিয়েই তিনি এদেশ চেয়েছেন। আর তাই বলবো বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠিত হোক এটাই আমার চাওয়া। জননেএী যতোদিন দেশ পরিচালনায় থাকবেন ততোদিন এই দেশ মুক্তিযুদ্বের বাংলাদেশ থাকবে। আমাদের শহীদ পরিবারগুলির কাছে শেখ হাসিনাই বাংলাদেশ।
ইটিভি অনলাইন : ধন্যবাদ আপনাকে।
ডা. নুজহাত চৌধুরী : আপনাকেও অশেষ ধন্যবাদ। ইটিভি পরিবারের প্রতি শুভ কামনা রইল।
/ এআর /