ঢাকা, সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

পাঁচটি প্রশ্নের জবাব না দিয়ে এক পা-ও নড়তে পারবে না!

নাজমুশ শাহাদাৎ

প্রকাশিত : ১৬:১৭, ১২ মে ২০২০ | আপডেট: ১৬:২০, ১২ মে ২০২০

শয়তান আমাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শত্রু। সে আমাদের আক্রমণ করে আক্রান্ত করতে গিয়ে প্রথমে আমাদের নফসকেই ধরে ফেলে। তাই প্রথমে আমাদের নিজেদের ভিতরের শয়তানকে মেরে ফেলা উচিত। যখন কোন ভালো কাজে মন বসে না, কষ্ট অনুভূত হয়, তখনই বুঝতে হবে শয়তান আমাকে কব্জা করে ফেলেছে, পেয়ে বসেছে। তাই সেই শয়তানকে হটাতে তখন বেশি বেশি করে ভালো কাজ করা উচিত, নফল ইবাদত, কুরআন-হাদিস পড়া, দান সদকা, অপরের উপকার করা, ভালো ভালো কথা বলা উচিত। 

কেননা, মানুষ মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি, তাই মানুষ স্বভাবতই অন্য সব সৃষ্টি থেকে যেমন উত্তম, তেমনি শয়তানের থেকেও শ্রেষ্ঠ। সে কখনোই শয়তানের কাছে পরাজিত হতে পারেনা। তাই প্রতিটি মুহূর্তে শয়তানকে পরাজিত করার জন্য লড়াই করাই মানুষের কাজ। 

আমাদের মধ্যে বেশিরভাগই এসবই জানি, কিন্তু মানি না। কিন্ত মনে রাখতে হবে, শুধু জানার নাম ইসলাম নয়, জেনে মানার নামই ইসলাম। আর জেনে না মানাটা হলো সবচেয়ে বড় অধর্ম, অ-ইসলামিক বা বড় অপরাধ।

সেই মহান আল্লাহকেই ভয় করা উচিত আর কাউকে নয়, যিনি অন্তরের খবর রাখেন। প্রতিটি মুহূর্ত জিনি জানেন দেখেন এবং প্রতিটি মুহূর্তেরই হিসেব তিনি নিবেন। কেননা আমরা প্রকাশ্যে বা গোপনে যা কিছু করছি সব কিছুই লিপিবদ্ধ হচ্ছে। সব কিছুরই পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেব নেয়া হবে- সেই মহান বিচারের দিনে। তখন এই চোখ, কান, মুখ, হাত-পা, আঙুল সবই স্বাক্ষী দিবে আমার-আপনার বিরুদ্ধে। 

আমরা অনেকেই শুধু নামাজ পড়ি। রমজান মাস আসলে রোজা রাখি। আর মনে করি, এতেই আমার সব কাজ শেষ! এর বাইরে অন্যান্য সময় আমরা বিভিন্ন ভালো-মন্দ কাজে ব্যয় করি। 

কিন্তু দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে তো অল্প কিছু সময় ব্যয় হয়, বাকি সময়গুলো কি কাজে ব্যয় হচ্ছে তা হিসেব করে দেখা উচিত। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টায় যদি ৭ ঘণ্টা ঘুমিয়ে কাটাই, নামাজে না হয় এখন সব মিলিয়ে দুই থেকে আড়াই ঘন্টা চলে যায়। আর অন্যান্য কাজে না হয় আরো ৮ ঘণ্টা, বাকি সাড়ে ৬ ঘন্টার হিসেব কই? এই সময়টা আমি কিভাবে কাটাই সেটা একবার ভেবে দেখা উচিত। পর্যালোচনা করা উচিত। 

এই সময়ের হিসেব নিয়ে কিয়ামতের দিন প্রত্যেক মানুষকে পাচঁটি কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। এ সম্পর্কে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) নবী করিম (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, কিয়ামতের দিন আদম সন্তানকে পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এক কদমও স্ব-স্থান হতে নড়তে দেওয়া হবে না। তা হলো- ১) তার জীবনকাল কিভাবে অতিবাহিত করেছে, ২) যৌবনের সময়টা কিভাবে ব্যয় করেছে, ৩) ধন সম্পদ কিভাবে উপার্জন করেছে, ৪) এবং তা কিভাবে ব্যয় করেছে, ৫) সে দ্বীনের (ইসলাম) যতটুকু জ্ঞান অর্জন করেছে সেই অনুযায়ী আমল করেছে কিনা বা কতটুকু করেছে।

আমরা জানি, জীবন মূলত কতগুলো মুহূর্তের সমষ্টি। জীবন ও মৃত্যু আল্লাহর একক নিয়ন্ত্রণে। এর মাধ্যমে তিনি মানুষকে পরীক্ষা করেন। কে সৎ কাজ করে আরকে অসৎ পথে জীবন ব্যয় করে। পরীক্ষার জন্যে যে জীবন নির্দিষ্ট, তা যেনতেনভাবে ব্যয় করার সুযোগ নেই। আর আল্লাহকে সন্তুষ্ট করতে না পারার পরিণতি যে ভয়াবহ হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

দ্বিতীয় প্রশ্ন- যৌবনের শক্তি ও যোগ্যতা কোথায় ব্যয় করা হয়েছে- এ প্রসঙ্গে। বলা চলে, যৌবন হচ্ছে জীবনের বসন্ত কাল। যে কেউ যৌবনের শক্তি ও যোগ্যতা কাজে লাগিয়ে মানবতার কল্যাণে অনেক কিছু করতে পারে। আবার এই শক্তিকে জুলুম অত্যাচার-অনাচার সৃষ্টিতে লাগাতে পারে। অনেকে ধারণা করে জীবন ও যৌবনে অনাচার করলেও বুড়ো বয়সে নেক কাজে আত্ম নিয়োগ করব। এমন আশা পোষণের কোনো মূল্য নেই। কারণ, আগামীকাল বেঁচে থাকার কোনো গ্যারান্টি কারও নেই। পক্ষান্তরে যৌবনকাল বিষয়ে যেহেতু প্রশ্ন হবে, তাই তা চলে যাওয়ার আগেই সবাইকে সর্তক হতে হবে।

এ বিষয়ে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা পাঁচটি বিষয়কে অপর পাঁচটি বিয়ষের পূর্বে গুরুত্ব প্রদান করো- ১. যৌবনকে বার্ধক্য আসার আগে। ২. সুস্থতাকে রোগাক্রান্ত হওয়ার আগে। ৩. সচ্ছলতাকে দরিদ্র হওয়ার আগে। ৪. অবসরকে ব্যস্ত হওয়ার আগে। ৫. হায়াতকে মৃত্যু আসার আগে। -তিরমিজি।

তৃতীয় ও চতুর্থ প্রশ্নে বলা হয়েছে, মালসম্পদ কোথায় হতে উপার্জন করেছ এবং কোথায় ও কিভাবে তা ব্যয় করেছে? জ্ঞানীরা বলেছেন, দুনিয়ার মোহ মানুষের স্বভাব জাত। কোরআনে কারিমে সূরা আদিয়াতের ৮ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘অব্যশই মানব হৃদয়ে সম্পদের মোহ অতি প্রবল।’

অর্থাৎ- সম্পদ মানুষের জীবনের অপরিহার্য এক বিষয়। এটা ছাড়া জীবনের এক দিনও অতিবাহিত করা যায় না। কিন্তু এর একটি সীমা আছে। আল্লাহতায়ালা ধনসম্পদ উপার্জন ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে কিছু বিধি-বিধান বর্ণনা বলে দিয়েছেন। যেমন ব্যবসাকে হালাল করেছেন আবার সুদকে হারাম করেছেন। ইসলামের এ বিধানগুলো রক্ষা করে চলতে হবে। হালাল পথে উপার্জন করে হালাল পন্থায় খরচ করতে হবে।

শেষ প্রশ্ন করা হবে- অর্জিত জ্ঞানের কতটুকু আমল করা হয়েছে এ বিষয়ে। বলা হয়, যে জ্ঞানী তার অর্জিত জ্ঞানের ওপর আমল করে না সে জ্ঞানকে অসম্মানিত করে। এখানে ইলম বলতে অহির জ্ঞানকে বুঝানো হয়েছে। সমাজের প্রতিটি রন্ধ্রে আজ যে অবক্ষয় মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এর মূলে রয়েছে মানুষের অর্জিত জ্ঞান অনুযায়ী আমল না করা। হাদিসে এ সম্পর্কেই বলা হয়েছে। বস্তুত শুধু জানাটাই মুক্তি নয় বরং মানায় মুক্তি। কিয়ামতেও প্রশ্ন হবে জানার কতটুকু মানা হয়েছে এ বিষয়ে। আমলকে মিজানের পাল্লায় তোলা হবে এবং এর ওপর জান্নাত-জাহান্নামের ফায়সালা হবে।

হাদিসের শিক্ষা 
১. কিয়ামত একটি কঠিন ও ভয়াবহ দিন। সমগ্র সৃষ্টি ওই দিন আল্লাহর কাছে হাজির হবে। ন্যায় ও অন্যায়ের বিষয়ে বিচার করে আর জান্নাতি ও জাহান্নামি কারা তা ঘোষণা হবে।

২. যে প্রশ্ন হাশরের মাঠে হবে। এর প্রস্তুতি দুনিয়ার জীবন থেকে মৃত্যুর আগেই শেষ করতে হবে। নতুবা তখন আফসোস করে কোনো লাভ হবে না।

৩. জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান ও আল্লাহর দান। একে অপচয় করা যাবে না, জীবনকে সঠিক পথে ব্যয় করতে হবে।

৪. যৌবনকে জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান অংশ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। যাবতীয় সীমা লঙ্ঘন ও পাপাচার থেকে দূরে থাকতে হবে।

৫. জীবন পরিচালনায় হালাল রুজি অন্বেষণ করা গুরুত্বপূর্ণ ফরজ। হারামের রাজপথ ছেড়ে দিয়ে হালালের কণ্টকাকীর্ণ গলিপথে চলিতে হবে।

৬. কোনো অবস্থায় হারামের পথে মাল-সম্পদের এক কণাও ব্যয় করা যাবে না।

৭. জ্ঞান শুধু অর্জন করাই সার্থকতা নয় বরং অর্জিত জ্ঞানকে আমলে রূপান্তর করাই সফলতা। সফলতার ফায়সালা হবে আমলের ওপর।

বর্ণিত প্রশ্নের আলোকে আমাদের সবার জীবন গড়ে তোলা দরকার। কারণ, এক একটি প্রশ্নের মধ্যে সমগ্র জীবন রয়েছে। প্রতিদিন নিজে নিজে হিসেব করা উচিত। আজ কতটা সময় আমি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ব্যয় করলাম, কতটা সময় ভালো কাজে ব্যয় করলাম। আমাদের এমন কাজ করা উচিত নয়, এমন কিছুতে সময়, অর্থ বা অন্যকিছু ব্যয় করা উচিত নয়, যাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি নেই।

এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনের সূরা আনআম-এর ১৬২ নং আয়াতে মহান আল্লাহ তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের উপায় বাতলে দিতে গিয়ে বলেন, ‘হে নবী আপনি বলুন, নিশ্চয়ই আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ সারা জাহানের রব মহান আল্লাহরই জন্য।’

এটি অতি তাৎপর্যপূর্ণ একটি আয়াত। আল্লাহ তাআলা এ আয়াতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ আদেশ দিয়েছেন যে, ‘আপনি বলুন, আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ সারা জাহানের রব আল্লাহর জন্য।’

এনএস/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি