পারকিনসন’স রোগ ও এটি নিয়ন্ত্রণের কার্যকর উপায়
প্রকাশিত : ১৮:০৭, ৩০ এপ্রিল ২০২১ | আপডেট: ১৮:০৮, ৩০ এপ্রিল ২০২১
মানুষের মস্তিষ্ক এক বিস্ময়কর সৃষ্টি এবং মহাবিশ্বের সবচেয়ে জটিল জৈবিক কাঠামো। এটি দেহের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র এবং স্নায়ুতন্ত্রের অংশ, যার মধ্যে রয়েছে স্নায়ুু ও নিউরনের এক বিশাল নেটওয়ার্ক। তাই, মস্তিষ্কের যেকোন ক্ষতি বা ব্যাধি সারা শরীরে বিভিন্ন তীব্রতায় একাধিক প্রভাব ফেলতে সক্ষম; যেমন- স্মৃতি, সংবেদনশীলতা, ব্যক্তিত্বে এবং সাধারণ জীবনযাপনে প্রভাব ফেলতে পারে।
টিউমার, আলঝেইমার্স, পারকিনসন’স, স্মৃতিভ্রংশ, এএসএল (অ্যামিওট্রফিক ল্যাটারাল স্ক্লেরোসিস) সহ আরও অনেক মস্তিষ্কজনিত রোগ রয়েছে। বয়সজনিত নিউরোডিজেনারেটিভ ব্যাধির মধ্যে আলঝেইমার্স রোগের পরেই পারকিনসন’স রোগ বা ডিজিজ (পিডি) বেশি দেখা যায়। মস্তিস্কের যেসব স্নায়ুু কোষ বা নিউরন আমাদের চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করে, পিডির ফলে সেগুলো দুর্বল হয়ে যায় বা মরে যায়। স্বাস্থ্যকর নিউরন ডোপামিন নামক একটি রাসায়নিক তৈরি করে, যা শরীরের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের জন্য মস্তিষ্কের প্রয়োজন। আর অন্যদিকে, দুর্বল নিউরন কম ডোপামিন উৎপাদন করে।
পিডি সাধারণত ধীর ধীরে শুরু হয় এবং তারপর সময়ের সাথে বাড়তে থাকে। এর লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে কাঁপুনি, অনমনীয় মাংসপেশী, হাঁটাচলায় অসুবিধা, ভারসাম্য রক্ষায় অপারদর্শিতা, দুর্বল ভঙ্গি এবং শরীরের গতিবিধি ধীর হয়ে যাওয়া (ব্র্যাডিকাইনেসিয়া)। পিডি যেমন সময়ের সাথে বাড়তে থাকে, অন্যান্য লক্ষণসমূহ যেমন, কথায় অস্পষ্টতা বা আস্তে কথা বলা, চিবানো বা গিলতে সমস্যা, স্মৃতিশক্তি হ্রাস, কোষ্ঠকাঠিন্য, ঘুমের অসুবিধা, মূত্রাশয় নিয়ন্ত্রণ হ্রাস, উদ্বেগ, বিষণ্ণতা, শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে অক্ষমতা, যৌন সংক্রান্ত সমস্যা, গন্ধহীনতা এবং পেশিতে টান ইত্যাদি দেখা যায়।
পারকিনসন’স ফাউন্ডেশন অনুসারে, বিশ্বের এক কোটিরও বেশি মানুষের পিডি রয়েছে। ওয়ার্ল্ড হেলথ র্যাংকিং এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৮ সালে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, ২০১৮ সালে পিডির কারণে বাংলাদেশে ১,৩৬৩ জন মানুষ মারা গেছে।
পারকিনসন’স ফাউন্ডেশন অনুসারে, নারীর চেয়ে পুরুষদের পিডি হওয়ার সম্ভাবনা দেড় গুণ বেশি। বয়সের সাথে এই রোগের ঝুঁকি বাড়তে থাকে, তবে কারও কারও অল্প বয়সে যেমন- ৫০ বছর বয়সের আগেই এই রোগ ধরা পড়ে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পিডি বংশগত কারণে হয় না, তবে পরিবর্তিত জিনের কারণে কিছু মানুষের বংশগতভাবে এটি হতে পারে। হার্ভার্ড হেলথ পাবলিশিংয়ের মতে, অসংখ্য গবেষণায় দেখা গেছে যে, কীটনাশক, ভেষজনাশক এবং জৈব দূষণকারীতে ব্যবহৃত রাসায়নিকের সংস্পর্শে এলে যেকোন মানুষের পিডি হতে পারে। এছাড়া, মাথায় বারবার আঘাত পেলে পিডি হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বিজ্ঞানী এবং গবেষকরা এখন পর্যন্ত পিডির কারণ আবিষ্কার করতে পারেনি এবং এটি নিরাময়ের কোন স্থায়ী সমাধানও নেই। এই রোগটি ততোটা মারাত্মক নয়, তবে এটি শরীরে এবং স্বাভাবিক জীবনধারায় নানা জটিলতা সৃষ্টি করে, যা পরবর্তীতে মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
এই রোগ নিরাময়ের স্থায়ী সমাধান না থাকলেও জটিলতা হ্রাস এবং জীবনমান উন্নত করার জন্য এটি নিয়ন্ত্রণের উপায় রয়েছে। উপায়টি হচ্ছে ডিপ ব্রেইন স্টিমুলেশন (ডিবিএস)। ডিবিএস এমন একটি অস্ত্রোপচার পদ্ধতি, যা কম্পন, অনমনীয়তা এবং ব্র্যাডিকাইনেসিয়া কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। পিডির কম্পন চিকিৎসার জন্য ১৯৯৭ সালে প্রথম এই অস্ত্রোপচারের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। এটি সম্প্রতি বা দীর্ঘদিন মোটর জটিলতায় ভোগা রোগীদের চিকিৎ্সায়ও কাজে লাগতে পারে। ডিবিএস পিডি রোগীদের দৈনন্দিন জীবনের কার্যকলাপ সহজ এবং জীবনমান উন্নত করতে পারে, ওষুধের পরিমাণ কমাতে পারে এবং ওষুধ সম্পর্কিত জটিলতা নিরসনে কাজ করতে পারে।
ডিবিএস অস্ত্রোপচারে, ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং (এমআরআই) ব্যবহার করে এবং প্রক্রিয়া চলাকালীন মস্তিষ্কের কোষের ক্রিয়াকলাপ রেকর্ড করে, মস্তিষ্কের একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে ইলেকট্রোড বসানো হয়। অস্ত্রোপচারের পরে, আইপিজি স্থাপনের জন্য দ্বিতীয় আরেকটি প্রক্রিয়ার প্রয়োজন হয়। এটি একটি ইমপালস ব্যাটারি জেনারেটর (পেসমেকারের অনুরূপ)। যাদের অস্ত্রোপচার করা হয়, তাদের ডিভাইসটি বন্ধ বা চালুর জন্য একটি কনট্রোলার দেওয়া হয়।
পার্কিনসন’স ডিজিজ কোয়েশ্চিনিয়ার পিডিকিউ-৩৯ অনুসারে, ডিবিএস থেরাপি ১৩ থেকে ২৬ শতাংশ পর্যন্ত জীবনযাত্রার মান উন্নত করে, যেমন মানুষ অন্যদের মধ্যে কম বিব্রত বোধ করবে, সহজে চলাফেরা করতে পারবে, মন থেকে ভাল বোধ করবে এবং তাদের শারীরিক অস্বস্তি কম হবে।
শুধু ওষুধ যদি কার্যকরী প্রভাব না রাখে এবং রোগীর ওপর রোগের একই প্রভাব থাকে তাহলে পিডি রোগীদের চিকিতৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিৎ। ওষুধের প্রতিক্রিয়া থেমে যাওয়ার আগে এবং এর সাথে পিডি’র লক্ষণগুলো বেড়ে যাওয়ার আগেই এই চিকিৎসা পদ্ধতি বিবেচনা করার পরামর্শ দেওয়া হয়। এছাড়া, যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব পিডি সম্পর্কে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিৎ, কারণ মস্তিষ্কের যেকোন রোগ জীবনে মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
সতর্কীকরণঃ ‘বিবৃত প্রতিটি তথ্য ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালের (এনআইএনএস) অধ্যাপক (ক্লিনিক্যাল নিউরোলোজি) ডা. মোহাম্মদ শাহ জহিরুল হক চৌধুরীর নিজস্ব মতামত, যার উদ্দেশ্য সর্বসাধারণের মধ্যে তথ্য সঞ্চার ও সচেতনতা তৈরি করা।’
এসি