ঢাকা, সোমবার   ২১ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

পাঠককে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখতেন হুমায়ূন অাহমেদ

প্রকাশিত : ২০:৩১, ১৩ নভেম্বর ২০১৮ | আপডেট: ২০:৪৮, ১৩ নভেম্বর ২০১৮

Ekushey Television Ltd.

হ‌ুমায়ূন আহমেদ সিনেমা বানাবেন, টাকা প্রয়োজন। হঠাৎ মনে হলো, সরকার যদি সাহায্য করে, তাহলেই তো হয়ে যায়। তিনি তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করলেন। মন্ত্রী সব শুনে বললেন, ‘আপনি লেখক মানুষ। ছবি বানানোর আপনি কী জানেন?’

: আমি কিছুই জানি না। তবে আমি শিখব।

: শিখে ছবি বানাবেন?

: জি।

: নিজের ওপর আপনার এত বিশ্বাসের কারণ কী?

হ‌ুমায়ূন আহমেদ এবার দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, ‘অন্যের ওপর বিশ্বাস করার চেয়ে নিজের ওপর বিশ্বাস করাটা ভালো না?’

নুহাশ পল্লীর ওষুধি বাগানে গাঁজাগাছ নেই। বৃক্ষমেলার বন বিভাগের স্টলে গাছ আছে জানতে পেরে হ‌ুমায়ূন আহমেদ কিনতে গেলেন। কিন্তু সেটা বিক্রির জন্য ছিল না, বিধায় তাকে গাছ না কিনেই ফিরে আসতে হলো। কিন্তু এর মধ্যেই ঘটনা বাতাসের বেগে ছড়িয়ে পড়ল। হ‌ুমায়ূন আহমেদ গাঁজাগাছ খুঁজছেন, জানতে পেরে দলে ভিড়েছেন মনে করে কেউ কেউ বিমলানন্দ পেলেন। আবার অনেকেই বাঁকা চোখে তাকাতে শুরু করলেন।

এর মধ্যে একদিন এক অভিনেতা অতি উত্সাহে দুটি গাঁজাগাছের টব হ‌ুমায়ূন আহমেদের বাসায় পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু বিধিবাম! নুহাশ পল্লীতে গাছ লাগানোর পরদিনই চুরি হয়ে গেল। হ‌ুমায়ূন আহমেদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘যে নিয়েছে তার প্রয়োজন নিশ্চয়ই আমার চেয়েও বেশি। সুতরাং কী আর করা!’

সাহিত্য আলোচনার আসরে এক কবি ও কথাসাহিত্যিক হ‌ুমায়ূন আহমেদের কাছে জানতে চাইলেন, ‘আপনার সব উপন্যাসই দেখি হয় চার ফর্মায়, নয় পাঁচ ফর্মায় কিংবা ছয় ফর্মায় শেষ হয়। এভাবে ফর্মা হিসাব করে কীভাবে আপনার মাথায় উপন্যাস আসে?’

প্রশ্নের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে হ‌ুমায়ূন আহমেদ বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে মুচকি হেসে বললেন, ‘ভাই, আপনি যে সনেটগুলো লেখেন, এগুলো তো চৌদ্দ লাইনে লেখেন। আপনার ভাব যদি চৌদ্দ লাইন মেনে আসতে পারে, আমার উপন্যাস ফর্মা হিসাবে এলে অসুবিধা কী?’

একবার এক ব্যক্তি হ‌ুমায়ূন আহমেদকে বললেন, অমুক তো আপনাকে একেবারে ধুয়ে দিয়েছে। আপনার লেখায় নাকি শিক্ষামূলক কিছু নাই। শুনে হ‌ুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘ঠিকই তো বলেছে, আমি তো পাঠ্যবই লেখি না!’ হ‌ুমায়ূন আহমেদ কেমন সরস ছিলেন তা সহজেই অনুমেয়। এমনকি ‘আমি রসিকতা পছন্দ করি না’ এই টাইপ কথা বলা গম্ভীর মানুষেরাও হ‌ুমায়ূন আহমেদের রসিকতায় অট্টহাসি হাসেন। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এমন কিছু নেই, যা নিয়ে রসিকতা করেননি তিনি।

ক্রিকেট নিয়ে, বিশেষ করে বাংলাদেশের খেলার সময় হ‌ুমায়ূন আহমেদের প্রবল উত্সাহ দেখে এক সাংবাদিক সাক্ষাৎকার নিতে এসেছেন। কিন্তু হ‌ুমায়ূন আহমেদ ক্রিকেট বিষয়ে বিজ্ঞ নন দেখে সাংবাদিক হতাশ হয়ে বললেন, ‘আপনি যে ক্রিকেট বোঝেন না, এটা কি লিখতে পারি?’

: অবশ্যই লিখতে পারো।

: কিছু না বুঝেও ক্রিকেট কেন পছন্দ করেন—একটু ব্যাখ্যা করবেন?

: কারণ, আমি গল্পকার।

: স্যার, একটু বুঝিয়ে বলুন।

: ক্রিকেটে এক ওভারে ছয়টি বল করা হয়। বল করা মাত্র গল্প শুরু হয়। নানান সম্ভাবনার গল্প। ব্যাটসম্যানকে আউট করার সম্ভাবনা, ছক্কা মারার সম্ভাবনা ইত্যাদি। ছয়টা বল হলো ছয়টা সম্ভাবনা—গল্পের সংকলন। এবার বুঝেছ?

জীবনকে দেখার এ চোখটা দারুণ ছিল হুমায়ূন আহমেদের।

হ‌ুমায়ূন আহমেদের বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ছিলেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা (পরে তিনি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন।) অসাধারণ একজন মানুষ ছিলেন। বাবাকে নিয়ে লেখক লিখেছেন, ‘আমার বাবা পৃথিবীর সব চেয়ে ভালো মানুষদের একজন কি না তা জানি না, তবে বিচিত্র একজন মানুষ, তা বলতে পারি।’

কতটা বিচিত্র, তার একটা উদাহরণ পাওয়া যায় লেখকের আমার ছেলেবেলা বইতে।

এক শীতকালের ঘটনা। ভোরবেলা মায়ের গলা শুনে ছোট্ট হ‌ুমায়ূনের ঘুম ভাঙে। টের পান, মা-বাবা কী নিয়ে যেন রাগারাগি করছেন। কান পেতে শুনতে পান, মা বারবার বলছেন, ‘ঘোড়া দিয়ে তুমি করবে কী? আমাকে বুঝিয়ে বলো, কে পুষবে এই ঘোড়া?’

বাবা বলেন, ‘এত রাগছ কেন? একটা কোনো ব্যবস্থা হবেই।’

আধো ঘুমে কথাগুলো শুনেই ছোট্ট হ‌ুমায়ূন বুঝল, একটা ঘোড়া কেনা হয়েছে! তড়াক করে বিছানায় লাফিয়ে বসল সে। তখন বাবা হাসিমুখে বললেন, ‘ঘরের বাইরে গিয়ে দেখে আয়, ঘোড়া কিনেছি।’

বাইরে গিয়ে লেখক দেখেছিলেন একটা অদ্ভুত দৃশ্য! সুপারিগাছের সঙ্গে বাঁধা বিশাল এক ঘোড়া। ঘোড়াটাকে তার কাছে মনে হয়েছিল আকাশের মতো বড়! ঘোড়াটা ক্রমাগত পা দাপাচ্ছে আর ফোঁসফোঁস শব্দ করছে।

ছেলেবেলায় অভাবে দিন কেটেছিল হ‌ুমায়ূন আহমেদদের। পরে বাবা সেই ঘোড়াটি বিক্রি করে দিয়েছিলেন।

