ঢাকা, শুক্রবার   ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪

পুঁথিসাহিত্যের আলোকবর্তিকা পটিয়ার আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৮:৫৬, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | আপডেট: ০৮:৫৯, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল সাহিত্যবিশারদ মুন্সী আব্দুল করিম। সাহিত্যজগতে আব্দুল করিমের খ্যাতি ছিল অপরিসীম। তার রচনা ও সংগৃহীত পুঁথি আমাদের মূল্যবান সাংস্কৃতিক সম্পদ ও ঐতিহ্যের নিদর্শন। তিনি ছিলেন একজন ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ। 

১৮৭১ সালের ১০ অক্টোবর পটিয়ার ঐতিহ্যবাহী গ্রাম সুচক্রদণ্ডীতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর পিতার নাম মুন্সী নুরুদ্দিন এবং মাতার নাম মিশ্রীজান। আব্দুল করিম যখন মাতৃগর্ভে তখন তাঁর পিতা মুন্সী নুরুদ্দিন মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর বয়স যখন সতেরো বছর তখন তিনি তাঁর মাতা মিশ্রীজানকেও হারান।

পারিবারিক পরিমণ্ডলেই আব্দুল করিমের প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি। এরপর তিনি ভর্তি হন সুচক্রদণ্ডী মধ্যবঙ্গ বিদ্যালয়ে। আব্দুল করিম পটিয়া স্কুল হতে ১৮৯৩ সালে এন্ট্রান্স পাশ করেন। 

যতদূর জানা যায়, দক্ষিণ চট্টগ্রামের মুসলমানদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম এন্ট্রান্স পাশ করা ব্যক্তি ছিলেন। এন্ট্রান্স পাশ করে তিনি চট্টগ্রাম কলেজে এফ. এ. ক্লাসে পড়াশুনা শুরু করেন কিন্তু টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণে তাঁর চূড়ান্ত পরীক্ষা দেয়া সম্ভব হয় নি। ফলে এখানেই তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ইতি ঘটে।

তাঁর প্রথম কর্মস্থল চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল স্কুল। তিনি মাত্র কয়েকমাস এখানে শিক্ষকতা করেন। এরপর তিনি সীতাকুণ্ড মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয়ে এক বছরের জন্য (১৮৯৫-৯৬) অস্থায়ী প্রধান শিক্ষকের পদে যোগ দেন। ১৮৯৬-৯৭ সালে প্রথমে তিনি চট্টগ্রাম সাব জজ আদালতে, পরে পটিয়া মুন্সেফ আদালতে শিক্ষানবিস হিসেবে কাজ করেন। কবি নবীন চন্দ্র সেনের (১৮৪৭-১৯০৯) আগ্রহে ও আনুকূল্যে ১৮৯৮ সালের জানুয়ারি মাসে চট্টগ্রাম কমিশনার অফিসের কেরানি পদে তিনি নিয়োগ পান। কিন্তু পত্রিকায় বিজ্ঞাপন নিয়ে পুঁথি সংগ্রহের এক প্রয়াসে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে আব্দুল করিম চাকুরিচ্যুত হন। বেশ কিছুকাল কর্মহীন থাকার পর তিনি আনোয়ারা মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদে যোগ দেন। সেখানে তিনি ১৮৯৯ সাল হতে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন।

১৯০৬ সালে আব্দুল করিম শিক্ষকতার পেশা ত্যাগ করে চট্টগ্রাম বিভাগের ইন্সপেক্টর অব স্কুল-এর অফিসে দ্বিতীয় কেরানির পদে চাকুরীতে যোগ দেন। দীর্ঘ ২৮ বছর চাকুরীর পর ১৯৩৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তিনি অবসর গ্রহণ করেন। সক্রিয় কর্মজীবন হতে অবসর নিয়ে তিনি সাহিত্যসাধনার পাশাপাশি সমাজ সেবামূলক কর্মকাণ্ডেও অংশ নেন। স্থানীয় ইউনিয়ন বোর্ডের সদস্য ও বেঞ্চের প্রেসিডেন্ট, পটিয়া ঋণ সালিশি বোর্ডের প্রেসিডেন্ট হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘকাল পটিয়া উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে পরিচালনা পরিষদের সভাপতি ছিলেন তিনি।

আব্দুল করিম কিশোর বয়সে যাকে বালিকাবধু হিসেবে নিজ জীবনের সাথে সম্পৃত্ত করেছিলেন এবং যার সঙ্গে দীর্ঘ ৭১ বছর ঘরসংসার করেছিলেন সেই প্রিয়তমা জীবনসঙ্গিনী ১৯৫৩ সালের ২৫ মার্চ ইন্তেকাল করেন। প্রিয়তমা স্ত্রীর মৃত্যুতে আব্দুল করিম অনেকটা অসহায় ও মানসিকভাবে বিপর্যস্থ হয়ে পড়েন। নিঃসঙ্গ সাহিত্যবিশারদ ১৯৫৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর সকালে গ্রামের নিজ বাড়িতে ৮২ বছর বয়সে লেখারত অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

জীবিত অবস্থায় এই মহান সাধক তাঁর কর্মের স্বীকৃতি, সম্মান ও সমাদর পেয়ে গেছেন।

উপযুক্ত সম্মান ও পদক ছাড়াও তাঁর সময়কালের তিনিই ছিলেন একমাত্র মুসলিম সাহিত্যিক, যার প্রবন্ধ কলিকাতার প্রথম শ্রেণির পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হত। উনিশ শতকের শেষ দশক থেকে তিনি পুঁথি সংগ্রহে মনোযোগী হন। এই কাজে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, দীনেশ চন্দ্র সেন, নগেন্দ্র নাথ বসু, প্রাচ্যবিদ্যামহানব তাঁর পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন। আদি পর্বের পুঁথিসংগ্রহ প্রয়াসে এদের পাশাপাশি আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদের নামও উল্লেখযোগ্য। প্রাচীন পুঁথি সংগ্রহ, সম্পাদনা, বিবরণ, লিপিবদ্ধ আলোচনা সাহিত্যবিশারদের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ প্রায় ২০০০ পুঁথিসংগ্রহ করেছিলেন। ৬০০ এর মতো প্রবন্ধ ও ১১টি কাব্যগ্রন্থ সম্পাদনা করেন।

সূত্র: গৌরব গাথা, পটিয়া উৎসব ২০২২ স্মারক
এসএ/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি