প্রশাসনের সদিচ্ছার অভাবেই আটকে আছে ডাকসু নির্বাচন
প্রকাশিত : ২০:১৬, ৩ ডিসেম্বর ২০১৭ | আপডেট: ১০:০৩, ৪ ডিসেম্বর ২০১৭
শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায় ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার মাধ্যম হিসাবে ১৯২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে যাত্রা শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)। সর্বশেষ ১৯৯০ সালে সেনা শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসন আমলে ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর দীর্ঘ ২৭ বছর পার হলেও নির্বাচনের দেখা মিলছে না। চলতি বছরের ৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ তম সমাবর্তনে রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ ডাকসু নির্বাচনের বিষয়ে দিক নির্দেশনামূলক বক্তব্য রাখেন। আর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কেন ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে না এ মর্মে চলতি বছরের ১৯ মার্চ হাইকোর্ট রুল জারি করেন। এর পরেও ডাকসু নির্বাচনের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। সুশীলসমাজ ও ছাত্র সংসদের সাবেক নেতারা বলছেন, ক্ষমতাসীন ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রসাশনের সদিচ্ছার অভাবে আটকে আছে এ নির্বাচন। এছাড়া নির্বাচন না হওয়ার পেছনে রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশই প্রাধান্য পাচ্ছে বলেও মনে করেন তারা।
ক্ষমতাসীনরা তাদের অনুসারী ছাত্র সংগঠনটির প্রতি ভরসা রাখতে পারছেন না বলেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের সমস্যা-সংকটের কথা জানানোর ফোরামবঞ্চিত। আর জবাবদিহিতা না থাকায় প্রভাবশালী ছাত্রনেতারা আখের গোছানোর কাজে দিন-রাত ব্যস্ত। একসময় খেয়ে না খেয়ে ছাত্রনেতারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়ে অধিকার আদায়ে সোচ্চার থাকতেন। এখন সেই যুগের পরিবর্তন এসেছে। প্রায় সবাই এখন নিজের কাজে ব্যস্ত। নিজ দলের কর্মীদের সঙ্গে কিছুটা যোগাযোগ থাকলেও সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকারের বিষয়ে তাদেরকে সরব দেখা যায় না। এপরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উদ্যোগ নিতে হবে বলে মনে করছেন সাবেক ডাকসু নেতারা। সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবি, বিশ্ববিদ্যালয় চলার পেছনে অন্যতম বড় অংশীজন হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে ডাকসু নির্বাচন বন্ধ থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে শিক্ষার্থীদের কোনো প্রতিনিধি নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটের মাত্র দুই শতাংশ বরাদ্দ থাকে গবেষণার খাতে। আর প্রায় ৮২ শতাংশ বরাদ্দ থাকে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন খাতে। কিন্তু ডাকসু কার্যকর থাকলে এই অন্যায্যতা সম্ভব হতো না।
ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠান না হওয়ার পিছনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে দায়ী করছেন সাবেক ডাকুসর নেতারা। যারা কি না বছরের পর বছর ধরে আঁকড়ে আছেন উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, প্রক্টর, প্রভোস্ট, রেজিস্ট্রার, কোষাধ্যক্ষের মতো প্রশাসনিক সব পদ। ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন না হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নির্বাচন, সিনেট ও সিন্ডিকেট এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নির্বাচন নিয়মিতই অনুষ্ঠিত হচ্ছে। স্বার্থসিদ্ধির প্রক্রিয়া সুসংহত রাখতে অনেকটা আনুষ্ঠানিকভাবেই এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। চলতি বছরের ২৯ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের জন্য যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সেখানে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব রাখার জন্য সোচ্চার বামপন্থী ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয়রা। তাদের এই উচ্চারণে বাধসাধেন খোদ শিক্ষকরা! শুধু বাধ সেধেই ক্ষান্ত থাকেননি রাজনৈতিক দলের অনুগত সেই শিক্ষকরা। বাকবিতাণ্ডা ও হাতাহাতিতেও লিপ্ত হয়েছেন তাদেরই সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু নির্বাচন আয়োজনে সুন্দর একটি পরিবেশ দরকার। যেখানে সব দলের প্রতিনিধিদের ক্যাম্পাসে অবস্থা নিশ্চিত করে নির্বাচন আয়োজিত