ঢাকা, রবিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

পরার্থে স্বেচ্ছাশ্রম সুস্থ জীবনের আমোঘ দাওয়াই

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৬:১৪, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ১০:৪৭, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

Ekushey Television Ltd.

মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোনো এক স্কুলছাত্র। তার গল্পটা আগে বলে নেওয়া দরকার। কী একটা উপলক্ষে ওদের ক্লাসে একদিন বেশ খাওয়াদাওয়া হলো। সবারই পানির তেষ্টা পেয়েছে। তাই কয়েকটা গ্লাস জোগাড় করে দপ্তরিকে বলা হলো টিউবওয়েল থেকে জগভর্তি করে পানি এনে দিতে। ক্লাস-ক্যাপ্টেন সেই ছেলেটি নিল সবাইকে পানি খাওযানোর দায়িত্ব।

মিনিট বিশেক ধরে চলল এই পানি-পান পর্ব। দপ্তরি জগভর্তি করে পানি এনে দিচ্ছে, ছেলেটি সেই জগ হাতে সহপাঠীদের কাছে গিয়ে গ্লাসে পানি ঢেলে দিচ্ছে। সবার খাওযা শেষ হলে ছেলেটি গিয়ে বসে পড়ল তার বেঞ্চিতে।

আপাতদৃষ্টিতে ঘটনা অতি সামান্যই। কিন্তু একটি পরই হঠাৎ যে অপার্থিব শিহরণ ছেলেটি অনুভব করল, সেটি তার জীবনে এই প্রথম। জীবনে প্রথমবারের মতো সে উপলব্ধি করল-চাইলে সেও অন্যের জন্যে কিছু করতে পারে! ক্লাসে প্রথম হয়ে কিংবা ক্লাসে-ক্যাপ্টেনের ভূমিকায় সবার স্নেহ ও সমীহ জোটে বটে, কিন্তু তার চেয়েও এক অলৌকিক আনন্দ আর সুখ মেলে পরার্থে কিছু করতে পারায়। এই সুখানুভূতির তোড়ে নিজের চোটখাটো খোভ-দুঃখ, রাগ-অভিমান কোথায যে মিলিয়ে যায়!

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, ছেলেটি সেদিন বুঝতে পেরেছিল-জগতে তারও একটা ভূমিকা আছে, তারও কিছু দেওয়ার কাছে পৃথিবীকে।

ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো বলে বাংলায় একটা প্রবাদ আছে। কথাটা সাধরণত বলা হয়ে থাকে তাচ্ছিল্য অর্থে, কিন্তু সেই দিন বুঝি এবার ফুরাল।

সাম্প্রতিক কালের চিকিৎসা বিজ্ঞানী-মনোবিদদের চমকপ্রদ সব গবেষণা-প্রতিবেদনগুলো বলছে, ঘরের খেয়ে সত্যিই যারা বনের মোষ তাড়াতে পারেন অর্থাৎ কোনো রকম প্রতিদানের প্রত্যাশা ছাড়াই চারপাশের মানুষ ও সমাজের কল্যাণে নিয়মিত কাজ করে যান, তাদের সুস্বাস্থ্য ও দীঘায়ুর সম্ভাবনা বাড়ে ক্রমশ। কমে হতাশা-বিষন্নতা-একাকিত্বের অনুভূতি। তাদের পোশা জীবনেও সৃষ্টি হয় অনবদ্য সাফল্য-সম্ভাবনা।

এ প্রেক্ষিতে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পারামর্শ-এখন থেকে চিকিৎসকদের উচিত সুস্থতার জন্যে রোগীদের সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও ব্যায়ামের পাশাপাশি সামাজিক কল্যাণে কাজ করার পারামর্ম দেওয়া।

 

সেবাকর্মে স্ট্রেস কমে, রক্তচাপ থাকে নিয়ন্ত্রণে এবং বাড়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা

পেশাগত দায়িত্ব বা কোনো ব্যাপারে কি উদ্বিগ্ন সময় পার করছেন? স্ট্রেস কি ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে আপনার দৈনন্দিন জীবনে? নাকি বিষন্নতার আক্রমণে আপনি পর্যুদস্ত? ভয় নেই। আছে মোক্ষম সমাধান।

বাসে চড়ে কোথাও যাচ্ছেন, আপনার পাশেই কি দাঁড়িয়ে আছেন গর্ভবতী নারী বা বায়োজ্যেষ্ঠ কেউ? আপনার আসনটা তার জন্যে ছেড়ে দিন। অধস্তন ব্যক্তিটি নিত্যদিন আপনাকে আগে সালাম দেন, আজ কি উল্টোটা হতে পারে না।

দিন শেষে ভেতরে সূক্ষ্ম একটা পরিবর্তন আপনি নিজেই টের পাবেন। এই যে অন্যের তরে সাধ্যমতো কিছু করলেন, একটুখানি দিলেন, ওই দেওয়া টুকুতেই সুখ, তাতেই জীবনের অর্থপূর্ণতা। কারণ একটু একটু করেই একসময় মানুষ অনুপ্রাণিত হয়ে ওঠে বড় কিছু দিতে। সঙ্ঘবদ্ধ প্রচেষ্টায় সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যায়া একটা ইতবিাচক পরিবর্তনের দিকে।

সাইকোলজি টুডে সাময়িকীর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অন্যের কল্যাণে কাজ করে যে নির্মল সুখানুভূতি আমরা লাভ করি, তাতে সেরোটনিন-এন্ডোরফনের মতো নিউরোট্রান্সমিটার ও হরমোনের প্রবাহ বাড়ে, যা বিষন্নতা-দুশ্চিন্তার মতো নেতিবাচক আবেগের ঝঁকি কমায়। সেই সাথে বাড়ায় রোগ প্রতিরোধ শক্তি। সংহত হয় আবেগীয় ভারসাম্য। দেহ-মনকে করে চনমনে ও গতিময়।

উচ্চ রক্তচাপের অন্যতম করাণ স্ট্রেস। আর মানব কল্যাণে কাজ স্ট্রেস কমায় বলে এটি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণেও সক্ষম। যুক্তরাষ্ট্রের কার্নেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচালিত এক গবেষণায় এর সত্যতা মিলেছে। তাতে দেখা গেছে, বছরে অন্তত দুশ ঘণ্টা স্বেচ্ছাশ্রমে ব্যয় করেছেন এমন স্বেচ্ছাসেবীর রক্তচাপ আগের তুলনায় কমেছে।

স্বেচ্ছাশ্রমে কেবল বয়স্করাই উপকৃত হচ্ছেন না। সম্প্রতি কানাডায় ১০ম গ্রেডে পড়ুয়া ১৬০ জন শিক্ষার্থীর ওপর সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, স্বেচ্ছাসেবামূলক  কার্যক্রমে যুক্ত হওয়ার পর তাদের কোলেস্টেরলের মাত্রা ও অতিরিক্ত ওজন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে।

 

স্মৃতিভ্রষ্টতা ও স্নায়ুবিক-মানসিক জটিলতার কার্যকর দাওয়াই

গত কয়েক দশকে বার্ধক্যজনিত স্মৃতিভ্রষ্টতা বা আলঝেইমার্স রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে চলছে সারা পৃথিবীজুড়েই। এটি প্রতিরোধের জন্যে স্বাস্থ্যসম্মত জীবনধারা গুরুত্বপূর্ণ বটে, তার পাশাপাশি সেবামূলক কাজে সময় দেওয়ার মাধ্যমেও আপনি এ থেকে মুক্ত থাকতে পারেন। পাশ্চাত্যের খ্যাতনামা স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকদেরই পরামর্শ এটি।

বার্ধক্য বিষয়ক চিকিৎসা-সামায়িকী জার্নাল অব জেরোন্টোলজিতে গবেষকরা বলেছেন, সমাজসেবামূলক কার্মকাণ্ডের ফলে মানব মাস্তিষ্কের স্থিতিস্থাপকতায় ঘটে ইতিবাচক পরিবর্তন। অন্তঃনিউরোন সংযোগ বাড়ে মস্তিষ্কে। কমে আলঝেইমার্ষের ঝুঁকি। ৬৫ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সীদের ক্ষেত্রে এভাবেই বার্ধক্যজনিত স্মৃতিভ্রষ্টতা প্রতিরোধ করা সম্ভব।

আছে আরো চমকপ্রদ তথ্য। সেবাধর্মে নিবেদিত একদল বায়োবৃদ্ধ নান-এর মৃত্যুর পর তাদের মস্তিষ্ক সংরক্ষণ করা হয়। পরবর্তীতে গবেষকরা দেখেন, এক-তৃতীয়াংশের মস্তিষ্কই ছিল আলঝেইমার্সের উপসর্গ-আক্রান্ত। কিন্তু মজার ব্যাপার, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নৈন্দিন কাজকর্ম যেমন: শিশুদের পড়ানো, জটিল ধাঁধা সমাধান এমনকি গাড়ি চালিয়ে রোগীদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পৌঁছে দেওয়ার কাজেও ওরা ছিলেন দারুণ স্বচ্ছন্দ।

এর কার্যকারণ ব্যাখ্যায় গবেষকরা বলছেন, মস্তিষ্ক মানবদেহের এমন একটি বিস্ময়কর অঙ্গ-যার কোনো অংশ ক্ষতিগ্রস্ত বা অকেজো হলেও সে ঠিকই তার অক্ষত অংশটুকু দিয়ে কোনোভাবে কাজ চালিয়ে নিতে সক্ষম-যদি সে ব্যক্তির সামনে থেকে নিত্যনতুন কর্মচাঞ্চল্য, চ্যালেঞ্জ ও কর্মপরিকল্পনা।

আর এ ধরনের কাজের সুবাদে পরিচিতির গণ্ডিটা বড় হয় বলে গড়ে ওঠে একটা সত্যিকারের সামাজিক যোগাযোগ এবং নতুন নতুন সম্পর্কের উষ্ণতায় মানুষ ক্রমান্বয়ে মুক্তি পায় পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারের মাতো (অতীত কোনো তিক্ত স্মৃতি বা দুর্ঘটনার ফলে সৃষ্ট) বিভিন্ন মনোদৈহিক ও স্নায়াবিক জটিলতা থেকে।

 

সেবায় তৃপ্তি ও সাফল্য, পরার্থপরতায় সুখ

২০১২ সালে যুক্তরাজ্যের ‘রয়াল ভালান্টারি সার্ভিস’ পরিচালিত গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, সঙ্ঘবদ্ধ সেবাকার্যে উৎসাহী মানুষের পরিণত বয়সে বিষন্নতা ও সামাজিক একাকিত্বের যন্ত্রণা থেকে মুক্ত থাকেন। তুলনামূলকভাবে এরা হন তৃপ্ত ও প্রশান্ত। সেবাব্রতী মানুষদের জীবনমানেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লক্ষ করেছেন গবেষকরা।

সামাজিক কল্যাণে বিভিন্ন সেবা-কার্যক্রমে যারা সময় ও শ্রম দেন, তারা হন অধিকতর আত্মবিশ্বাসী ও মানাসিকভাবে সক্ষম। নানা কাজের অভিজ্ঞতায় উদ্ভূত পরিস্থিতিগুলোও তারা সামলে নিতে শেখেন দ্রুততর দক্ষতায়। গবেষকরা বলছেন, এটি পেশাগত সমৃদ্ধিতেও রাখে দারুণ ভূমিকা।

শৈশবে এমন কাজের সুযোগ-পরিবেশ ভবিষ্যৎ জীবনের জন্যে উচ্চতর মূল্যবোধ গড়ে দেয়। এ কারণেই বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ওদের ভর্তি প্রক্রিয়ায় স্বেচ্ছাসেবার অভিজ্ঞতা আছে এমন শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে।

সাধ্যমতো আমরাও নিবেদিত হই সৃষ্টির সেবায়, মানুষের কল্যাণে। পরার্থপরতার মধ্য দিয়েই খুঁজে নিই জীবনের সার্থকতা। আমাদের সঙ্ঘবদ্ধ সব-প্রচেষ্টায় আলোকিত হোক লক্ষ দুস্থ-বঞ্চিতের জীবন।

 

তথ্যসূত্র: হার্ভার্ড হেলথ ব্লগ, জার্নাল অব মেডিকেল এসোসিয়েশন পেডিয়াট্রিকস, দ্য আটলান্টিক ও হাফিংটন পোস্ট।

এমএইচ/টিকে


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি