পাটপণ্যের ব্যবহারে সরকারকে ভূমিকা রাখতে হবে
প্রকাশিত : ১৬:১৯, ৩ অক্টোবর ২০১৭ | আপডেট: ২১:২৩, ৭ অক্টোবর ২০১৭
পাট ও পাটজাতপণ্য ব্যবহার নিশ্চিতকরণে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় তৎপর হয়ে ওঠেছে। সর্বক্ষেত্রে পরিবেশ বান্ধব পণ্য হিসেবে পাটের বহুমুখী ব্যবহার করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থার কাছে পত্র লিখে সহায়তা কামনা করেছে। এদিকে সিনথেটিক পণ্য বিশেষ করে নিষিদ্ধ ঘোষিত পলিথিন ব্যাগে দেশের হাট-বাজার সয়লাব হয়ে আছে। দেদারছে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার হলেও সেদিকে কারো নজর নেই, নেই এর বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোন তৎপরতাও। শুধু বস্ত্র ও পাটমন্ত্রণালয়ের একার পক্ষে হাটবাজার ও শপিংমলকে সিনথেটিক পণ্যমুক্ত করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের ভূমিকা অপরিহার্য।
পাটজাত পণ্য ব্যবহারে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে ডিসি-ইউএনও ও জনপ্রতিনিধিরা (এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান, সিটি মেয়র-কাউন্সিলর, পৌর মেয়র-কাউন্সিলর, ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বার) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। এক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় অবদান রাখতে পারে। পাটজাত পণ্যকে জনপ্রিয় করে তুলতে শিক্ষামন্ত্রণালয় সবচেয়ে ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখতে পারে। পাটজাত পণ্যের ব্যবহার ও গুরুত্ব সম্পর্কিত প্রবন্ধ স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করলে নতুন প্রজন্ম দেশীয় পণ্য বিশেষ করে পাটজাত পণ্য ব্যবহারে আগ্রহী ও অনুপ্রাণিত হবে।
“দেশীয় পণ্য, কিনে হও ধন্য”- এ শ্লোগানে সর্বস্তরের জনগণকে সামিল করতে সরকারকে সর্বাত্মকভাবে কাজ করতে হবে। এ ব্যাপারে তথ্যমন্ত্রণালয় পাটজাত পণ্যকে জনগণের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে এর ফলাওভাবে প্রচারের জন্যে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে কাজে লাগাতে পারে। দেশের সর্বসাধারণ যদি পাটজাত পণ্য ব্যবহারে এগিয়ে আসে, সিনথেটিক পণ্যের জায়গা যদি পাটজাত পণ্য দখল করতে পারে তাহলে আদমজী জুট মিলসসহ বন্ধ সব পাটকল চালু করা যাবে। এতে করে প্রচুর লোকের কর্মসংস্থান হবে। পলিথিন ব্যাগ ফ্যাক্টরিগুলো বন্ধ করে দিয়ে সেখানকার শ্রমিক-কর্মচারিদের পাটকলে নিয়োগ ও পদায়নের ব্যবস্থা করা যাবে। পাটজাত পণ্যের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার যদি চাঙ্গা হয় তাহলে আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে ডাবল ডিজিট প্রবৃদ্ধি অর্জনের যে স্বপ্ন রয়েছে তা সহজে পূরণ হতো।
আমাদের দেশের অন্যতম কৃষিজাত অর্থকরী ফসল হচ্ছে পাট। তাই এটিকে ‘স্বর্ণসূত্র’ বলা হয়। স্বাধীনতার পর বিশ্বের উৎপন্ন পাটের আশি ভাগই বাংলাদেশ উৎপাদন করতো। পাট নিচু জমিতে খুব ভালো জন্মে। যে দেশের ভূমি নিচু, সে দেশে পাট বেশি জন্মে। বর্তমানে আমেরিকা ও মিশরেও কিছু কিছু পাট উৎপন্ন হচ্ছে। কিন্তু তার পরিমাণ অতি নগণ্য। বাংলাদেশের পাটের মতো উৎকৃষ্ট মানের পাট পৃথিবীর অন্য কোনো স্থানে জন্মে না। পাট শিল্প গড়ে তোলার সম্ভাব্য সব উপাদান বিদ্যমান থাকলেও ১৯৫০ সাল পর্যন্ত এ অঞ্চলে কোনো পাটকল গড়ে ওঠে নি।
১৯৫১ সালে এক হাজার তাঁত নিয়ে নারায়ণগঞ্জের আদমজীনগরে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রথম পাটকল। এটি পৃথিবীর বৃহত্তম পাটকল। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, লোকসানের অজুহাতে ২০০২ সালে সরকার বিশ্বের এ বৃহত্তম আদমজী জুট মিলস্ বন্ধ করে দেয়। পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হতো বলেই একে ‘স্বর্ণসূত্র’ বা ‘সোনালী আঁশ’ বলা হতো। একসময় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগ অর্জিত হতো এ পাট থেকে। তবে নানাকারণে বিশ্বব্যাপী পাটের চাহিদা কমে যাওয়া, ব্যাপক পরিমাণে কৃত্রিম তন্তুর আবির্ভাব ও পাটের মূল্য কমে যাওয়ায় চাষীরা পাট চাষে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। দেশের পাটকলগুলো একের পর এক বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। এ অবস্থায় পাটের সনাতনী ব্যবহার ছেড়ে বহুমুখি পাটপণ্য উৎপাদন, ব্যবহার এবং বিপণনের ধারণা আসে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে বন্ধ পাটকলগুলো চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। পাশাপাশি পাট সেক্টরকে লাভজনক করার জন্যে নানামুখি উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। শতোভাগ দেশীয় কাঁচামাল ব্যবহার করে উৎপাদন ও রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে পাট পণ্য উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরিবেশ রক্ষার্থে সিনথেটিক পণ্যের ব্যবহার কমিয়ে প্রাকৃতিক তন্তুজাত পণ্যের ব্যবহারে গুরুত্ব প্রদানের কারণেই আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে বহুমুখী পাটপণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পাট ও পাটজাত পণ্য পরিবেশবান্ধব। চারা গজানো থেকে আঁশ সংগ্রহ পর্যন্ত প্রায় ১২০ দিন জমিতে থাকে। এ ১২০ দিন বায়ুমণ্ডলে প্রতিনিয়ত নিঃসরিত ১২ মেট্রিক টন কার্বনডাই অক্সাইড শোষণ এবং ১১ মেট্রিক টন অক্সিজেন সরবরাহ করে থাকে। পাটগাছের শেকড় থেকে শুরু করে প্রতিটি অংশই গুরুত্বপূর্ণ। পাট পঁচে মাটিতে পরিণত হলে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়। প্রতি একর জমিতে ঝড়েপড়া পাটের পাতা থেকে প্রায় ২.৫ টন জৈবসার পাওয়া যায়।
বর্তমানে দেশে প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ লাখ প্রান্তিক চাষী এবং বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশন (বিজেএমসি), বাংলাদেশ জুটমিলস্ এসোসিয়েশন (বিজেএমএ), বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স এসোসিয়েশন (বিজেএসএ) এর প্রায় এক লাখ ৬৬ হাজার শ্রমিকের জীবিকা ও কর্মসংস্থান পাট উৎপাদন ও পাটশিল্পের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। এ ছাড়াও বহুমুখি পাটপণ্য উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থার সাথে আরো প্রায় ৭০ হাজার লোক জড়িত রয়েছে। পাটখাতকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে বহুমুখি পাটজাত পণ্যের বিকল্প নেই। তাই দেশের পাটকলগুলো এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শ্রেণির উদ্যোক্তা বহুমুখি পাটপণ্য উৎপাদনে এগিয়ে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় প্রচলিত পাটপণ্যের পাশাপাশি বহুমুখি পাটপণ্য উৎপাদনে এবং বিদেশে তা রপ্তানি ও দেশের বাজারে বিপণনের জন্যে সরকারিভাবে বিজিএমসি বেসরকারিভাবে বিজিএমএ ও বিজিএসএ এর সদস্যভূক্ত কিছু মিল এবং এ মন্ত্রণালয়াধীন জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার (জেডিপিসি) এর উদ্যোক্তারা কাজ করে যাচ্ছে।
বর্তমানে যেসব বহুমুখি পাটপণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করা হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- পাটের তৈরি কাগজ, অফিস আইটেম বিশেষ করে বিজনেস কার্ড, ফাইলকভার, ম্যাগাজিন হোল্ডার, কার্ডহোল্ডার, পেপারহোল্ডার, বক্সফাইল, পেনহোল্ডার, টিস্যুবক্স কভার, ডেক্স কেলেন্ডার ইত্যাদি। এছাড়া বিভিন্ন প্রকার ব্যাগ যেমন- সেমিনার ব্যাগ, ল্যাপটপ ব্যাগ, স্কুলব্যাগ, লেডিস পার্ট, ওয়াটারক্যারি ব্যাগ, মোবাইল ব্যাগ, পাসপোর্ট ব্যাগ, ভেনিটি ব্যাগ, শপিং ব্যাগ, গ্রোসারি ব্যাগ, সোল্ডার ব্যাগ, ট্রাভেল ব্যাগ, সুটকেস, ব্রীফকেস, হ্যান্ড ব্যাগ, মানি ব্যাগ ইত্যাদি। পাটের সূতা, নার্সারী আইটেম- জুটটেপ, নার্সারী সীট ইত্যাদি, হোম টেক্সটাইল- বেডকভার, কুশনকভার, সোফাকভার, কম্বল, পর্দা, টেবিল রানার, টেবিল ম্যাট, কার্পেট, ডোরম্যাট, শতরঞ্জি ইত্যাদি। পরিধেয় বস্ত্র, ব্লেজার, ফতোয়া, কটি, শাড়ি ইত্যাদি এবং বিভিন্নধরনের সোপিস। এসব পণ্যসামগ্রির বেশকিছু পণ্য বিদেশের বাজারে রপ্তানি হচ্ছে। কিন্তু দেশীয় বাজারে এসব পণ্যের বাজার খুবই সীমিত। ফলে এ খাতে উদ্যোক্তারা কাঙ্খিত সুবিধে পাচ্ছেন না।
চাহিদা অনুযায়ী নতুন পাটজাত পণ্য উদ্ভাবনে প্রতিনিয়ত নানামুখি উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। সম্প্রতি উদ্ভাবিত ও ফিল্ডট্রায়ালে সফলভাবে পরীক্ষিত জুট জিও- টেক্সটাইলস্ (জেজিটি) পণ্যটি সম্পন্ন পাট দ্বারা তৈরি এক ধরনের কাপড়। নদীরপাড় ভাঙ্গন, পাহাড়ের ভূমিধস রোধ ও মাটির ক্ষয়রোধে জুট জিও- টেক্সটাইলস্ ব্যবহার করা হয়। ইতোমধ্যে জুট জিও-টেক্সটাইলস্ এর মাধ্যমে ৫টি রাস্তা, ৩টি নদীরপাড় ভাঙ্গনরোধ এবং ২টি পাহাড়ধস রোধসহ মোট ১০টি ফিল্ডট্রায়াল সম্পন্ন করা হয়েছে। ঢাকার হাতিরঝিল প্রকল্পেও এটি ব্যবহৃত হয়েছে। জুট জিও- টেক্সটাইলস্ এর ব্যবহার বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর স্পেশাল ওয়ার্কস অর্গানাইজেশন নদীরপাড় সংরক্ষণ ও পাহাড়ধস রোধসহ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে জাতীয় স্বার্থে ব্যাপকভাবে জুটজিও-টেক্সটাইলস্ ব্যবহার করতে পারে।
“দেশীয় পাটপণ্য, কিনে হও ধন্য”-এ শ্লোগানকে সামনে রেখে আমাদের মন্ত্রী- এমপি ও সকল পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিরা যদি নিজেরা পাটজাত পণ্য ব্যবহার করেন এবং সভা-সমাবেশ ও বিভিন্ন ফোরামে বক্তৃতা-বিবৃতিতে দিয়ে পাটজাত পণ্য ব্যবহারে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেন তাহলে পাটপণ্য অবশ্যই দিনে দিনে জনপ্রিয় হয়ে ওঠবে। জনগণ পাটপণ্যের ব্যবহারে আগ্রহী হয়ে ওঠবে। প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের মন্ত্রী-এমপিরা পাটপণ্য নিয়ে কতটুকু আন্তরিক ও সরব। নিজ মন্ত্রণালয় বহির্ভূত নানা বিষয়ে প্রতিদিন মন্ত্রীরা বহুকথা বলেন কিন্তু পাট ও পাটজাত পণ্য নিয়ে মন্ত্রীদের কখনো কথা বলতে শোনা যায় না। জাতীয় প্রচার মাধ্যম পাটপণ্য নিয়ে খুব একটা মাতামাতি করে না। বিশেষ করে আমার ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া এ ব্যপারে সবচেয়ে ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখতে পারলেও অজ্ঞাতকারণে তা করছে না। জনগুরুত্বপূর্ণ এ বিষয় নিয়ে জাতীয় সংসদে গুরুত্বসহকারে আলোচনা হয় না। দেশের সব রাজনৈতিক দল পাটপণ্য নিয়ে প্রায় নীরব। সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোও পাটপণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা রাখছে না। সরকারের সকল মন্ত্রণালয় পাটপণ্যের ব্যবহারে সমন্বিতভাবে কাজ না করলে এর সুফল পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।
লেখক: প্রধানসম্পাদক, চাটগাঁর বাণী।
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।