আলমারিতে এখনও পকেট ছাড়া হলুদ পাঞ্জাবিটা সাজানো। আমরা তিন বন্ধু মিলে জোছনা দেখব হিমু হয়ে। তখন এই পাঞ্জাবীটা পড়ে সারারাত হিমু সেজে কাটালাম। ক্ষুধায় এর ওর কাছে চেয়ে খেয়েছিলাম। আবার শুয়ে শুয়ে জোছনা দেখা। অকারণে হেঁটে চলা। কি যে পাগলামি ছিল।

কৈশোরের সেই স্মৃতি বলে দেয় হুমায়ূন আহমেদ আমাদের কি পরিমান প্রভাবিত করেছিলেন ।

কোথাও কেউ নেই এর বাকের ভাই এর জন্য মিছিলে যাওয়া প্রথম। বাকের ফাঁসি হলে,জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে। কে কবে দেখেছে নাটকের চরিত্রের জন্য এই রুপ প্রতিক্রিয়া।

বাঙালির চিরকালীন আবেগ, এতটা হুমায়ুনময় যে জোছনা, সমুদ্র, বৃষ্টি বাঙালি ভাটির এই যাযাবরের চোখ দিয়েই দেখে।

জোছনায় শীতল পাটিতে এখনও বসে মানুষের অনুভুতিকে সহজভাবে মাটির মমতায় তুলে আনছেন, বাঙালির আবেগের চোখেএই ছবি মুছবেনা।

সব মিলিয়ে সব কিছুর পর বাঙালিকে বই পড়তে, বইয়ে আগ্রহী করতে যে নামটি সবার আগে, তিনি হুমায়ুন আহমেদ ।

আপনার জন্ম না হলে হয়তবা জানাই হতো না এখানে হাজার মানুষের কান্না আছে, সুখ আছে।
যে কান্না যে সুখ, যে আনন্দ বেদনা ছুঁয়ে যেতে পারে নিজেকেও। বইয়ের কয়েকটা কালির অক্ষর ভিজিয়ে দিতে পারে নিজের বালিশ, হাসিয়ে দিতে পারে নিজের অজান্তেই, শিহরিত করে দিতে পারে পুরো শরীর।

মূলত সাহিত্য এবং এর শাখা-প্রশাখা, টিভি নাটক, চলচ্চিত্র ইত্যাদি মিলিয়ে হুমায়ূনের বিশাল সৃষ্টিসম্ভার। তাকে বাঙালি জীবনের এক ‘কালচারাল ফেনোমেনন’-এ পরিণত করেছে। হুমায়ূন আহমেদের চার দশকব্যাপী বিস্তৃত সৃষ্টিশীল অধ্যায় কাল কি পুরোপুরি পাশ কাটিয়ে চলে যেতে পারে? পরপারে চলে যাওয়ার পর তিনি এখন একা, পুরোপুরি নিঃসঙ্গ। তাকে ঘিরে নেই ভক্ত-পাঠকের দল।

নেই তাঁর পাণ্ডুলিপি পাওয়ার জন্য প্রকাশকদের হুড়োহুড়ি। নেই পুলিশি পাহারায় বাংলা একাডেমীর একুশে বইমেলার কোনো ভক্তপিষ্ট স্টলে তার বসে থাকার দৃশ্য। তিনি সম্পূর্ণ একা। এখন শুরু হবে তার টিকে থাকা না-থাকার পরীক্ষা।

উনি বলা শুরু করেন, পাঠক মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার বলা গল্পের পিছু পিছু হাঁটতে থাকে। এক সময় কাহিনী শেষ হয়, কিন্তু থেকে যায় রেশ। হুমায়ূন আহমেদ চলে গেছেন কিন্তু হিমু, মিশির আলি আমাদের চোখের সামনে আজও ঘুরে বেড়াচ্ছে।

জন্মদিনে স্মরণ করি তোমায় বিনম্র শ্রদ্ধায় জীবনের অতুলনীয় রুপকার ।


লেখক: সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মী।

অা অা// এসএইচ/


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি