প্রমোশন লাভে অফিস প্রধানের মূল্যায়নের গুরুত্ব
প্রকাশিত : ২০:৫৩, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২২ | আপডেট: ২১:৪৫, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২২
অফিসকর্মে ব্যস্ত দুই সহকর্মী, চিত্র ধারণ- নূরেন
কর্মক্ষেত্রে নিজের দায়িত্ববোধ, সততা, কর্মনিষ্ঠা, কর্মপ্রিয়তা, কাজের গুণগতমান ও পরিমাণ, সহকর্মী, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এবং গ্রাহকের প্রতি সদাচারণ এবং সর্বোপরি মান সম্পন্ন অধিক কাজের জন্যই প্রমোশন। ভালো কাজের বিনিময়েই ভালো ভালো প্রমোশন, দ্রুততার সাথে প্রমোশন।
প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই অফিস প্রধান তার নিজ অফিসের সকলের কাজের পরিমাণ ও গুণগতমান মূল্যায়ন করে থাকেন এবং এ মূল্যায়নের উপর ভিত্তি করেই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ চূড়ান্ত মূল্যায়ন করে পদোন্নতি প্রদান করেন। যারা সততা ও নিষ্ঠার সাথে গুণগত মানে ও অধিক পরিমাণে ভালো কাজ করেন, তারাই শাখাপ্রধান কর্তৃক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে অধিক নম্বর পান, যেমনটি আমরা পরীক্ষার খাতায় সেরা উত্তর লিখে সেরা নম্বর পাই।
পরীক্ষার খাতায় যেমন খারাপ লিখে সেরা নম্বর পাওয়ার কোন সুযোগ নাই, ঠিক একইভাবে অফিসিয়াল পরিমণ্ডলে সঠিকভাবে কাজ না করে, সেরা মূল্যায়ন বা সেরা নম্বর পাওয়ার কোনো সুযোগ নাই।
ব্যাংকের মত প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা কর্মচারীবৃন্দের সততা, নিষ্ঠা, কাজের গুণগতমান ও পরিমাণ এবং আচার আচরণ মূল্যায়ন করার ক্ষমতা শাখা প্রধানের। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এ গুরুদায়িত্ব তার উপর ন্যাস্ত করা হয়ে থাকে। শাখাপ্রধান নিজে অধস্তনের মূল্যায়নপত্রে রেটিং করেন এবং তার সিনিয়র অথরিটি এ রেটিং যথাযথ মনে করে কাউন্টার স্বাক্ষর করলেই তা চূড়ান্ত হিসেবে বিবেচিত হয়, যা পরিবর্তন করার কোনো সুযোগ নেই। অতএব অফিস প্রধান তার অধঃস্তন সকলের জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ ও কত ক্ষমতাবান ব্যক্তিত্ব তা অনুধাবন করার বিষয়। ম্যানেজার বা অফিস প্রধান হচ্ছেন ম্যানেজমেন্টের লোক বা ম্যানেজমেন্টের প্রতিনিধি।
ব্যাংকের মতো পেশায় মোট ১০০ নম্বরের মধ্যে ৫৫ নম্বর সরাসরি শাখা প্রধানের হাতে থাকে। বাকী ৪৫ নম্বর ছকে বাঁধা। যেমন- ব্যাংকিং ডিপ্লোমায় ৬ নম্বর, শিক্ষাগত যোগ্যতায় ১৫ নম্বর, এক প্রমোশন হতে আরেক প্রমোশন পর্যন্ত (সাধারণত ৫ বছর) চাকরিকালের জন্য ১০ নম্বর, ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের বিবেচনা বা মূল্যায়নের জন্য ৯ নম্বর, পরিচ্ছন্ন ফাইলে ৫ নম্বর। সব মিলিয়ে ১০০ নম্বরের মধ্যে এ ৪৫ নম্বর ছকে বাঁধা।
শাখা প্রধানের হাতের ৫৫ নম্বর তার নিজস্ব বিবেচনা তথা qualitative judgement-এর উপর নির্ভরশীল। সেরা কাজে সেরা মূল্যায়ন, শতভাগ নম্বর। দায়িত্বে অবহেলা, অসততা ও আচরণে অনাচার হলে শাখা প্রধানের বিবেচনা যা হবার তাই হয়ে থাকে। প্রমোশনের ক্ষেত্রে বাস্তবে শাখা প্রধানের মূল্যায়ন প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করে।
প্রমোশন পাওয়ার ক্ষেত্রে শাখা প্রধানই তার মূল্যায়ন ও মতামতের মাধ্যমে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। ব্যাংকের চাকরিতে সফল হতে হলে অফিস প্রধান বা শাখা প্রধানের গুরুত্ব উপলব্ধিতে নিতে হবে।
চাকরিতে যোগদানকালে প্রায় সকলেই যোগ্যতা নিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। প্রমোশনের ক্ষেত্রে বাস্তব জীবনে যা ঘটার তাই ঘটে, যা দেখার তাই দেখি। কাজের ক্ষেত্রে ফাঁকি দিলে জীবন পুড়ে ছাই। কাজে ভালো নেই প্রমোশন নেই, ভালো পোস্টিং নেই, সম্মানের চেয়ার টেবিল ডেস্ক নেই, ভালো বেতন নেই।
তাহলে আছে কী? একই পদে চাকরিতে এসে যিনি প্রতিনিয়ত সেরা কাজ করলেন, তিনি প্রতিনিয়ত অফিস প্রধানের নিকট থেকে সেরা মূল্যায়ন পেয়ে পেয়ে সেরা পদে চলে গেলেন, সেরা জীবন উপহার পেলেন। যিনি প্রতিনিয়ত অফিস প্রধানকে ফাঁকি দিলেন ও অফিস প্রধানকে বিব্রত করলেন, অফিসের কাজে ফাঁকি দিলেন তথা নিজের কাজকে ফাঁকি দিলেন- তার জীবনটাই তো ফাঁকি হয়ে গেল! কী লাভ হল? কী লাভ হতে পারতো! সেরা মূল্যায়ন পেতে কীইবা লাগত? শুধুই প্রতিদিনের কাজ সেরাভাবে করা। প্রতিদিনের কর্মঘণ্টা সেরাভাবে ও সঠিকভাবে কাজে লাগানো। ঊর্ধ্বতনকে মেনে চলা, গ্রাহককে গুরুত্ব দেয়া, গ্রাহককে সম্মান করা, তাদের কাজ দ্রুততার সাথে করে দেয়া। মূল্যায়ন পেতে আর কীইবা লাগে?
কাজই তো মূল্যায়নের সোপান, কাজই তো মূল্যায়নের সিঁড়ি, কাজই তো প্রমোশনের সিঁড়ি ও কাজই তো প্রমোশনের সদর দরজা। কাজই তো মূল্যায়ন বয়ে নিয়ে আসে, আগামীতেও বয়ে নিয়ে আসবে। এর বিপরীতে চিত্র কী দেখি? কাজ নেই তো মূল্যায়ন নেই। মূল্যায়ন নেই তো প্রমোশন নেই। প্রমোশন নেই তো জীবনের উন্নতি নেই। প্রমোশন নেই তো সমৃদ্ধ জীবন নেই। প্রমোশন নেই তো সম্মানের সাথে জীবন যাপন নেই। এসবই তো হতে পারত, এসবই তো হতে পারে শুধু অধিক পরিমাণে কাজ করে অফিস প্রধানের নিকট থেকে অধিক মূল্যায়ন অর্জন করে।
কাজের মাধ্যমে অধিক মূল্যায়ন আদায় করে নিতে হয়। কাজের মাধ্যমে নিজের জীবনের উন্নয়ন, নিজের জীবনের সমৃদ্ধি ও নিজের জীবনের সম্মান সৃষ্টি করা কতই না সহজতর কাজ! এ অর্জনের পেছনে শুধুই কর্মক্ষেত্রে কর্মঘণ্টার সঠিক ও সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চতকরণ এবং অফিস প্রধানের মনোভাব বুঝে সেরা কাজ ও সেরা ফলাফল উপহার দেয়া। কর্মক্ষেত্রে ঘড়ির কাঁটায় মন না রেখে অনর্গল কাজে ডুবে থাকা, অনর্গল কাজ করে যাওয়া। সেরা কাজ উপহার দিয়ে অফিস প্রধানের মনে সেরাভাবে অবস্থান করে নেয়া। অফিস প্রধানের কাজই হচ্ছে অধঃস্তনকে কর্তৃপক্ষ সমীপে সুউচ্চ করে তুলে ধরা এবং তার প্রমোশন নিশ্চিত করা। যাদের কাজের উপর ভর করে অফিস বা শাখা এগিয়ে যায়, অফিস প্রধান তাদেরকেই সামনে তুলে ধরেন, তাদের জন্যই সুপারিশ করে প্রমোশন নিশ্চিত করেন।
ব্যাংকের মত পেশায় সেরা মূল্যায়ন পাওয়া অত্যন্ত সহজ কাজ। দায়িত্ব নিয়ে এবং দক্ষতার সাথে অধিক পরিমাণে কাজ করলেই শাখা প্রধান সন্তুষ্ট হন এবং বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদনে তিনি শতভাগ নম্বর প্রদান করে থাকেন। এর পাশাপাশি তিনি কর্মনিষ্ঠ, পরিশ্রমী ও দক্ষ কর্মীর মূল্যায়ন প্রতিবেদনে প্রমোশন সংক্রান্ত মন্তব্যের কলামে তাদের প্রমোশনের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সমীপে জোরালো সুপারিশ করে থাকেন। কিন্তু কার জন্য এ সেরা রেটিং? কার জন্য এ জোরালো সুপারিশ? যিনি সেরা কাজ করেন, সেরা আচরণ করেন এবং সেরাভাবে কাজ করে কর্মস্থলকে এগিয়ে নিয়ে যান, সেরা মূল্যায়ন তিনিই পান, সেরা মূল্যায়ন তাকেই করা হয়। সেরা কাজ যিনি করেন, সেরা মূল্যায়ন তার জন্যেই অপেক্ষায় থাকে।
বাস্তবে প্রত্যেক শাখা প্রধান প্রতিনিয়ত আশায় থাকেন তার অফিসের সকলে যেন প্রতিনিয়ত সততার সাথে ভালো কাজ করেন, অধিক কাজ করে প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নিয়ে যান যাতে তিনি বছর শেষে সকলকে সেরাভাবে মূল্যায়ন করে তাদেরকে জীবন চলার পথে এগিয়ে নিতে পারেন। ঊর্ধ্বতনের সেরা মূল্যায়নে অধঃস্তন সহকর্মী যখন এগিয়ে যান এবং জীবনযুদ্ধে ও কর্মপরিসরে অধঃস্তন যখন অত্যন্ত সফল হন, অফিস প্রধান বা শাখা প্রধান সত্যিকারের তৃপ্তি তখনই পান।
কবির ভাষায়-
"ধূসর মরুর উষর বুকে একটি যদি শহর গড়
একটি জীবন সফল করা তাহার চাইতে অধিক বড়।"
শুধুমাত্র সেরা কাজের মাধ্যমে অফিস প্রধানের মন জয় করে, সেরা মূল্যায়ন ও সেরা নম্বর প্রাপ্তি নিশ্চিত করা যায় এবং নিজের জীবনকে দ্রুততার সাথে এগিয়ে নেয়া যায়। শাখা পর্যায়ে ভালো কাজ করা মানে ম্যানজারকে ম্যানেজ করা, ম্যানেজারকে সন্তুষ্ট করা এবং নিজের প্রমোশন নিজেই নিশ্চিত করা। কারণ প্রমোশনের ৫৫% নম্বর বা ৫৫% প্রমোশন ম্যানেজারের হাতেই ন্যাস্ত থাকে। নিজের কাজের মধ্যেই এ নম্বর বা প্রাপ্তি নিহিত থাকে। কাজের মাধ্যমে আমরা প্রমাণ করতে পারি-
"আমার প্রতিষ্ঠানের কাজ আমার
আমার প্রমোশন আমার হাতে।
অধিক পরিশ্রম করার ক্ষমতা আমার
অধিক প্রমোশনও আমার হাতে।"
ইউএসএর জেনারেল মটরস কোম্পানির সিইও ম্যারি বাররার ভাষায়, "একটি প্রতিষ্ঠানের সকল কর্মকর্তা কর্মচারী যখন বলে কাজটি আমার তখন প্রতিষ্ঠানটি এগিয়ে যায় এবং সেরা অবস্থান দখল করে নেয়। বিনিময়ে প্রতিষ্ঠানও তাদেরকে এগিয়ে নেয় এবং সেরা অবস্থানে আসীন করে।"
কর্মবিমুখ জীবন জগদ্দল পাথুরে জীবন, অলস জীবন অপ্রাপ্তির জীবন, কর্মহীন জীবন ব্যর্থ জীবন এবং বিরস জীবন। কর্মপ্রিয় জীবন হল সুন্দর জীবন, কঠোর পরিশ্রমের জীবন হল প্রতিষ্ঠিত জীবন, প্রাপ্তির জীবন, ফুলের মতো সুশোভিত ও সুভাসিত জীবন। পরিশ্রমীর জীবন গৌরবময়, গৌরবোজ্জ্বল ও সোনালী জীবন।
কবির ভাষায়-
"সোনার বাটি ভেঙ্গে ফেলে পাথরে
পাথর পাথরই রয় সোনা থাকে আদরে।"
লেখক: উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বেসিক ব্যাংক লিমিটেড
এএইচএস/এনএস//
আরও পড়ুন