পরীক্ষায় দুর্নীতির কারণ
প্রকাশিত : ২৩:০৩, ৬ মে ২০১৮
বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত। পরীক্ষায় দুর্নীতি তার মধ্যে সবচেয়ে বড় ব্যাধি। এ ব্যাধির প্রতিকার করতে না পারলে সমগ্র জাতিই ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে পড়বে এবং পরিণামে তা জাতির ধ্বংস ডেকে আনবে। আর সে জন্যই সমগ্র জাতি আজ পরীক্ষায় দুর্নীতি নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। আমরা জানি শিক্ষা হচ্ছে জাতির উন্নতি ও সংস্কৃতির হাতিয়ার। তাই শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজমান দুর্নীতির মূল শিকড় সমাজ দেহ থেকে সমূলে উৎপাটন করতেই হবে।
এখানে একটি কথা বলা আবশ্যক। সমাজের অন্যান্য সমস্যা থেকে শিক্ষা ব্যবস্থায় বিদ্যমান সমস্যাকে কোনক্রমেই পৃথক করে দেখলে চলবে না। পরীক্ষায় দুর্নীতি শুধু শিক্ষা ক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যার সাথে সম্পর্কিত নয়, এর সাথে সামাজিক দুর্নীতি ও জড়িত। একটি জাতির আশা আকাক্সক্ষা রূপায়নের অঙ্গীকার সাংবিধানিকভাবে ঘোষিত থাকে শিক্ষার মধ্যে। তাই শিক্ষাকে আমাদের অন্যতম মৌলিক অধিকার হিসাবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, একটি স্বাধীন দেশের চাহিদা মেটানোর মতো করে সমস্ত শিক্ষার ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো হয়নি।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা আগে যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। যদিও শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো জন্য ইতোপূর্বে স্যাডলার কমিশন, ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন, বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষা কমিশন, বাতেন কমিশন, মজিদ খানের শিক্ষা নীতি ইত্যাদি কমিশন গঠন করা হয়েছিল। তবে ড. কুদরত-ই-খুদার নেতৃত্বে যে শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়েছিল, সেই কমিশন রাষ্ট্রীয় চার নীতি বাস্তবায়নের আলোকে একটি জীবনমুখী শিক্ষা নীতি প্রণয়ন করেছিল। কিন্তু সেই শিক্ষানীতির কিছু কিছু অংশ বাস্তবায়িত হলেও মূল নীতিকে বিসর্জন দিয়ে বিভিন্ন সময়ে শিক্ষা কমিশন গঠন করে শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি স্থায়ী জটিলতার সৃষ্টি করা হয়েছে। আর রাষ্ট্রীয় মূলনীতির আলোকে যেহেতু শিক্ষানীতি ঘোষিত হয়নি সেহেতু শিক্ষা ব্যবস্থায় ও নানাবিধ সমস্যার উদ্ভব হচ্ছে, যার প্রমাণ পরীক্ষায় দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার। সুতরাং পরীক্ষায় দুর্নীতির মূলোচ্ছেদ করতে হলে আমাদের জাতীয় প্রয়োজন মেটানোর আলোকে জাতীয় শিক্ষানীতি ঘোষণা করতে হবে।
দুর্নীতির ঢল নেমেছে আমাদের চারপাশে। সামাজিক অরক্ষয় মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে সমাজের প্রতিটি স্তরে। যেহেতু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সমাজেরই অংশ, তাই সমাজের ব্যাপক দুর্নীতির ছোঁয়া এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও লেগেছে এবং শিক্ষার্থীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ও দুর্নীতির বিষবৃক্ষ রোপণ করে চলছে। আর সেই দুর্নীতিতে শুধু শিক্ষার্থীদের ভ‚মিকাই থাকছে না। ভ‚মিকা থাকছে শিক্ষকের এবং অভিভাবকেরও। পরীক্ষায় দুর্নীতি করতে গিয়ে শিক্ষক বহিষ্কৃত হচ্ছেন। অভিভাবকরা পুলিশের তাড়া খাচ্ছেন, পরীক্ষার সময় এ তো প্রতি বছরের সংবাদ শিরোনাম। শিক্ষায়তনে এবং সারা দেশে যখন রাজনৈতিক ও নৈতিক নৈরাশ্য চলে তখন শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সততা আশা করা বাতুলতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
আমরা সমাজের প্রতিটি স্তরেই দেখছি সহজভাবে প্রতিষ্ঠা লাভের প্রতিযোগিতা। অনেকেই অন্যায়ভাবে সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভের সিঁড়িটি ব্যবহার করে সমাজের কর্তাব্যক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে সমাজের নৈতিক ভারসাম্যকে পদদলিত করে নৈতিকতার উপদেশ বিতরণ করে চলছেন। আর এই অন্যায়ভাবে সমাজে প্রতিষ্ঠালাভের সিঁড়িটি আমাদের শিক্ষার্থীরা চোখের সামনে দেখছে, যার ফলে তারা খুব সহজে পরীক্ষায় দুর্নীতি করে সনদপত্র লাভের সিঁড়িটি অতিক্রম করতে চায়। তাদের মধ্যে জ্ঞানের কোন মাদকতা নেই। আজকাল প্রতি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের যে হিড়িক পড়েছে, তাতে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার আগের রাতে কিছু প্রশ্নের উত্তর কেটেছেঁটে হলে নিয়ে যায়, তাদের আকাক্সিক্ষত ফল লাভের আশায়। তাদের মধ্যে বিবেকের কোন দংশন নেই। যদি এ থেকে আমাদের উত্তরণ না ঘটে তবে জাতি হিসাবে, দেশ হিসাবে আমরা আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত এ দেশের স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে পড়বে। মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর মতো কোন হাতিয়ার আর আমাদের থাকবে না।
শিক্ষাক্ষেত্রে এরূপ একটি ভারসাম্যহীন অবস্থার মধ্যে গুটিকয়েক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করে না। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিন্ন ধাঁচের, তাদের শিক্ষা পদ্ধতি, শিক্ষার্থী বাছাই ভিন্নমাপের, জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনার সাথে এগুলোর কোন মিল নেই। পাঠক্রমের মিল থাকলেও তাদের পড়াশুনার ভিত ভিন্নভাবে গঠিত হয়ে থাকে। এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে ক্যাডেট কলেজ, রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল বা কলেজ এবং বড় বড় শহরে অবস্থিত কিছু বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এছাড়া কিছু কিছু সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঐতিহ্যগতভাবে ভালো ফল দেখতে পারে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে ভালো ফল লাভ করে জীবনযুদ্ধে জয়ী হয়। অন্যদিকে দুর্নীতির আশ্রয়ে সনদপত্রধারী বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী জীবনযুদ্ধে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে, সমাজের বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। তাই বিভিন্ন মানের, ধাঁচের ও পদ্ধতির শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিলুপ্ত করে একই মানের, একই পদ্ধতির শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি ভারসাম্য পরিবেশ সৃষ্টি হবে এবং হতাশা দূর হয়ে প্রতিযোগিতার সুযোগ খুলে যাবে। তখন শিক্ষাকে পণ্য হিসাবে বেচাকেনার কোন সুযোগ থাকবে না। তাই পরীক্ষার দুর্নীতি বোধ করতে হলে একই মানের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা উচিত। এছাড়া আমাদের পাঠক্রমও শিক্ষার্থীর মেধানুযায়ী প্রণয়ন করা হয় না। শিক্ষার্থীদের ওপর অনেক সময় অতিরিক্ত বিষয় চাপিয়ে দেয়া হয়। এতে করে শিক্ষার্থীরা তাদের পাঠক্রম নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করতে পারে না। শিক্ষার্থীরা অসহায় হয়ে পড়ে এবং পরীক্ষায় দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করে।
এদেশে একই পাঠ্যক্রমের আওতায় দুটি ধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে। একটি ধারায় সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অন্য ধারায় বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। দুটি ধারায়ই সুযোগ সুবিধার ব্যাপক বৈষম্য বিদ্যমান। তাই পরীক্ষার দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে সরকারকে পর্যায়ক্রমে জাতীয় শিক্ষানীতির আওতায় সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থাকেই জাতীয়করণ করতে হবে এবং সেই লক্ষ্য পূরণের জন্য ইউনেস্কোর সুপারিশ অনুযায়ী জাতীয় আয়ের ৭ শতাংশ অথবা জাতীয় বাজেটের ৩০ শতাংশ শিক্ষাখাতে ব্যয় করতে হবে। আমরা জানি শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে উন্নত সমাজ ও সংস্কৃতি নির্মাণ। এরূপ উন্নত সমাজ ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে প্রত্যেকেই তার যোগ্যতা ও মেধা অনুযায়ী কাজ পাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বর্তমান সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর আওতায় কোন পরিকল্পিত কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই। আছে শুধু হতাশা ও শূন্যগর্ভ ভবিষ্যৎ। তাই জ্ঞান অর্জনের প্রতি শিক্ষার্থীদের কোন স্পৃহা নেই, যেনতেনভাবে পরীক্ষায় দুর্নীতির মাধ্যমে একটি সনদপত্র লাভই তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। আমি আমার লেখার একপর্যায়ে উল্লেখ করেছি, একই ধাঁচের শিক্ষাব্যবস্থা এ দেশে চালু নেই। এটা অত্যন্ত উদ্বেগের ব্যাপার যে, বড় বড় শহরে একশ্রেণির এলিট গোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বিশেষ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে এবং সেখানে শিক্ষা অন্যান্য শিল্পপণ্যের মতো বেচাকেনা হচ্ছে। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে যারা দুর্নীতির জন্ম দিচ্ছে, তারা শিক্ষার মতো একটি উন্নত জাতি গঠনমূলক হাতিয়ারকে পাংশু করে দেয়ার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। শিক্ষার মতো একটি মৌলিক অধিকারকে এভাবে খণ্ডিত করার কোনো যুক্তি নেই।
প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন, আমাদের ছাত্রসমাজের একটি সমৃদ্ধ অতীত রয়েছে। তারা ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সংগ্রামে এক গৌরবদীপ্ত ভ‚মিকা রেখেছে, যার ফলে আমরা একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ পেয়েছি। তাই ছাত্রদের উচিত স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে দুর্নীতিমুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্ত করে দেশ গঠনে আত্মনিয়োগ করা।
শিক্ষা হচ্ছে একটি জাতির জীবনীশক্তি, মানবদেহকে পচনের হাত থেকে বাঁচাতে আমরা যেমন দেহের জীবনীশক্তিকে চিকিৎসার মাধ্যমে সতেজ রাখি, তেমনি একটি জাতিকে বাঁচানোর জন্য শিক্ষা নামক জীবনীশক্তিকে অবশ্যই সতেজ রাখতে হবে। তবেই শিক্ষার্থীর সুপ্ত জ্ঞানের আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ পুনর্বার উন্মুক্ত হবে এবং সেই জ্বালামুখ থেকে নির্গত ও উপ্ত গলিত লাভা সমাজের অসাম্যতা পংকিলতা অন্যায় অত্যাচার অনাচার দলিত মথিত করে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডল গঠন করবে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, সৈয়দ সঈদ উদ্দিন ডিগ্রী কলেজ; ব্যাচ-১৯৮২
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।