ঢাকা, সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

পরাশক্তি-প্রধান হয়েও সাদামাটা হযরত ওমর

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৭:১০, ২১ মে ২০২০ | আপডেট: ১৯:৩২, ২১ মে ২০২০

খলিফা হওয়ার পর ওমর মুসলিম উম্মাহকে বিশ্বব্যাপী নিপীড়ন শোষণ অবিচারের অবসানে সর্বস্ব ত্যাগে উদ্বুদ্ধ এক দুর্দমনীয় শক্তিতে রূপান্তরিত করেন। এরা আরব ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। তখনকার দুই পরাশক্তি পারস্য সাম্রাজ্য ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের ওপর তারা একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ইরাকের কাদিসিয়ার যুদ্ধে পারস্য বাহিনী বিপর্যস্ত হয় এবং সেনাপতি রুস্তম যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় ধৃত ও নিহত হন। একের পর এক যুদ্ধে পারস্য সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটে। ইয়ারমুকের যুদ্ধে রোমান বাইজেন্টাইন বাহিনী পরাজিত হয়। পুরো সিরিয়া, দামেস্ক, জেরুজালেম, ফিলিস্তিন ও মিশর থেকে বাইজেন্টাইন বাহিনী নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। বাইজেন্টাইন ও পারস্য-এই দুই পরাশক্তির ধ্বংসস্তূপের ওপর ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের পতাকা উড্ডীন করেন ওমর। তার নেতৃত্বে মুসলিম উম্মাহ রূপান্তরিত হয় সত্য ও ন্যায়ের প্রতীক একমাত্র পরাশক্তিতে।

অকুতোভয় ওমর ছিলেন কুশলী সমরবিদ, নীতিনিষ্ঠ শাসক, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন প্রশাসক। তিনি তার খেলাফতের অধীন এলাকাকে ১১টি প্রদেশে ভাগ করেন। বিচারব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন। আলীকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করেন এবং সবগুলো প্রদেশে কাজী অর্থাৎ বিচারকের পদ সৃষ্টি করেন। তিনি নবীজীর হিজরতের দিন থেকে হিজরি সন গণনা চালু করেন। তিনি নাগরিক তালিকা তৈরি করেন। তার আমলেই তিন শতাধিক ঘোড়সওয়ারের সমন্বয়ে একেকটা ঝটিকা ইউনিট গঠন করা হয়। দুর্বার গতির এই কৌশলগত বাহিনী যুদ্ধের ফলাফলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আসলে যুগে যুগে যে জাতি যুদ্ধে নতুন অস্ত্র বা নতুন রণকৌশল কার্যকরীভাবে ব্যবহার করতে পেরেছে, তারাই বিজয়ী হয়েছে।

খলিফা ওমর ছিলেন অবহেলিত, বঞ্চিতের সত্যিকার সেবক। মানুষের দুঃখ তাকে কাঁদাত। জনগণের কল্যাণ ও সেবা করাকে তিনি তার দায়িত্বের অংশ মনে করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘ফোরাতের তীরে একটি ছাগলও যদি অনাহারে মারা যায় তবে, আমি ওমরকে আল্লাহর কাছে এজন্যে জবাবদিহি করতে হবে।’ এই বিশ্বাসের কথা তিনি শুধু বলতেনই না, সেজন্যে সম্ভব সবকিছুই তিনি করেছেন। মানুষের দুর্দশা মোচনে সবসময়ই তিনি ছিলেন তৎপর। রাতে নগরীর আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়াতেন একাই। 

একরাতে তিনি হাররা ওয়াকিমে যাওয়ার পথে দেখলেন এক তাঁবুর সামনে এক মহিলা চুলায় একটা পাত্রে কিছু জ্বাল দিচ্ছে। কয়েকটি শিশু কাঁদছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘শিশুরা কাঁদছে কেন?’ ‘ক্ষুধার যন্ত্রণায়’, মহিলার জবাব। ‘তুমি চুলায় কী রান্না করছ?’ ওমরের প্রশ্ন। ‘কিছুই না। পাত্রে পানি ফুটাচ্ছি। আর অপেক্ষা করছি কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে ওদের ঘুমিয়ে পড়ার।’ মহিলার জবাব। ওমর কাঁদতে শুরু করলেন। দৌড় দিলেন রাষ্ট্রীয় গুদামের দিকে। সেখানে একটি বস্তায় প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী ভরলেন। উপস্থিত সহচর আসলামকে বললেন, বস্তাটা তার পিঠে উঠিয়ে দিতে। আসলাম বললেন, ‘আমিরুল মোমেনিন, আপনি এগোন। আমি বস্তা পিঠে করে নিয়ে আসছি।’ ‘তুমি কি মহাবিচার দিবসে আমার পাপের বোঝা বহন করবে?’ তীক্ষ্ণ প্রশ্ন ওমরের। ‘অতএব আমার বোঝা আমার পিঠে তুলে দাও।’

ওমর নিজে পিঠে করে বোঝা নিয়ে মহিলার কাছে উপস্থিত হলেন। নিজে চুলার ওপরে ফুটন্ত পানির পাত্রে আটা ও চর্বি মিশিয়ে জ্বাল দিলেন। যখন মোটা রুটি প্রস্তুত হলো, তিনি নিজে তা শিশুদের পরিবেশন করলেন। শিশুরা তৃপ্তির সাথে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। অবশিষ্ট খাদ্যসামগ্রী ওই নারীকে দিয়ে তিনি আল্লাহর স্মরণ করতে করতে ফিরে এলেন। বিপন্ন মানুষের সেবায় শুধু যে তিনি একাই ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, তা নয়। প্রয়োজনে নিজের স্ত্রীদেরও নিয়ে গেছেন। একদিন তিনি মদিনার উপকণ্ঠে এক তাঁবু থেকে ব্যথাজনিত কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলেন। কাছে গিয়ে জানতে চাইলেন, সমস্যা কী? মহিলা বললেন, আমরা এখানে আগন্তুক। কাউকে চিনি না। আমার প্রসববেদনা শুরু হয়েছে।

ওমর দ্রুত ঘরে ফিরে গিয়ে স্ত্রী উম্মে কুলসুমকে (আলী ও ফাতেমার কন্যা) জিজ্ঞেস করলেন ঘরে খাদ্যসামগ্রী কিছু আছে কিনা? স্ত্রী বললেন, আছে। তিনি একটা বস্তায় খাদ্যসামগ্রী ভরে পিঠে তুলে নিলেন। আর স্ত্রীকে বললেন প্রসবকে সহজ করার জন্যে প্রয়োজনীয় উপকরণ নিয়ে সাথে আসতে। দুজনেই দ্রুত সেখানে পৌঁছলেন। উম্মে কুলসুম তার উপকরণ নিয়ে তাঁবুর ভেতরে ঢুকে গেলেন। আর ওমর বাইরে বালুতে বসে মহিলার স্বামীর সাথে কথা বলতে থাকলেন। কিছুক্ষণ পর মহিলা এক পুত্র সন্তান প্রসব করেন। উম্মে কুলসুম ভেতর থেকে আনন্দে উচ্চস্বরে বলেন, আমিরুল মোমেনিন! আপনার সঙ্গীকে সুখবর দিন। তিনি পুত্রসন্তানের পিতা হয়েছেন। এতক্ষণ পর্যন্ত মহিলার স্বামীর ধারণাই ছিল না, সে কার সাথে কথা বলছে। যখন সে বুঝল তখন ভয় সমীহ শ্রদ্ধায় কাঁচুমাচু হয়ে গেল। ওমর তাকে আশ্বস্ত করে খাদ্যসামগ্রীর বস্তা দিয়ে সস্ত্রীক ফিরে এলেন। 

তার শাসনামলে একটি বছর ছিল খরা ও দুর্ভিক্ষের বছর। বাতাস এত উত্তপ্ত ছিল যে, গরম ছাই ত্বকে লাগলে ত্বক যেমন পুড়ে যায়, বাতাস লাগলেও ত্বক তেমনি পুড়ে যেত। মাংস মাখন দুধ দুষ্পাপ্য হয়ে গেল। সাধারণ মানুষের জীবন নির্ভরশীল হয়ে গেল শুকনো রুটির ওপর। কখনো কখনো সে রুটি একটু জলপাইয়ের তেলে ভিজিয়ে নেয়া হতো। ওমর শপথ করলেন, যতদিন পর্যন্ত সাধারণ মানুষ অন্য খাবার গ্রহণ করার সুযোগ না পাচ্ছে ততদিন পর্যন্ত তিনিও অন্য কোনো খাবার বা পানীয় গ্রহণ করবেন না।

তেল মাখানো শুকনো রুটি খেতে খেতে তার চেহারা বিবর্ণ হয়ে যায়। সাহাবীরা তার স্বাস্থ্যের অবস্থায় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেন, দুর্ভিক্ষ দীর্ঘায়িত হলে ওমর অর্ধাহারেই মারা যাবেন। এমনকি যখন বাজারে আবার খাদ্যসামগ্রীর সমাগম শুরু হয়, তখনও উচ্চমূল্যের কারণে তিনি তা খাওয়া থেকে বিরত থাকেন। খাদ্যমূল্য স্বাভাবিক পর্যায়ে এলে তিনি অন্য খাবার ও পানীয় গ্রহণ করেন।

খলিফা ওমর অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে বলেছেন, শাসক সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ হলেই জনগণ সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ হবে। সততা, নীতিনিষ্ঠতা ও ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে তার শাসনকালের কোনো তুলনা হয় না। তিনি যা বলেছেন তা অক্ষরে অক্ষরে প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন। ওমর নিজে সাধারণ মানুষের মতো মোটা কাপড় পরতেন। চাইতেন তার গভর্নর ও কর্মচারীরাও পোশাক-আশাকের বিলাসিতা বর্জন করুক। মদিনায় এক বেদুইন একদিন ওমরকে বললেন, তুমি কি মনে করো যে, তোমার কর্মচারীদের জন্যে কোনো নিয়ম করে দিলেই তুমি আল্লাহর কাছে পরিত্রাণ পাবে? মিসরের গভর্নর ইয়াদ ইবনে ঘনম তো মিহি পোশাক পরে বেড়ায়।

তিনি তৎক্ষণাৎ মুহাম্মদ ইবনে মাসলামাকে মিসরে প্রেরণ করেন। বলেন, যে পোশাকে ইয়াদকে পাওয়া যাবে, সে পোশাকেই তাকে মদিনায় নিয়ে আসার জন্যে। মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা মিসরে গিয়ে দেখলেন যে, অভিযোগ সত্য। ইয়াদ মিহি কাপড় পরে আছেন। তিনি সেই পোশাকেই ইয়াদকে নিয়ে মদিনায় ফিরে এলেন। খলিফা তৎক্ষণাৎ তাকে নির্দেশ দিলেন মিহি কাপড় খুলে সাধারণ মোটা কাপড় পরিধানের। সেই সাথে একটা ছাগলের পাল আনতে বললেন। ছাগলের পাল আনা হলে ইয়াদকে বললেন, এবার এগুলো জঙ্গলে নিয়ে চরাও। এখন থেকে তুমি ছাগলই চরাবে।

ইয়াদ তার নির্দেশ অমান্য করার সাহস করেন নি। কিন্তু বার বার বলতে লাগলেন, এই শাস্তির চেয়ে মৃত্যুই উত্তম। ওমর দৃঢ়ভাবে বললেন, এই কাজে লজ্জার কিছু নেই। তোমার বাবা জঙ্গলে ছাগল চরাতেন। এই জন্যে তার নাম হয়েছিল ঘনম। ইয়াদ পরে যথার্থই অনুশোচনা করেছেন এবং যতদিন বেঁচে ছিলেন ছাগল চরিয়েছেন। অথচ ইয়াদ ছিলেন দজলা ও ফোরাত মধ্যবর্তী ‘উর্বর চন্দ্রকলা’ খ্যাত অঞ্চলজয়ী বীর। 

আবু মুসা আশয়ারী তখন কুফার গভর্নর। তার সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কর্কশ কণ্ঠধারী এক সৈনিক যুদ্ধলব্ধ মালামাল নিয়ে বচসায় লিপ্ত হয়। সৈনিক তার ন্যায্য প্রাপ্যের সবটুকুই দাবি করে। এবং বলে, ন্যায্য পাওনার কম হলে সে কিছুই গ্রহণ করবে না। আবু মুসা এতে উত্তেজিত হয়ে তাকে ২০ বেত মারেন এবং মাথা ন্যাড়া করে দেন। সৈনিকটি নীরবে তার চুল কুড়িয়ে নিয়ে মদিনায় এসে ওমরের কাছে নালিশ করে। ওমর সব শুনে আবু মুসার কাছে পত্র লেখেন-

“তোমার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। অমুক ব্যক্তি তোমার আচরণ সম্পর্কে অভিযোগ করেছে। তুমি যদি সর্বসাধারণ্যে ঘটনা ঘটিয়ে থাকো তবে প্রকাশ্যে নতজানু হয়ে বসবে। আর যদি ঘরোয়াভাবে ঘটিয়ে থাকো তবে ঘরোয়াভাবে বসবে, যাতে সে তার প্রতিশোধ নিতে পারে।” যখন সৈনিকটি চিঠিসহ আবু মুসার কাছে হাজির হয় তখন উপস্থিত সবাই তাকে অনুরোধ করে গভর্নরকে ক্ষমা করে দেয়ার জন্যে। জবাবে সে বলে, তোমাদের কারো জন্যেই আমি তাকে ক্ষমা করব না। অগত্যা আবু মুসা নতজানু হয়ে বসলেন, যাতে সৈনিকটি বেত মেরে প্রতিশোধ নিতে পারে। তখন সে ওপরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার সন্তুষ্টির জন্যে আবু মুসাকে ক্ষমা করে দিলাম!’

ঘাস্সানীদের শেষ রাজা ছিল জাবালা ইবনে আল আইহাম। যখন চারদিকে ইসলামের জয়জয়কার তখন তিনি ইসলাম গ্রহণ করার জন্যে বেশ জাঁকজমকের সাথে বিশাল লটবহরসহকারে মদিনায় এলেন। তার আগমনে ওমর খুব খুশি হলেন। হজের সময় হলে জাবালা ওমরের সাথেই মক্কা সফরে গেলেন। কাবা তাওয়াফ করার সময় তার ইজার (নিম্নাঙ্গে পরা সেলাই ছাড়া কাপড়) বনু ফাজারা গোত্রের এক দরিদ্র ব্যক্তির পায়ের নিচে দৈবাৎ পড়ে যায়। এতে ইজার ঝুলে পড়ে। জাবালা রেগে গিয়ে বেদুইনের মুখে ঘুষি মারেন। তার মুখ রক্তাক্ত হয়ে যায়। বেদুইন ওমরের কাছে ফরিয়াদ করেন।

ওমর জাবালাকে ডেকে পাঠালেন। জিজ্ঞেস করলেন, কী কারণে তুমি এর মুখে আঘাত করেছ? উদ্ধত কণ্ঠে জাবালার জবাব, ‘সে আমার ইজারে পাড়া দিয়েছে। ইজার ঝুলে পড়েছে।’ ওমর বললেন, ‘তুমি তোমার অপরাধ স্বীকার করেছ। এখন হয় তাকে সন্তুষ্ট করো, না হলে সেও তোমার সাথে একই আচরণ করবে।’ বিস্মিত জাবালা বললেন, এটা কীভাবে সম্ভব! আমি একজন রাজা আর সে এক সাধারণ বেদুইন! ওমর বললেন, ইসলাম তোমার ও তার মর্যাদা সমান করে দিয়েছে। সৎকর্মের আধিক্য ছাড়া তার ওপর তুমি কোনোভাবেই মর্যাদাবান নও! জাবালা তখন একদিনের জন্যে বিষয়টি মুলতুবি রাখার আবেদন জানালেন। ওমর সম্মতি দিলেন। রাতের অন্ধকারে জাবালা দলবলসহ পালিয়ে গেল। নিজের দেশ ছেড়ে কনস্টান্টিনোপলে বাইজেন্টাইন সম্রাটের আশ্রয় গ্রহণ করল।

ওমর নীতির প্রশ্নে, ন্যায়বিচারের প্রশ্নে রাজা তো রাজা নিজের পুত্রকেও ছাড় দেন নি। তার পুত্র আবদুর রহমান ইবনে ওমর মিশর জয়ে বিভিন্ন যুদ্ধে অসীম সাহসিকতার সাথে অংশ নেন। ফুসতাতে নবনির্মিত গ্যারিসন শহরে নিজের জন্যে ঘর নির্মাণ করেন। একদিন তিনি মদ্যপান করে মাতাল হয়ে যান। তার মনে প্রবল অনুশোচনা সৃষ্টি হয়- আল্লাহর কাছে কী জবাব দেবো। তিনি সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন-মহাবিচার দিবসের কঠিন শাস্তির চেয়ে দুনিয়ার শাস্তিই উত্তম। তিনি মিশরের গভর্নর আমর ইবনুল আসের কাছে এই অপরাধের জন্যে নির্ধারিত শাস্তি প্রদানের অনুরোধ জানান। 

ঘটনা সম্পর্কে আমর ইবনুল আস বলেন, “আমি একটু বকাবকি করে আবদুর রহমানকে ছেড়ে দিতে চাই। কিন্তু সে জেদ ধরে, যদি আমি তাকে শরিয়ত নির্ধারিত শাস্তি না দেই, তবে সে মদিনায় গিয়ে খলিফার কাছে নালিশ জানাবে। তার কথায় আমার ভয় হলো, যদি আমি তাকে শাস্তি না দেই তবে সে খলিফার কাছে গিয়ে ঘটনা বলবে। আর খলিফা আমাকে সাথে সাথে বরখাস্ত করবে। আমি আবদুর রহমানকে আমার ঘরের মধ্যে শাস্তি দিলাম এবং পরে সে আমার ঘরের কোনায় মাথা ন্যাড়া করে ফেলল। আমি খলিফাকে এ ব্যাপারে কিছুই জানাই নি।

কিন্তু কিছুদিন পর আমি খলিফার কাছ থেকে একটি চিঠি পেলাম। ‘আমিরুল মোমেনিন আল্লাহর দাস ওমরের কাছ থেকে পাপিষ্ঠের প্রতি! তুমি প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করার সাহস দেখিয়ে আমাকে বিস্মিত করেছ। তোমাকে গভর্নর পদ থেকে বরখাস্ত করা উচিত। তুমি আবদুর রহমানের শাস্তি তোমার ঘরের আঙিনার ভেতরে করার দুঃসাহস দেখিয়েছ। যেখানে তুমি খুব ভালোভাবেই জানো, আমি এ ধরনের ছাড় দেয়াকে পছন্দ করি না। আবদুর রহমান তোমার অধীনস্থ প্রজাদেরই একজন। একজন সাধারণ প্রজা হলে তুমি যে শাস্তি দিতে, তাকেও সেইভাবে শাস্তি দিতে তুমি বাধ্য। কিন্তু তুমি তাকে খলিফার পুত্র বলে বিবেচনা করে শাস্তি হালকা করে দিয়েছ। অথচ তুমি জানো, ন্যায়বিচারের প্রশ্নে আমি কারো প্রতিই নমনীয়তা প্রদর্শন করি না। এখন আমি নির্দেশ দিচ্ছি, অবিলম্বে আবদুর রহমানকে মদিনায় প্রেরণ করো, যাতে সে যথাযোগ্য শাস্তি ভোগ করতে পারে।’

আমর ইবনুল আস বলেন, পরে আমি আবদুর রহমানকে আবদুল্লাহ ইবনে ওমরের সাথে মদিনায় প্রেরণ করি। সাথে প্রেরিত চিঠিতে আমি আবদুর রহমানকে ঘরের মধ্যে শাস্তি দিয়ে যে মহাভুল করেছি, সেজন্যে গভীর অনুশোচনা ব্যক্ত করি। আবদুর রহমান মদিনায় পৌঁছলে প্রবীণ সাহাবী আবদুর রহমান ইবনে আউফ খলিফার কাছে সুপারিশের চেষ্টা করেন। আবদুর রহমান যেহেতু একবার শাস্তি পেয়েছে, তাই তাকে ক্ষমা করে দেয়ার জন্যে তিনি অনুরোধ জানান। কিন্তু ওমর তার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। আবদুর রহমানকে প্রকাশ্যে শাস্তি দেয়া হয়। তিনি অসুস্থ হয়ে পরে মারা যান।

নিজের ব্যাপারেও ন্যায়বিচারের রায় মেনে নিতে ওমরের কখনো কোনো দ্বিধা ছিল না। একবার এক বেদুইনের কাছ থেকে ঘোড়া কেনার জন্যে ওমর তাতে সওয়ার হলেন। গতি পরীক্ষা করতে গিয়ে ঘোড়া হোঁচট খেয়ে খোঁড়া হয়ে গেল। ওমর বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘তোমার ঘোড়া নিয়ে যাও।’ বেদুইন বলল, ‘না! ঘোড়া নেব না। আমার ঘোড়ার দাম দিতে হবে।’ ওমর বললেন, ঠিক আছে। তা হলে বিষয়টি মীমাংসা করার জন্যে একজনকে তুমি সালিশ মানতে পারো। বেদুইন একটু চিন্তা করে ‘শুরাইহ্’-এর নাম বললেন।

মীমাংসার জন্যে দুজনই ‘শুরাইহ্’-এর কাছে গেলেন। শুরাইহ্ সব শুনে রায় দিলেন, ‘হে আমিরুল মোমেনিন! আপনি যে ঘোড়া দাম করেছেন তা নিয়ে যান, অথবা ঘোড়া যে অবস্থায় বিক্রেতার কাছ থেকে নিয়েছিলেন সেই পূর্বাবস্থায় (বর্তমান খোঁড়া অবস্থায় নয়) ফেরত দিন।’ ওমর তখন বললেন, হাঁ, তুমি যথার্থ ন্যায়বিচার করেছ। তিনি শুরাইহ্-কে বিচারক নিযুক্ত করে কুফায় প্রেরণ করলেন। ওমর বলতেন, ইসলাম হচ্ছে একটা দুর্গ। এর দেয়াল হচ্ছে ‘সত্য’ আর এর প্রবেশপথ হচ্ছে ‘ন্যায়বিচার’। যতক্ষণ শাসক সত্য ও ন্যায়বিচারের ওপর অটল থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এ দুর্গ অভেদ্য থাকবে।

দ্বিতীয় খলিফা ওমরের শাসনামলে বাইজেন্টাইন আধিপত্য থেকে পুরো সিরিয়া ও ফিলিস্তিনের মুক্তির জন্যে নিবেদিত বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন তিনি। তার নেতৃত্বেই ডানে ফোরাত নদী ও বামে এশিয়া মাইনর পর্যন্ত পুরো সিরিয়া শোষণের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়। ওমর সিরিয়া সফরের সময় মুসলিম অফিসারদের শরীরে জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক দেখে অত্যন্ত ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন, তোমরা এত তাড়াতাড়ি অনারবদের পোশাকে অভ্যস্ত হয়ে গেলে! আবু ওবায়দা যখন তার কাছে এলেন, তখন তার শরীরে ছিল সাদামাটা আরবীয় পোশাক।

খলিফা তার বাড়িতে গেলেন। সেখানে দেখলেন আরো সাধারণ অবস্থা। একটা তরবারি, একটা ঢাল আর উটের হাওদা ছাড়া কিছুই নেই। ওমর তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কিছু আসবাবপত্র জোগাড় করে নিলে না কেন? ওবায়দা বিনয়ের সাথে জবাব দিলেন, ‘আমার শেষ বিশ্রামস্থল পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার জন্যে এগুলোই যথেষ্ট।’

একটি ব্যতিক্রম ছাড়া আবু ওবায়দা কখনো কোনো নির্দেশ অমান্য করেন নি। তিনি তখন সমগ্র সিরিয়ায় অবস্থানরত মুসলিম বাহিনীর সর্বাধিনায়ক। এমন সময় সিরিয়ায় প্লেগ মহামারিরূপে বিস্তার লাভ করে। প্লেগে বহু মানুষ মারা যায়। মুসলিম সৈন্যদের মাঝেও প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে। এ খবর মদিনায় পৌঁছলে ওমর আবু ওবায়দাকে নির্দেশ পাঠালেন, ‘এই চিঠি পাওয়ামাত্র তুমি মদিনার পথে রওনা করো।’ কারণ ওমর চাচ্ছিলেন, আবু ওবায়দাকে তিনি পরবর্তী খলিফা হিসেবে মনোনয়ন দেবেন।

আবু ওবায়দা পত্র পেয়ে বললেন, ‘আমি জানি আমিরুল মোমেনিন কেন আমাকে যেতে বলছেন। তিনি এমন একজনের বেঁচে থাকাকে নিশ্চিত করতে চান, যে চিরঞ্জীব নয়।’ তিনি খলিফাকে লিখলেন, ‘আমি জানি আমাকে আপনার প্রয়োজন। কিন্তু আমি মুসলিম বাহিনীর সাথে রয়েছি এবং সেখানে প্লেগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। তাদেরকে বিপন্ন রেখে নিজেকে বাঁচানোর কোনো অভিপ্রায় আমার নেই। আমি তাদের থেকে আলাদা হতে চাই না। তাই আমার চিঠি পাওয়ার পর আপনার আদেশ পালন থেকে অব্যাহতি দিয়ে আমাকে সৈন্যদের সাথে থাকার অনুমতি দিন।’

১৪০০ বছর আগে নবীজীর নির্দেশনা এবং মহামারিকালে আধুনিক কোয়ারেন্টাইন
এই চিঠি পেয়ে ওমরের চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। এর কিছুদিন পর প্লেগে আক্রান্ত হয়ে আবু ওবায়দা মারা যান। আবু ওবায়দার স্থান ত্যাগ না করার আর একটি বড় কারণ ছিল নবীজীর নির্দেশনা। নবীজী বলেছেন, যখন কোনো স্থানে মহামারি আক্রমণ করে তখন সেখানে কেউ প্রবেশ করবে না। আর সেখানে যারা থাকবে তারা সে স্থান ত্যাগ করে বাইরেও আসবে না। সংক্রামক ব্যাধির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার আধুনিক কোয়ারেন্টাইন পদ্ধতি নবীজীর এই নির্দেশনারই অনুরূপ।

মৃত্যুশয্যায় আবু ওবায়দা তার সৈনিকদের শেষ উপদেশ দেন, ‘তোমরা নামাজ কায়েম করবে, রমজান মাসে রোজা রাখবে, দান করবে। ঐক্যবদ্ধ থাকবে। পরস্পরকে সহযোগিতা করবে। আন্তরিকভাবে কমান্ডারের নির্দেশ পালন করবে। কমান্ডারের কাছ থেকে কোনোকিছু গোপন করবে না। পার্থিব আকাঙ্ক্ষা যেন তোমাদের বিনাশ না করে। মনে রেখ, এমনকি তুমি যদি হাজার বছরও বেঁচে থাকো, আমার দিকে তাকাও, তোমার নিয়তিও হবে এই একই। আল্লাহর করুণা তোমাদের ওপর বর্ষিত হোক।’ এরপর তিনি মুয়াদ ইবনে জাবলের দিকে তাকালেন। বললেন, ‘মুয়াদ তুমি নামাজে এদের ইমামতি করো (তাদের নেতৃত্ব দাও)।’ এ কথার সাথে সাথে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

ওমর সৎ ও নীতিনিষ্ঠ হওয়ার কারণেই তিনি ছিলেন পরধর্ম, পরমত ও সমালোচনায় সহনশীল। আবু ওবায়দা জেরুজালেম অবরোধ করার পর আর্চ বিশপ শর্ত দিলেন, ওমর এলে তিনি নগরীর চাবি তার হাতে সমর্পণ করবেন। খলিফা একজন ভৃত্য নিয়ে রওয়ানা হলেন মদিনা থেকে। পালাক্রমে একজন হেঁটে, আরেকজন উটের পিঠে। দুর্গের প্রবেশপথের সামনে যখন উট পৌঁছল তখন খলিফা উটের রশি ধরে আর ভৃত্য উটের পিঠে। আর্চ বিশপ দৌড়ে গেলেন উটের পিঠ থেকে খলিফাকে নামানোর জন্যে। উটের পিঠে বসা ভৃত্য বলল, আমিরুল মোমেনিন তো রশি ধরে আছেন। একজন ভৃত্য আর একজন খলিফার পোশাকে কোনো পার্থক্য নেই।

গির্জায় বসে আর্চ বিশপের সাথে আত্মসমর্পণের শর্তাবলি নিয়ে আলোচনা চলছে। নামাজের সময় হলো। ওমর বাইরে গিয়ে নামাজ পড়ার জন্যে অনুমতি চাইলেন। আর্চ বিশপ হেসে বললেন, এখানেই পড়ে নিন। ওমর বললেন, না। আর্চ বিশপ বললেন, না কেন? মুসলমানদের নামাজ তো যে-কোনো স্থানেই পড়া যায়। আপনি কি এই গির্জার স্থানকে নামাজ পড়ার মতো পবিত্র মনে করেন না? ওমর বললেন, অবশ্যই এটা ধর্মীয় পবিত্র স্থান। কিন্তু আমি এখানে নামাজ পড়ব না। কারণ আজ যদি আমি এখানে আজান দিয়ে নামাজ পড়ি, তবে মুসলমানরা এরপর যে-কোনো গির্জায় গিয়ে আজান দিয়ে নামাজ পড়ে তাকে মসজিদ বানিয়ে ফেলবে। ওমর গির্জা থেকে বেরিয়ে এলেন। বাইরে পরিষ্কার জায়গা দেখে নামাজ পড়ে আবার গির্জায় ঢুকে আলোচনায় যোগ দিলেন। 

জেরুজালেম আত্মসমর্পণ করল। পুরো সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও মিশর তখন খ্রিষ্টান অধ্যুষিত বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অংশ। ধর্ম ও গির্জার নিরাপত্তার বার্তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সমগ্র এলাকার রোমান শোষণে নিষ্পেষিত খ্রিষ্টান জনসাধারণ খলিফার প্রতিনিধিদের বরণ করে নিল পরিত্রাতারূপে। পারস্য সাম্রাজ্যের অধীন অঞ্চলেও একই ঘটনা ঘটল। অগ্নি-উপাসক জনগণ তাদের ধর্ম ও মন্দিরের নিরাপত্তা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ায় মুসলমানদের গ্রহণ করল সামাজিক সাম্য ও ন্যায়বিচারের প্রতিভূরূপে। খোরাসান পর্যন্ত সাধারণ মানুষ প্রথমবারের মতো স্বাদ পেল সামাজিক সমানাধিকারের। দুই সাম্রাজ্যের শোষিত মানুষরা শ্রমিকরা প্রথমবারের মতো পেল উৎপাদিত পণ্যের অংশের ওপর অধিকার।

তদানীন্তন বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি-প্রধান ওমর নিজের মত প্রকাশে ছিলেন নিঃসংকোচ ও স্পষ্টভাষী। আবার সমালোচনা হজম করার সামর্থ্য আর ভুল হলে প্রকাশ্যে ভুল স্বীকার ও তা সংশোধন করার সাহসও তার ছিল। তার খেলাফতের শেষ দিকের ঘটনা। মুসলমানদের পার্থিব সম্পদ বাড়তে শুরু করেছে। বিয়ের দেনমোহরের পরিমাণও বেড়ে গেছে সম্মান ও আভিজাত্যের প্রমাণ হিসেবে। এই প্রবণতায় ওমর ক্ষুব্ধ হলেন। একদিন মসজিদে নববীতে মিম্বরে উঠে খুতবায় নির্দেশ দিলেন, দেনমোহর ৪০০ দিরহামের ওপরে হতে পারবে না। এর চেয়ে বেশি হলে বাড়তি অংশ বাজেয়াপ্ত করে বাইতুল মাল অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করা হবে।

ওমর এই বলে মিম্বর থেকে নামার সাথে সাথেই সাধারণ পরিবারের একজন বয়স্ক মহিলা উঠে দাঁড়ালেন। তিনি বললেন, কোরআনে এই ব্যাপারে কোনো সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয় নি। অতএব খলিফার কোনো অধিকার নাই দেনমোহরের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণের। মহিলা তার বক্তব্যের সপক্ষে কোরআনের সূরা নিসার ২০ নাম্বার আয়াত তেলাওয়াত করেন: ‘যদি তোমরা এক স্ত্রীর বদলে অন্য স্ত্রী গ্রহণের সিদ্ধান্ত নাও এবং প্রথম স্ত্রীকে প্রচুর অর্থবিত্ত দিয়ে থাকো, তবে তা থেকে কিছুই ফিরিয়ে নেবে না।’ এ বক্তব্য শোনার সাথে সাথেই ওমর মন্তব্য করলেন, ‘হে আল্লাহ! আমায় ক্ষমা করো। এই বৃদ্ধাও দেখছি কোরআন সম্পর্কে আমার চেয়ে বেশি জানে।’

খলিফা ওমর সাথে সাথে মিম্বরে উঠে ঘোষণা দিলেন, তিনি দেনমোহর সীমিতকরণের ব্যাপারে তার পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করছেন। দেনমোহর কত হবে এটা ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের বিষয়। তবে বেশি দেনমোহর সম্মান ও মর্যাদার বিষয় হলে নবীজী নিজেই তা অনুমোদন দিতেন। বাস্তবে তিনি ৪০০ দিরহাম পর্যন্তই অনুমতি দিয়েছেন। এ ঘটনা থেকে এও বোঝা যায়, তার শাসনামলে মসজিদে বক্তব্য রাখার ক্ষেত্রে একজন সাধারণ নারীও কত স্বাধীনতা ভোগ করতেন!

নারীদের কর্মক্ষমতা ও ব্যবস্থাপনা দক্ষতার ওপরও খলিফা ওমর ছিলেন আস্থাশীল। তাই রাজধানী মদিনার বাজারে পণ্যমান ও ন্যায্যমূল্য বজায় রাখার তদারকিতে নিযুক্ত করেন আল-শিফা বিনতে আবদুল্লাহ নামে একজন নারীকে যিনি সবসময় সাথে বেত রাখতেন এবং প্রয়োজনে বেত্রাঘাত করতেও কার্পণ্য করতেন না। আল-শিফার সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে আরেকজন মহিলা সামরা বিনতে নুহায়েক আল-আসাদিয়াকে মক্কার বাজার নিয়ন্ত্রক হিসেবে নিয়োগ করেন।

এ থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, খেলাফত যুগে বাজারে প্রচুর নারী বিক্রেতা ও ক্রেতা না থাকলে এই নিয়োগ সম্ভবপর হতো না। বাজার যদি প্রধানত পুরুষদেরই জায়গা হতো তবে নারীরা এই গুরুদায়িত্ব পালনে বাধার সম্মুখীন হতেন। কিন্তু দুজনের কেউই এমন কোনো কথা কখনো বলেন নি। খলিফা ওমরের আমলে সামাজিক নিরাপত্তা এতটাই নিশ্ছিদ্র ছিল যে, ইরাকের কুফা থেকে একজন নারী একা উটের পিঠে চেপে মদিনা বা মক্কায় আসা-যাওয়া করতে পারতেন। পথে অত্যাচারিত হওয়ার কোনো আশঙ্কা নারীদের ছিল না। 

নারীর অধিকার রক্ষায় তিনি ছিলেন আপসহীন। একবার এক নারী এসে অভিযোগ করল: তার স্বামী রাগের মাথায় তাকে একসাথে তিন তালাক দিয়েছে। এখন কী হবে? ওমর বললেন, তালাক তো হয়ে গেছে। কিন্তু সে তোমার তিন মাস সময়ের অধিকার ক্ষুণ্ন করেছে (বিধান অনুযায়ী প্রথম তালাক থেকে চূড়ান্ত তালাকের আগ পর্যন্ত বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্যে স্ত্রীর প্রাপ্য সময় তিন মাস)। তোমার এই অধিকার লঙ্ঘনের জন্যে অবশ্যই তার শাস্তি হবে।
তিনি স্ত্রীর অধিকার লঙ্ঘনের দায়ে স্বামীকে প্রকাশ্যে ৮০ বেত মারার ব্যবস্থা করলেন। কঠোর শাস্তির ফলে পরবর্তী শত বছরে আরবে একসাথে তিন তালাক দেয়ার কোনো ঘটনা পাওয়া যায় না। আসলে ইসলামে প্রতিটি অপরাধের শাস্তি দৃষ্টান্তমূলক করার কারণ হচ্ছে, কঠোর শাস্তির ভয়ে কেউ যাতে এই অপরাধ করতে সাহসী না হয়। 

পরাশক্তি-প্রধান হওয়া সত্ত্বেও তিনি শেষ দিন পর্যন্ত যাপন করেছেন সাধারণ মানুষের জীবন। কোনো দেহরক্ষী রাখতেন না। পোশাক-আশাক চালচলন দেখে কেউ তাকে সাধারণ থেকে আলাদা করতে পারত না। একবার বাইজেন্টাইন শাসনাধীন এলাকা থেকে এক দূত এলো। মদিনায় এসে একজনকে বলল, তুমি তোমাদের রাজার কাছে আমাকে নিয়ে চলো। রাজপ্রাসাদ কোথায় আমাকে দেখিয়ে দাও। লোকটি হেসে তাকে বলল, ঐ যে দূরে খেজুর বাগান দেখছ। ওখানে যাও। আমি ওদিক থেকেই আসছি। দেখেছি গাছের ছায়ায় তিনি ঘুমাচ্ছেন। দূত সব দেখে দেশে ফিরে গিয়ে রাজাকে বলল, যুদ্ধ করে কোনো লাভ নেই। যে রাজা কোনো দেহরক্ষী ছাড়াই গাছের ছায়ায় ঘুমাতে পারে, তার সাথে যুদ্ধ করে আমরা কোনোদিন জয়ী হতে পারব না।

তিনি কতোটা সাধারণ ছিলেন তা বোঝার জন্যে আরেকটি ঘটনা। কাদিসিয়ার যুদ্ধের সময় তিনি প্রতিদিন ফজর নামাজের পর একাই মদিনার উপকণ্ঠে চলে যেতেন। কোনো খবর আসে কিনা। এমনি একদিন তিনি দেখলেন, দূর থেকে একজন উট সওয়ার এদিকে আসছে। জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোথা থেকে আসছ? আরোহী উট না থামিয়েই বলল, “কাদিসিয়া থেকে। সুখবর! আমাদের জয় হয়েছে। সেনাপতি আমাকে পাঠিয়েছেন খলিফার কাছে খবর পৌঁছে দেয়ার জন্যে।” বলেই সওয়ারি উটের গতি দ্রুততর করল। ওমর উটের পাশে দৌড়াতে দৌড়াতেই যুদ্ধক্ষেত্র সম্পর্কে নানা প্রশ্নে উটচালককে জর্জরিত করছেন।

মদিনায় প্রবেশ করার পর হঠাৎ উষ্ট্রারোহীর খেয়াল হলো চারপাশের লোকজন সবাই দৌড়াতে থাকা মানুষটিকে সালাম দিচ্ছে ‘হে আমিরুল মোমেনিন’ বলে। উষ্ট্রারোহী এতক্ষণে যেন সংবিৎ ফিরে পেল। উট থেমে গেল।
উট থেকে লাফিয়ে নেমে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘হে আমিরুল মোমেনিন! আমাকে ক্ষমা করুন। আপনি পরিচয় দিলে আমার দ্বারা এরকম কঠিন বেয়াদবি হতো না।’ ওমর তাকে আশ্বস্ত করলেন। তুমি কোনো ভুল করো নি। যাও! মদিনাবাসীকে আনন্দের খবর দিতে দিতে মসজিদে পৌঁছাও। 

ওমরের খেলাফতের ১০ বছর পার হয়েছে। তার বয়সও বেড়েছে। শাসনভুক্ত এলাকার বিস্তৃতিও বেড়েছে। এত মানুষের কল্যাণের দায়িত্ব! ন্যায়নিষ্ঠ ওমর এ চাপ আর নিতে পারছিলেন না। হজ করলেন। হজ থেকে ফেরার পথে এক উপত্যকায় থামলেন রাত্রি যাপনের জন্যে। অভ্যাসমতো দীর্ঘরাত তিনি কাটাতেন আল্লাহর ধ্যানে, ইবাদতে। আত্মনিমগ্ন অবস্থায় অনুভব করলেন, তার আল্লাহর কাছে ফিরে যাওয়া প্রয়োজন। তিনি কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করলেন, ‘হে আল্লাহ! আমাকে তোমার পথে নবীর নগরীতে শহিদ হওয়ার সুযোগ করে দাও। আমি এখন তোমার কাছেই আসতে চাই।’

হজ শেষে মদিনায় পৌঁছার কয়েকদিনের মধ্যেই মসজিদে নামাজরত অবস্থায় রোমান বংশোদ্ভুত এক অগ্নি-উপাসক তাকে পর পর কয়েকবার ছুরিকাঘাত করে। তিনি গুরুতর আহত হন। যখন আততায়ীর পরিচয় জানতে পারেন তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, যাক! মুখে কলেমা উচ্চারণকারী কেউ আমাকে আঘাত করে নি। আহত অবস্থায় তিনি পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের জন্যে ছয় জনের কাউন্সিল মনোনীত করেন। তিন দিন পর তিনি দুনিয়া ছেড়ে আল্লাহর কাছে ফিরে যান। আর দুনিয়ায় রেখে যান সত্য ও ন্যায়পরায়ণতার অমোচনীয় দৃষ্টান্ত।

এনএস/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি