প্রবাসীদের ঘৃণা নয়: শওগাত আলী সাগর
প্রকাশিত : ১৯:২২, ১৯ মার্চ ২০২০ | আপডেট: ১৯:৩৭, ২২ মার্চ ২০২০
১. ‘প্রবাসীরাই দেশের সর্বনাশটা করলো’- এমন একটা প্রচারণা শুরু হয়েছে ফেসবুকে। প্রবাসীদের কারণেই দেশে করোনা এসেছে। এমন কথা এই পর্যন্ত অনেকেই বলেছেন। একজনের ছবি দিয়ে ‘এই সেই ব্যক্তি, যার কারণে বাংলাদেশের করোনা’- এমন প্রচারণাও চোখে পরেছে। এই ধরনের প্রচারনার বিরোধীতা করছেন বা করেছেন- এমনটা এখন পর্যন্ত চোখে পড়েনি। মনে হচ্ছে, প্রবাসীদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর একটা তৎপরতা চলছে।
২. করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি চীনে। পুরো ইউরোপ, আমেরিকা এখন সেই ভাইরাসের সাথে লড়াই করছে। কিন্তু কেউ কি চীনকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছে? কেউ কি বলছে- চীনের কারণে আজ পৃথিবীজুড়ে এই আতংক, এই ভয়াবহ অবস্থা? না, বলছে না। ইউরোপ, আমেরিকার কোনো সরকার চীনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবিও তুলছে না।
৩.ইউরোপের দেশগুলোতে করোনার ভাইরাসের বিস্তৃতি ঘটেছে আক্রান্ত দেশে ভ্রমনকারীদের মাধ্যমে। কানাডা, আমেরিকায় বিস্তার ঘটেছে ভ্রমনকারীদের মাধ্যমে। কানাডার কথাই যদি বলি। অভিবাসীর দেশ কানাডা। নানা দেশ থেকে আসা মানুষের বাস এখানে। এখানেও করোনার বিস্তৃতি ঘটেছে ভ্রমনকারীদের মাধ্যমে। কানাডা কিন্তু বলছে না- চীন থেকে আসা লোকগুলো সর্বনাশ করেছে, ইরান থেকে, ইতালী থেকে আসা লোকগুলো সর্বনাশ করেছে। কানাডা বরং এই কঠিন সময়ে তাদের নাগরিকদের কানাডায় ফিরে আসতে বলছে। কাদের ফিরে আসতে বলছে কানাডা? তারা কানাডার নাগরিক- এ কথা সত্য। তাদের কেউ বাংলাদেশি, চায়না, ইতালীয়ান, ইরানীয়ান। কানাডা কিন্তু বলছে না- এরা অন্যদেশের লোক, এই সময়ে আমরা তাদের জায়গা দেবো না।
৪. চীনে যখন প্রথম ভাইরাসটির আবির্ভাব ঘটে, উহানে আটকে পরা বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে আনার জন্য আপনারা আাকুতি জানিয়েছিলেন- মনে আছে? কেন জানিয়েছিলেন? তারা বাংলাদেশের সন্তান বলেই তো। যে কজন বাদ পরেছিলো- তাদের কেন আনা হচ্ছে না- সে নিয়ে সরকারের সমালোচনাও তো করেছেন।
৫. বাংলাদেশের করোনার বিস্তৃতি ঘটেছে ভ্রমনকারীদের মাধ্যমে- এটা সত্য। সেই ভ্রমনকারী প্রবাসে থাকা বাংলাদেশিও হতে পারে, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে গিয়ে দেশে ফিরে আসা কেউও হতে পারে। বাংলাদেশে যেহেতু মনিটরিং ব্যবস্থাটা নেই- সেই জন্য কারো কাছেই নিশ্চিত কোনো তথ্য নাই- ভাইরাসটি বাংলাদেশে কিভাবে এসেছে? হলে আপনারা প্রবাসীদের দায়ী করছেন কেন? তাদের গালি দিচ্ছেন কেন?
এই প্রবাসী কি বাংলাদেশের নাগরিক না? এই প্রবাসী কি বাংলাদেশের সন্তান না? আপনি তো তথ্য প্রমানের ভিত্তিতে নিশ্চিত না- এই লোকটাই যে দেশে করোনা নিয়ে এসেছে। তাছাড়া কেউ তো ইচ্ছে করে, শত্রুতা করে করোনার ভাইরাস ছড়িয়ে দেয়নি। তা হলে এই প্রচার (অপপ্রচার বললাম না, আপনাদের সম্মান জানিয়ে) কেন করছেন? এটা কি ঘৃণা ছড়ানোর পর্যায়ে পরছে না?
প্রবাসীদের অনেকে সেল্ফ আইসোলেশনে থাকার নিয়ম যথাযথভাবে অনুসরণ করেনি। বাংলাদেশ তো আসলে কোনো কিছুই অনুসরণ করছে না। করোনা আক্রান্ত লন্ডন থেকে দেশে গিয়ে একজন রাজনৈতিক নেতা প্রধানমন্ত্রীর সভায় পর্যন্ত যোগ দিয়েছেন। এটাই বাংলাদেশের বাস্তবতা। পৃথিবী এই কঠিন সময়ে নিয়ম মানার, অন্যের ক্ষতির কারণ না হওয়ার জন্য আমরা একে অপরকে পরামর্শ দেবো। কাউকে ব্র্যাকেটবন্দি করে ঘৃণা ছড়িয়ে তাদেরকে বিপদের মুখে ফেলে দেবো কেন? করোনা থেকে বাঁচতে সারা বিশ্বে সভা সমাবেশ বন্ধ রাখা হয়েছে। বাংলাদেশের কি সেটি করা হয়েছে? আপনি কিভাবে নিশ্চিত সেখান থেকে করোনা ছড়ায়নি!
কানাডা-আমেরিকা কিন্তু অধিকাংশ সময়েই আক্রান্ত ব্যক্তিটি কোন দেশে থেকে এসেছে বা কোন দেশে ভ্রমনে গিয়েছিলো সুনির্দিষ্টভাবে সে তথ্য বলে না। কোন দেশের নাগরিক সেটিও বলে না। এটি ব্যক্তির প্রতি সম্মান, মানুষের প্রতি সম্মান। এই সম্মানটা মানুষকে দেখাতে হয়।
৬. সারা পৃথিবী একটা কঠিন সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর দেশগুলো জাতি ধর্ম, বণৃণ ভুলে গিয়ে এক মানুষ আপর মানুষের দিকে মমতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। আক্রান্ত মানুষটি, তার পরিবারের দিকে ভালোবাসার, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষ সেটি করবে না কেন? বাংলাদেশের মানুষ কেন প্রবাসীদের বিরুদ্ধে ঘৃনা ছড়াবে। যেই প্রবাসী তাদেরই সন্তান, ভাই কিংবা বন্ধু।
তাই বলি, ‘প্রবাসীরা দেশে করোনা ভাইরাস নিয়ে এসেছে’- এই ধরনের ঘৃনা ছড়ানো (হেইট স্পিচ) বন্ধ করুন, এখনি বন্ধ করুন। বরং মানুষের প্রতি ভালোবাসা দেখান, মনুষ্যত্ব দেখান। করোনা ভাইরাস কিন্তু মানুষের মনুষ্যত্বেরই পরীক্ষা নিচ্ছে।
এসি
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।