হবে। নব্বই-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ তিন দফা ক্ষমতায় থাকলেও ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগের আগ্রহ দৃশ্যমান হয়নি। উল্টো সংগঠনটির নেতারা বলছেন, ছাত্র সংসদের বিকল্প ভূমিকা পালন করেছেন তাঁরা। এছাড়া বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন ছাত্রদলও এ নির্বাচনের আগ্রহ দেখাইনি। অবশেষে গত ১০ আগস্ট ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে উন্মুক্ত আলোচনার আয়োজন করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন। তবে ছাত্রলীগ ওই আলোচনায় অংশ নেয়নি। উল্টো এতে অংশ নিতে আসা ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের ধাওয়া দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে সরকার সমর্থিত এ সংগঠনের বিরুদ্ধে।
ডাকসু নির্বাচনের বিষয়ে জানতে চাইলে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি বিভাগের এমিরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ইটিভি অনলাইনকে বলেন, “সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চায় না ছাত্র সংসদ নির্বাচন হোক। যখন যে দল ক্ষমতায় আসে তাদের কেউই ডাকসু নির্বাচনের বিষয়ে আগ্রহী থাকে না। ক্ষমতাসীনরা নেতৃত্বের ক্ষেত্রে একচেটিয়াভাব বজায়ে রাখতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে চায় না। ক্ষমতাসীন শাসকদল চায় না তাদের জনপ্রিয়তার ভাটা প্রকাশ্যে আসুক। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মনে করে ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ছাত্র প্রতিনিধি প্রশাসনের উপর খবরদারি করবে। এ আশঙ্কা থেকেই তারা নির্বাচন দিতে চায় না।
ডাকসুর সাবেক ভিপি ও বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির বর্তমান সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ইটিভি অনলাইনকে বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের একমুখী কর্তৃত্ব কমে যাওয়ার শঙ্কা থেকেই ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। তবে ডাকসু নির্বাচনের জন্য রাষ্ট্রপতির নির্দেশনামূলক বক্তব্যের পর ডাকসু নির্বাচনের ব্যাপারে আমরা আশাবাদী। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করেন ডাকসু নির্বাচন অবশ্যই হতে হবে। এব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, অতি রাজনীতিকরণ ও বিরাজনীতির হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অপরিহার্য। যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তুলতেও এর বিকল্প নেই। শিক্ষার্থীদের রাজনীতি থেকে দূরে রাখতেই ডাকসুকে অকার্যকর করে রাখা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডাকসুর সাবেক ভিপি আ স ম আব্দুর রব বলেন, ডাকসু নির্বাচন শিক্ষার্থীর গণতান্ত্রিক অধিকার। অনতিবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ডাকসু নির্বাচন দেওয়ার জন্য দাবি জানাচ্ছি।
ডাকসুর সাবেক ভিপি ও বিএনপির নেতা আমানউল্লাহ আমান ইটিভি অনলাইনকে বলেন, “আমরা জাতীয় নেতৃত্বে এসেছি ডাকসুর কল্যাণে। কিন্তু দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে ডাকসু নির্বাচন না দেওয়ায় জাতীয় নেতৃত্বে বড় ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়েছে। ডাকসু নির্বাচনের অনুপস্থিতিতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।” নির্বাচন না দেওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “সরকার ভাবছে ডাকসু নির্বাচন দিলে তাদের ছাত্র সংগঠন নেতৃত্বে আসতে পারবে না। তাই তারা নির্বাচন দিচ্ছে না।”
ডাকসু নির্বাচনের বিষয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন ইটিভি অনলাইনকে বলেন, “ডাকসুসহ সব হল ছাত্র সংসদ নির্বাচন আমাদের প্রাণের দাবি। এমনকি নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করতে প্রসাশনের সাথে আলোচনাও করেছি। কিন্তু কোন অদৃশ্য কারণে নির্বাচন আটকে আছে এটা আমার জানা নেই। এছাড়া নির্বাচের আয়োজন করা আমাদের কাজ নয়। এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসাশনের কাজ। তারা নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করবে। আমরা অংশগ্রহণ করবো। আমরা নেতৃত্ব গ্রহণের পর থেকেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের খাবারের সমস্যা, যাতায়াত সমস্যাসহ সব বিষয়ে ডাকসুর ভূমিকা পালন করছি। এমনকি গতকাল রাজধানীর সাত কলেজের ছাত্রদের অধিকার আদায়ে নেতