‘প্রবহমান বাংলা ভাষার গতি-প্রকৃতির ধরন’ ওয়েবনিয়ার অনুষ্ঠিত
প্রকাশিত : ২৩:৫৬, ১ সেপ্টেম্বর ২০২০
নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের উদ্যোগে মঙ্গলবার (১ সেপ্টেম্বর) অনুষ্ঠিত হলো ষষ্ঠ ওয়েবনিয়ার ‘প্রবহমান বাংলা ভাষার গতি-প্রকৃতির ধরন’। বাংলা টিভির সংবাদ উপস্থাপক শাকিল আহমাদ রুমির সঞ্চালনায় এতে সভাপতি ছিলেন নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান ও বহুমাত্রিক লেখক ড. রকিবুল হাসান।
ওয়োবিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন- বিশিষ্ট সাংবাদিক-গবেষক ও দৈনিক মানবকণ্ঠের সহকারী সম্পাদক দীপঙ্কর গৌতম। আলোচক ছিলেন- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুররহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জয়নাবে বিনতে হোসেন ও পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আরিফা বিশ্বাস। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক শারমিন সুলতানা তন্বী।
আলোচকবৃন্দ বলেন, প্রবহমান বাংলা ভাষার গতি প্রকৃতির ধরন বিষয়গতভাবে বিচিত্র। এই প্রত্যয়টিকে যে কোনো একটি জায়গা থেকে নির্দেশিত করা সম্ভব নয়। বহু বিচিত্র ধারায় প্রবাহিত হয়ে “হিন্দ য়ুরোপায়ণ” ভাষা থেকে বাঙ্গালা হয়ে বাংলা ভাষা সৃষ্টি হয়েছে বহু বছরের পথ পরিক্রমায়।
ভাষা মূলত এমন একটি বৈজ্ঞানিক প্রত্যয়, যার জন্ম জীবের জন্মের ন্যায় নয়, কত সনের কত তারিখে এর জন্ম তা বলা যায় না। তবে এর বিস্তৃতি মানুষের বেড়ে ওঠার মতোই। এটি স্থান-কাল-পাত্র ভেদে এটিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হওয়া মানুষের জীবন ধারনের অনুকূল–প্রতিকূল, আর্থ-সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক, ভৌগোলিক পরিবেশ ও আবহাওয়ার ধরনের উপর ভিত্তি করে কালক্রমে গড়ে উঠে এক বৈচিত্র্যপূর্ণ অবয়ব নিয়ে। আর এই গড়ে ওঠার প্রতিটি ধাপ, পর্যায় ধরন-প্রকৃতিও অবস্থা ভেদে ভিন্ন ভিন্ন। এ কারণেই বলা হয়েছে, “ভাষা নদী প্রবাহের ন্যায়, বিভিন্ন স্থানে তাহার নাম ভিন্ন ”। (ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ- বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত)।
হাজার বছরে প্রবহমান ধারায় প্রবাহিত হয়ে যে বাংলা ভাষা আজকের বাংলা ভাষার নানা রূপ পরিগ্রহ করেছে তা হাজার বছর পরেও যে একই রুপে অপরিবর্তিত থাকবে তা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না। এ থেকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় যে, অন্যান্য ভাষার মতো বাংলা ভাষাও পরিবর্তনের বিশেষ ধারায় গতিশীল, যে ধারা এক কেন্দ্রিক নয়, বিবেচনার বহুদিক উন্মোচিত করে এই প্রত্যয়টি। আর এখানেই ভাষা বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের পার্থক্য।
বাংলা ভাষার পরিবর্তনের ধারা যে বিশেষ বিশেষ জায়গা থেকে পরিলক্ষিত হয়, তার মধ্যে স্বল্প পরিসরে উল্লেখযোগ্য হলো বাংলা ভাষার বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণ এবং ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় পট পরিবর্তন। বাংলা ভাষার সৃষ্টির গোড়ায় এর গতি- প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে ভাষা বিজ্ঞানিরা যে তুলনামূলক আলোচনায় পৌঁছেছেন তার আলোকে বলা যায়, ন্যূনাধিক ৫০০০ হাজার বছর পূর্বে ইউরোপের মধ্য ভাগ হতে দক্ষিণ-পূর্বাংশে বসবাসকারী জাতির ভাষা “হিন্দু-য়ুরোপায়ণ” হতে বহু পথ পরিক্রমায় বাংলা ভাষার সৃষ্টি। হিন্দু-য়ুরোপায়ণ ভাষার যে দুইটি বিভাগ ছিল তার মাঝে ‘কেন্তুম্’ শাখার সাথে বাংলা ভাষার সম্পর্ক না থাকলেও ‘শতম’ বিভাগ হতে সৃষ্ট ভারতীয় শাখা থেকে ক্রমান্বয়ে পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হয়ে বাংলা ভাষার সৃষ্টি।
ভারতীয় আর্য ভাষার প্রাচীন স্তর ও আদিম প্রাকৃত থেকে অপভ্রংশসহ বিভিন্ন উপস্তর পেরিয়ে বাংলা ভাষা যেভাবে রূপ পরিবর্তন করেছে তার পরিচয় আমরা পাই প্রাচীন থেকে আধুনিক যুগের বিভিন্ন সাহিত্য নিদর্শন থেকে। বিভিন্ন সময়ের সাহিত্য নিদর্শনের ভাষা আমাদের সামনে উপস্থাপিত করে বিভিন্ন সময়ের বাংলা ভাষার অবয়বগত পরিবর্তনের ধরন।
আধুনিক ভারতীয় আর্য ভাষার প্রাচীন স্তর ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১২০০ খ্রিষ্টাব্দ। এই সময়ের সাহিত্যিক নিদর্শন “চর্যাপদ” এর ভাষা যাকে সান্ধ্য ভাষা বলা হয়, তা থেকে সে সময়কার ভাষার রুপ-প্রকৃতির ধরন পাওয়া যায়। যেমন-
“কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল
চঞ্চল চিএ পইঠা কাল”
অথবা,
“টালত মোর ঘর নাহি পড়বেশী
হাড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেশী”
এ ভাষার ব্যাকরণভিত্তিক কতিপয় বৈশিষ্ট্য আমাদের ভাষার যে ধ্বনিতাত্ত্বিক ও রুপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের জানান দেয়, তা কিছুটা পরিবর্তিত হয় পরবর্তী অন্ধকার যুগের নিদর্শন খনার বচন, শুন্যপুরাণ এর চরণাবলীতে। ক্রিয়াপদের বিশেষ ব্যবহার, ত বিভক্তির প্রয়োগ, অ-ধ্বনির বিবৃত উচ্চারণ পরবর্তীতে পরিবর্তিত হয়।
খনার বচন থেকে পাওয়া ভাষা রূপ - “কলা রুয়ে না কেটো পাত
তাতেই কাপড় তাতেই ভাত ” -
এ থেকে আমাদের বাংলা ভাষার ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাওয়া যায়। এরপর, মধ্যযুগের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, বৈষ্ণবপদাবলী’তে পাওয়া যায় ভাষার আরো সাবলীল রূপ। বিদ্যাপতির চরণে যে ভাষার রুপ পাওয়া যায় তা আবার ভিন্ন আবেশের পরিচয় দেয়। যেমন –
“এ সখি হামারি দুখের নাহিকো্ ওর
এ ভরা বাদর মাহ ভাদর,
শুন্য মন্দির মোর ।”
১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বর্তমান পর্যন্ত নানা বাঁকে বাংলা ভাষার বাক ঘুরেছে, স্বাধীনভাবে গড়ে উঠেছে বাংলা ভাষার বিভিন্ন ধরন যেমন সাধু-চলিত ভাষা, ভৌগোলিক অবস্থানের ও মানুষের জীবন যাপনের আদৌলে গড়ে উঠেছে আঞ্চলিক ভাষা, সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতার জায়গা থেকে আসেছে প্রমিত ভাষা।
শুধু তাই নয়, ভাষা বিজ্ঞানের অগ্রসর ভূমিকার সফলতা নানা পরিবর্তন এনেছে ও নিয়ে আসছে মৌখিক উচ্চারণে, লেখ্য ও কথ্য ভাষার বানান পদ্ধতিতে যা ক্রমান্বয়ে এখনও চলমান প্রক্রিয়ায় এগিয়ে যাচ্ছে। আর সেই সাথে বাংলা ভাষা দিনে দিনে গতি পরিবর্তনের প্রগতিশীল ধারায় হচ্ছে সহজ, সাবলীল, সময় উপযোগী ও বস্তুনিষ্ঠ।
এনএস/
আরও পড়ুন