ঢাকা, শুক্রবার   ১৪ মার্চ ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

প্রগতিশীল মানবিকতার ব্রত সাধক

এম. নজরুল ইসলাম

প্রকাশিত : ১৩:৪২, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | আপডেট: ১১:১৫, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩

Ekushey Television Ltd.

তাঁকে চিনি আমাদের তরুণবেলার সূচনালগ্ন থেকেই। সে এক দিন ছিল আমাদের। দিন ও রাতের কোনো তফাৎ ছিল না। ১৯৭২ সালের পর থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্ট পর্যন্ত এক প্রাণময় সময় কাটিয়েছি আমরা। ভেসেছি প্রাণের উচ্ছ্বাসে। সদ্য স্বাধীন দেশে নিয়েছি বুক ভরে নিশ্বাস। ডানা মেলে উড়েছি তখন। এই আকাশ আমার। এই বাতাসে আমাদের অধিকার। এই আলো, এই হাওয়া- সব যেন নিজের মতো করে পাওয়া। ছাত্র রাজনীতি থেকে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, খেলার মাঠ থেকে নাটকের মঞ্চ, সর্বত্রই ছিল আমাদের প্রাণোচ্ছল উপস্থিতি। স্টেডিয়াম থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠ, টিএসসি থেকে মধুর ক্যান্টিন- আমাদের কলরবে মুখর তখন। আর এই উপস্থিতি মূলত রাজনৈতিক কারণেই। ছাত্রলীগের ঢাকা মহানগর অফিস থেকে কলাভবন হয়ে টিএসসি। আবার সেখান থেকে তোপখানা রোড। মতিঝিল, পল্টন, নবাবপুর রোড, জগন্নাথ কলজে সবখানে আমাদের সরব বিচরণ। তখনো তো এতো বিস্তৃত হয়নি শহর ঢাকা। রিকসায় চড়েই শহরের এ মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত ঘোরাঘুরি করা যেত। আজকের দিনের মতো এমন বিরক্তিকর যানজট ছিল না। সকালে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ তো বিকেলে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর। কলাবাগান, হাতিরপুল ঘুরে ক্যাম্পাসে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে পেরিয়ে যেত। রাত নিশুতি হলে কোনো না কোনো আবাসিক হলে কারো না কারো বিছানায় শেয়ারে রাত কাটানোয় মানা তো ছিল না। হলের ক্যান্টিনের খাওয়া সেই রাতে অমৃতের মতো মনে হতো।

আমাদের সেই উদ্যমী-উদ্দাম সময়ে আরেক প্রাণময় তরুণকে দেখি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। না, রাজনীতির মাঠে শুধু নয়, তাঁকে দেখি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মঞ্চেও। নজরকাড়া চেহারার গৌরবরণ এই কান্তিময় তরুণ ছিলেন আমাদের অগ্রজ। স্বাভাবিক সম্ভ্রমে তাই এড়িয়ে চলেছি তাঁকে। ১৯৭৫ সালের বিয়োগাত্মক ঘটনার পর আমরা বিচ্ছিন্ন ক্যাম্পাস থেকে। রাজনীতি তখন নিষিদ্ধতার ঘেরাটোপে বন্দী। সামরিক বুটের তলায় পিষ্ট বাকস্বাধীনতা। তার পর তো আমার প্রবাস জীবনের শুরু। দীর্ঘকাল পর দেশে ফিরে দেখা পাই তাঁর। ততদিনে তিনি প্রকাশিত স্বমহিমায়। আত্মপ্রকাশ করেছেন স্বপরিচয়ে। দেশের সংস্কৃতিমনষ্ক সব মানুষ তো বটেই খেটে খাওয়া মানুষের মনেও ঠাঁই করে নিয়েছেন তিনি। অভিনয় কুশলতায় নিজের নামটি ছাড়িয়ে শাহেদকে চিনিয়ে দেওয়া মানুষটির তখন মঞ্চেও সমান দাপট। ততদিনে তাঁর ঝুলিতে যুক্ত হয়েছে নানা অভিজ্ঞতা। এক সময়ের সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগের শিক্ষার্থী পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন সাংবাদিকতা। লালসবুজ নামের অধুনালুপ্ত আধুনিক দৈনিকে নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে কাটিয়েছেন বেশ কিছুটা সময়।

তাঁর লেখার হাতটি বড্ড মিষ্টি। বলতে পারেন গুছিয়ে। প্রকাশিত ১৬টি গ্রন্থ তো তারই সাক্ষ্য দেয়। বড়দের শুধু নয়, ছোটদের কল্পনার জগতেও তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ। আবার সংগঠক হিসেবেও পাই তাঁকে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের প্রতিষ্ঠাকালীন স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিউিট বাংলাদেশ শাখারও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তিনি। ঢাকা থিয়েটার ও বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত থেকে মঞ্চনাটকে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। চলচ্চিত্র উন্নয়নেও রয়েছে তাঁর বিশেষ ভূমিকা। মানবিক ও প্রগতিশীল এই সংস্কৃতিবান মানুষটি টিভি ও মঞ্চে যেমন স্থিতধী, তেমনি প্রতিশ্রুতিশীল মননশীল লেখায়ও।

এরশাদ আমলে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন বেগবান করতে তাঁর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে বাংলাদেশ যুব ঐক্য। যুব সংগ্রাম পরিষদেরও অগ্রণী তিনি।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। উত্তর কোরিয়ার পিয়ং ইয়ংয়ে বিশ্ব ছাত্র-যুব সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। মিশরের কায়রো চলচ্চিত্র উৎসবে যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশের পক্ষে। যুক্তরাষ্ট্রে বঙ্গবন্ধু সম্মেলন, ফোবানা সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন। জার্মানীর বার্লিনে আন্তর্জাতিক লোক উৎসবে যোগ দেওয়ার পাশাপাশি কলকাতার হলদিয়ায় আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসবেও তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রতিনিধি।
আশির দশকের শুরুতে ‘সকাল সন্ধ্যা’ নামের টিভি সিরিয়ালে ‘শাহেদ’ চরিত্র তাঁকে বিপুল জনপ্রিয়তা এনে দেয়। মোরশেদুল ইসলাম পরিচালিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘আগামী’ দিয়ে চলচ্চিত্রে অভিষেক। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ‘একাত্তরের যীশু’ চলচ্চিত্রে পাদ্রীর ভূমিকায় তাঁর অভিনয় দর্শকদের অনেকদিন মনে থাকবে। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ চলচ্চিত্রে তিনি ইবুর বাবা; ‘গেরিলা’য় তিনি আনোয়ার হোসেন। আগামী চলচ্চিত্রে তিনি অনু সাঈদ, অভিনয় করেছেন মহামিলন, উত্তরের খেপ চলচ্চিত্রে। কিত্তনখোলা ছবির ইদু কন্ট্রাক্টর চরিত্রটি তো অনবদ্য। সাইদুল আনাম টুটুল পরিচালিত আধিয়ার ছবিতে জমিদার চরিত্রে তাঁর অভিনয় অনেক দিন মনে রাখার মতো। মেঘলা আকাশ, আমার আছে জল, মৃত্তিকা মায়া, আমি শুধু চেয়েছি তোমায় ও বুনো হাঁস তাঁর অভিনয়ে ঋদ্ধ হয়েছে। তাঁর একটি অনবদ্য কাজ হচ্ছে আবদুল গাফফার চৌধুরীর কাহিনী চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় নির্মিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম জীবনভিত্তিক তথ্যচিত্র ‘পলাশী থেকে ধানমণ্ডি’। এই তথ্যচিত্রে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন তিনি। শুধু অভিনয় নয়, গাফ্ফার ভাই জানিয়েছেন, তথ্যচিত্রের প্রি-প্রডাকশন, প্রডাকশন, পোস্ট প্রডাকশন-সবক্ষেত্রেই তাঁর অভিজ্ঞতার পরশ আছে। আমরা ভিয়েনায় এই ছবির প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলাম। তাঁর অভিনয় উপভোগ করেছি বিস্মিত মুগ্ধতায়।

সবশেষে তাঁর সাম্প্রতিক সাংগঠনিক কার্যক্রম নিয়ে কিছু কথা। সম্প্রীতি বাংলাদেশ নামের এক অরাজনৈতিক, সামজিক সংগঠনের আহ্বায়ক তিনি। সংগঠক হিসেবে তাঁর এই নতুন পরিচয়টিই আমার সঙ্গে তাঁর অপরিচয়ের বেড়া ভেঙে দিয়েছে। বেঁধেছে নৈকট্যে। সমমনাদের নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন সংগঠনটি। তিনি মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের শক্তির কাছে বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতা না রাখলে বাংলাদেশের উন্নয়ন স্থবির হয়ে যাবে। তাই জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সবার মধ্যে সম্প্রীতি বজায় রেখে বঙ্গবন্ধুর চেতনায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রত্যয়েই সম্প্রীতি বাংলাদেশ তাঁর নেতৃত্বে কাজ করছে। বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দর্শনের বার্তা নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্রত নিয়েছে সংগঠনটি। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাস মিলন আর সম্প্রীতির যে ইতিহাস সেখানে ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িকতার স্থান নেই। সমাজ থেকে সাম্প্রদায়িকতা নির্মূল করতে এবং ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রুখে দিতে সমাজের সর্বস্তরের ঐক্য প্রয়োজন অনুভব করেই তিনি সারা দেশে নিয়ে গেছেন সম্প্রীতি বাংলাদেশ নামের সংগঠনটিকে। যারা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে জলাঞ্জলি দিতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে দেশাত্মবোধ নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যেই কাজ করছে তাঁর সংগঠন।

এতক্ষণ যাঁর সম্পর্কে বললাম, তিনি পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়। অসাম্প্রদায়িক, মানবিক ও প্রগতিশীল এই মানুষটির জন্ম ১৯৫০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর, ফরিদপুর শহরে। আজ তাঁর জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাই তাঁকে। তাঁর দীর্ঘায়ু কামনা করি।

লেখক    : সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি 
Email    : nazrul@gmx.at


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি