ঢাকা, বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪

ইতিহাসের অশ্রুবিন্দু

পিতার ভবনে অমৃতসদনে

শতরূপা দত্ত

প্রকাশিত : ১৪:৫১, ১৭ আগস্ট ২০১৮ | আপডেট: ২১:২৯, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২১

বাঙালির অনেক ইতিহাস জড়িয়ে আছে একটি ঐতিহাসিক বাড়ির সঙ্গে। জড়িয়ে আছে হাজারো সংগ্রামের ইতিহাস। একটি জাতির মুক্তির ইতিহাস। একটি দেশের জন্মের ইতিহাস। ’৬০ এর দশক থেকে সেই ছোট্ট বাড়িটি সাহস, দৃঢ়তা আর বিদ্রোহের প্রতীক হয়ে আছে বাংলার মানুষের কাছে। ধানমন্ডির লেকের ধারে ৩২ নম্বর সড়কে ৬৭৭ নম্বরধারী সেই বাড়িটি বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। বঙ্গবন্ধুকে জানতে হলে দেশের সব নাগরিককে একবারের জন্য হলেও এই ‘পিতার ভবনে অমৃতসদনে’ আসতে হবে।

১৯৬২ সালের সামরিক স্বৈরশাসক আইয়ুববিরোধী ছাত্র আন্দোলন, বাংলার মুক্তিসনদ ’৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাবিরোধী ’৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থান, ’৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন, ’৭১ সালের শুরুতে অসহযোগ আন্দোলনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বঙ্গবন্ধু নেতা-কর্মীদের সঙ্গে প্রেরণার বাতিঘর হয়ে মতবিনিময় করেছেন এই বাড়িতে বসেই। ৭ মার্চের সেই কালজয়ী ভাষণের রূপরেখাও তিনি তার মানসমুকুরে সাজিয়ে নিয়েছিলেন এ বাড়ির কনফারেন্স টেবিলে বসে। ২৩ মার্চ ১৯৭১ -এ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসের দিনটিতেই বিক্ষুব্ধ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয় এখানেই। যা, সঙ্গে সঙ্গেই ছড়িয়ে যায় সারা বাংলায়। স্বাধীনতোত্তর দিনগুলোতে স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবেও এ বাড়ি থেকেই বঙ্গবন্ধু তার রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম পরিচালনা করতেন।  ৩২ নম্বরের এই বাড়িটিতে তখনও দেশের সাধারণ মানুষের জন্য ছিল অবারিত দ্বার। আবার এ বাড়িতেই নেমে আসে শোকাবহ রাত ১৫ আগস্ট। ১৯৭৫ এর এই রাতে সপরিবারে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বাড়িটির এ সমস্ত প্রেরণাদায়ক ঐতিহ্যের কথা ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলার উদ্দেশ্যে পরবর্তীকালে এ বাড়ির নম্বরও পরিবর্তন করে দেওয়া হয়। এই কু-উদ্দেশ্যেই একে বলা হতো, ধানমন্ডি ১১ নম্বর সড়কের ১০ নম্বর বাড়ি। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের মন থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলা যে এতো সহজ নয়, তা জানতো না খুনীরা। তাই, আজও ৩২ নম্বর বলতে মানুষ বঙ্গবন্ধুর বাড়িকেই বোঝে।

১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার কৃষি ও বনমন্ত্রী হন বঙ্গবন্ধু। তবে, সে সরকার বেশিদিন স্থায়ী হয় নি। অতঃপর ১৯৫৬ সালের কোয়ালিশন সরকারের মন্ত্রিসভায় শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান তিনি। তবে তখনও ঢাকায় বঙ্গবন্ধু পরিবারের মাথা গোঁজার নিজস্ব কোনও ঠাঁই ছিল না। তিনি সপরিবারে থাকতেন আবদুল গণি রোডের ১৫ নম্বর বাড়িতে। এসময় পিডবিস্নউডি থেকে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষকে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছিল। একদিন বঙ্গবন্ধুর পিএস নুরুজ্জামান পিডবিস্নউডি থেকে একটি আবেদনপত্র এনে দেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে। সেটি জমা দেয়া হলে ১৯৫৭ সালে বেগম মুজিবের নামে ছয় হাজার টাকা মূল্যের এক বিঘার একটি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রথমে দুই হাজার টাকা এবং পরে কিস্তিতে বাকি চার হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়। ওই বছরই শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। নিবেদিত প্রাণ শেখ মুজিব দলকে সময় দেবেন বলে ছেড়ে দেন মন্ত্রিত্ব।

১৯৫৮ সালে টি বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় সেগুনবাগিচায় একটি বাসা বরাদ্দ দেওয়া হয় বঙ্গবন্ধুর নামে। সে বছরই আইয়ুব খান মার্শাল ল জারি করলে গ্রেফতার করা হয় বঙ্গবন্ধুকে। ১২ অক্টোবর সেগুনবাগিচার বাড়িটি তিন দিনের মধ্যে ছেড়ে দিতে নির্দেশ দেওয়া হয় বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে। সিদ্ধেশ্বরী বয়েজ স্কুল মাঠের পাশে মাসিক ২০০ টাকা ভাড়ায় একটি বাড়িতে এসে ওঠেন বেগম মুজিব। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই শেখ মুজিবের পরিবার যে এই বাড়িতে থাকেন, তা জানাজানি হয়ে গেলে বাড়ির মালিক বেগম মুজিবকে বাড়ি ছেড়ে দিতে বলেন। সন্তানদের নিয়ে আবার তিনি এসে ওঠেন সেগুনবাগিচার একটি বাসার দোতলায়। পরবর্তী ২ বছর এখানেই তারা ছিলেন। ১৯৬০ সালের ১ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু জেল থেকে মুক্তি পান। চাকরি নেন আলফা ইন্সুরেন্স কোম্পানির কন্ট্রোলার অব এজেন্সিস পদে। বেতন ৩ হাজার টাকা। বেতনের সেই টাকার উপর নির্ভর করে পিডবিস্নউডির বরাদ্দ দেওয়া সেই প্লটে ১৯৬১ সালে বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু হয়।

বিভিন্ন জনের কাছ থেকে ধারকর্জ করে, বন্ধুবান্ধবদের সহায়তায় এবং হাউস বিল্ডিং ফাইনান্স করপোরেশন থেকে ঋণ নিয়ে ঢাকার বুকে ধীরে ধীরে তৈরি হতে থাকে বঙ্গবন্ধুর নিজস্ব ঠিকানা। নির্মাণ কাজ তদারকি করেছিলেন তৎকালীন পিডবিস্নউডির নির্বাহী প্রকৌশলী ও পরবর্তীকালে পূর্তসচিব মাইনুল ইসলাম। নির্মাণ কাজে নানাভাবে আর্থিক সহযোগিতা করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ও দাফতরিক সহকর্মীরা। সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ সহকর্মী চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের নূরুল ইসলাম। আলফা ইন্সুরেন্স কোম্পানির একজন কর্মকর্তা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিল তার আত্মিক এবং পারিবারিক সম্পর্ক। নূরুল ইসলাম ‘ক্রস ওয়ার্ড’ লটারি খেলতেন। একদিন লটারীতে ব্যবহার করেছিলেন শেখ রেহানার নাম। সেইদিনই তিনি পেয়ে যান ছয় হাজার টাকা। সেই টাকা তিনি গচ্ছিত রাখেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কাছে। বাড়ির নির্মাণ কাজে টাকার সংকট দেখা দিলে নূরুল ইসলাম এই গচ্ছিত টাকা কাজে লাগানোর অনুরোধ করেন। সেই টাকা ঋণ হিসাবে গ্রহণ করে পরবর্তীতে তা পরিশোধও করেন বঙ্গবন্ধু। বাড়ির জানালার গ্রিল সরবরাহ করেছিলেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা রংপুরের মতিউর রহমান। বাড়ি নির্মাণকালে কেয়ারটেকার ছিলেন গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার আরজ আলী।

কোনোমতে নির্মাণকাজ শেষ করে ১৯৬১ সালের ১ অক্টোবর সপরিবারে বঙ্গবন্ধু এই বাড়িতে উঠে আসেন। বাড়িতে ঢুকতেই ছিল একটি ছোট রুম, যা ড্রয়িংরুম হিসাবে ব্যবহার করা হতো। আসবাব বলতে ছিল একসেট বেতের সোফা মাত্র। একতলা বাড়িটিতে তখন ছিল দুটি বেডরুম। যার একটিতে থাকতেন বঙ্গবন্ধু ও বেগম মুজিব। অন্যটিতে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। তার পাশের কক্ষটি রান্নাঘর হিসেবে ব্যবহার করা হতো। রান্নাঘরের এক পাশে থাকতেন শেখ কামাল ও শেখ জামাল।

বঙ্গবন্ধু ও তার সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ৩২ নম্বরের এ বাড়িটিকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন। ১৯৬৬ সালের শুরুর দিকে দোতলার কাজ শেষ হয়। ১৯৯৪ সালে লেখা ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ বইতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তুলে ধরেছেন ৩২ নম্বরের বাড়িতে তাদের বসবাসের দিনগুলোর কথা :

‘১৯৬১ সালে এই বাড়িটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। কোনোমতে তিনটা কামরা করে এতে আমরা উঠি। এরপর মা একটা একটা কামরা বাড়াতে থাকেন। এভাবে ১৯৬৬ সালের শুরুর দিকে দোতলা শেষ হয়। আমরা দোতলায় উঠে যাই। ছয় দফা দেবার পর কাজকর্ম বেড়ে যায়। নিচতলাটা তখন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেই ব্যতিব্যস্ত। নিচে আব্বার শোবার কামরাটা লাইব্রেরি করা হয়।’

বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যে টেলিফোনটি প্রথম সংযোগ দেয়া হয় সেটির নম্বর ছিল ২৫৬১। এই টেলিফোন নিয়ে একটি মজার গল্প আছে। আইয়ুব খানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা প্রায়ই এ টেলিফোনটিতে আড়ি পাততো। তাই, শেখ ফজলুল হক মনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে নিজের নাম গোপন করে ‘বালিওয়ালা’ বলে নিজের পরিচয় দিতেন। আর সিরাজুল আলম খান নিজের পরিচয় দিতেন ‘ইটাওয়ালা’ বলে।

ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালির স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাসও, আছে হারানোর বেদনা। স্বাধীন দেশে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতের অন্ধকারে একদল বিশ্বাসঘাতক বিপথগামী সেনা অফিসারের হাতে ৩২ নম্বরের বাড়িতেই সপরিবারে নিহত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেদিন নরপিশাচরা রাতের অন্ধকারে হামলা চালায় স্বাধীনতার স্থপতির বাসভবনে। পৈশাচিক উল্লাসে বঙ্গবন্ধুকে নিষ্ঠুর নির্মমভাবে হত্যা করে তারা।

সে রাতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনসহ তিনটি বাড়িতে সংঘটিত খুনীদের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের বীভৎসতার হৃদয়স্পর্শী বর্ণনা দিয়েছিলেন সেনাবাহিনীর তৎকালীন মেজর আলাউদ্দিন আহমেদ পিএসসি :

‘কী বীভৎসতা! রক্ত, মগজ ও হাড়ের গুঁড়ো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল বাড়িটির প্রতিটি তলার দেয়াল, জানালার কাঁচ, মেঝে ও ছাদে। রীতিমতো রক্তগঙ্গা বয়ে যায় বাড়িটিতে। গুলির আঘাতে দেয়ালগুলোও ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। চারপাশে রক্তের সাগরের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল ঘরের জিনিসপত্র। প্রথম তলার সিঁড়ির মাঝখানে নিথর হয়ে পড়ে আছেন ঘাতকের বুলেটে ঝাঁঝরা হওয়া চেক লুঙ্গি ও সাদা পাঞ্জাবি পরা স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু। তলপেট ও বুক ছিল বুলেটে ঝাঁঝরা। নিথর দেহের পাশেই পড়েছিলো তার ভাঙ্গা চশমা ও অতিপ্রিয় তামাকের পাইপটি। অভ্যর্থনা কক্ষে শেখ কামাল। টেলিফোন অপারেটর। মূল বেডরুমের সামনে বেগম মুজিব। বেডরুমে সুলতানা কামাল, শেখ জামাল, রোজী জামাল। নিচ তলার সিঁড়িসংলগ্ন বাথরুমে শেখ নাসের। এবং মূল বেডরুমে দুই ভাবীর ঠিক মাঝখানে বুলেটে ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত অবস্থায় পড়েছিল ছোট্ট শিশু শেখ রাসেলের লাশ।’

সেদিন আরো হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি ও মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছেলে আরিফ, কন্যা বেবি সেরনিয়াবাত ও শিশুপৌত্র সুকান্ত বাবু, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের ভাইয়ের ছেলে শহীদ সেরনিয়াবাত, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মনি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি, সেরনিয়াবাতের বাসায় থাকা আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর নঈম খান রিন্টু, বঙ্গবন্ধুর জীবন বাঁচাতে ছুটে আসা রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিলসহ কয়েক নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে। 

এরপর বাড়িটি সিল করে দেয় তৎকালীন সরকার। হত্যাকণ্ডের সময় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা পশ্চিম জার্মানিতে ছিলেন। পরে, তারা ভারত সরকারের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে ভারতে চলে আসেন। নির্বাসিত অবস্থায় দিল্লীতে বসবাস করতে থাকেন শেখ হাসিনা। ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হয়ে দেশে ফিরে এলে বাড়িটি ফিরে পান তিনি।

এর বছর খানেক পর শেখ হাসিনা সংবাদপত্রে একটি নিলাম বিজ্ঞপ্তি দেখতে পান। হাউস বিল্ডিং ফাইনান্স করপোরেশনের সেই বিজ্ঞপ্তির তালিকায় ৩২ নম্বরের বাড়িটিও ছিল। বাড়ি নির্মাণে পাকিস্তান আমলে নেওয়া ১২ হাজার টাকা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়ও পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ক্ষমতায় থেকেও এই অতি সাধারণ বাড়িটির কোনও ‘উন্নয়নও’ করার চেষ্টা করেননি বঙ্গবন্ধু। ঋণ বকেয়া থাকায় নিলামে ওঠে বাড়িটি। ১২ হাজার টাকা বকেয়া পরিশোধের পর বাড়িটির দখল বুঝিয়ে দেওয়া হয় শেখ হাসিনাকে। জাদুঘরে রূপান্তরের জন্য বাড়িটি বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের কাছে হস্তান্তর করেন তিনি। ১৯৯৪ সালের ১৪ আগস্ট উদ্বোধন করা হয় জাদুঘরটি। নাম দেওয়া হয়- ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর।’ ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ বইতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিখেছেন:

‘মিউজিয়াম করতে গেলে অনেক পরিবর্তন করতে হয়। সে পরিবর্তন কমিটি করাচ্ছে। আমি প্রায়ই যাই দেখতে। দেয়ালগুলোতে যখন পেরেক ঠোকে, জিনিসপত্রগুলো যখন সরিয়ে ফেলে, বুকে বড় বাজে, কষ্ট হয়, দুঃখ হয়। মনে হয় ওই পেরেক যেন আমার বুকের মধ্যে ঢুকছে। মাঝে-মাঝেই যাচ্ছি, ঘুরে দেখে আসছি যতই কষ্ট হোক। এই কষ্টের মধ্যে, ব্যথা-বেদনার মধ্যে একটা আনন্দ আছে। সে আনন্দ হলো, আমরা জনগণকে তাদের প্রিয় নেতার বাড়িটি দান করতে পারছি। জনগণের সম্পত্তি হবে ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িটি। এটাই আমাদের বড় প্রাপ্তি। আমরা তো চিরদিন থাকবো না কিন্তু এই ঐতিহাসিক বাড়িটি জনগণের সম্পদ হিসেবে সব স্মৃতির ভার নিয়ে ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে থাকবে।’

জাদুঘরটা সাদামাটা। তিন তলা ভবন মাত্র। নয় কক্ষবিশিষ্ট এ ভবনের আসবাব পত্রও একদমই সাধারণ মানের। ভবনে ঢুকতেই চোখে পড়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি। প্রথম তলায় আরও রয়েছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে নিহত সবার ছবি এবং কিছু আসবাবপত্র। এই ঘরটি আগে ছিল ড্রইং রুম। এই ঘরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা। এর পাশের ঘরটি ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের পড়ার ঘর। এখানে তিনি লেখালেখির কাজও করতেন। ১৯৭১ সালে এই ঘর থেকেই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠানো হয়েছিল সারাদেশে।

দোতলায় বঙ্গবন্ধুর শয়নকক্ষ। এ ঘরের সামনে করিডর থেকে নিচে যাওয়ার সিঁড়িতেই ঘাতকদের গুলিতে মারা যান জাতির পিতা। এখনও গুলির চিহ্ন সেখানে রয়ে গেছে। আর রয়েছে, শিল্পীর তুলিতে আঁকা বঙ্গবন্ধুর গুলিবিদ্ধ অবস্থার একটি প্রতিকৃতি। বঙ্গবন্ধুর শয়নকক্ষে তার বিছানার পাশেই ছোট টেবিলে সাজানো আছে তার প্রিয় পাইপটি, তামাকের কৌটা। রয়েছে টেলিফোন সেট ও রেডিও। সামনের খাবার ঘরের একপাশে আছে শিশু রাসেলের বাইসাইকেল। আছে খাবার টেবিল, থালা, বাটি। আছে রেকসিনের সোফা। শেখ জামালের কক্ষে দেখা যায় তার সামরিক পোশাক। বাড়ির তৃতীয় তলায় শেখ কামালের কক্ষে তার বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র সাজিয়ে রাখা আছে। এছাড়াও রয়েছে পুত্রবধূ সুলতানা কামালের বৌভাতের সবুজ বেনারসি শাড়ি, রোজী জামালের লাল ঢাকাই জামদানি, বিয়ের জুতা, ভাঙা কাচের চুড়ি, চুলের কাঁটা, শিশু রাসেলের রক্তমাখা জামা, বঙ্গবন্ধুর রক্তমাখা সাদা পাঞ্জাবি, তোয়ালে, লুঙ্গি, ডায়েরি। বাড়ির দেয়াল, দরজা, ছাদসহ বিভিন্ন জায়গায় ঘাতকের বুলেটের চিহ্ন ১৫ আগস্টের সেই অমানবিক বীভৎসতার কথা মনে করিয়ে দেয়। এসব ছিলো, তিনি যাদের ‘ভাই-য়েরা আমার’ বলে সম্বোধন করতেন এ দেশের সেই সমস্ত ভাইদের মধ্যকার একদল বিশ্বাসঘাতকদের। অপকীর্তির ইতিহাসের এই দেয়াল লিখন যুগ যুগ ধরে নিন্দিত হতে থাকবে।

এই বাড়ির পেছনে রয়েছে জাদুঘরের স¤প্রসারিত নতুন ভবন। বঙ্গবন্ধুর বাবা-মায়ের নামে এ ভবনের নাম দেওয়া হয়েছে ‘শেখ লুৎফর রহমান ও শেখ সায়েরা খাতুন’ গ্যালারি। ২০১১ সালের ২০ আগস্ট এ অংশটি আনুষ্ঠানিকভাবে খুলে দেওয়া হয়। ছয় তলা এ ভবনের দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ তলা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর জীবনের বিভিন্ন সময়ের আলোকচিত্র রয়েছে। পঞ্চম তলায় রয়েছে পাঠাগার ও গবেষণা কেন্দ্র।

বঙ্গবন্ধু ভবনের গেটের উল্টোদিকে একটি স্মৃতিস্তম্ভে খোদাই করে কীর্তিত হয়েছে সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়ের লেখা একটি অবিস্মরণীয় কবিতার বিশেষ অংশ। যেটা, আসলে কবির উপলব্ধির চিরন্তন সত্যকে ধারণ করেই হয়ে আছে। আজ অবধি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রতিটি বাঙালির মনের কথা। আর সর্বদা ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে চলেছে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী বাংলাদেশের প্রত্যেকটি মানুষের অন্তরে অন্তরে :

‘যতকাল রবে পদ্মা, মেঘনা

গৌরী, যমুনা বহমান

ততকাল রবে কীর্তি তোমার

শেখ মুজিবুর রহমান’

লেখক : সাংবাদিক, নিউজ রুম এডিটর, একুশে টিভি, ঢাকা।


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি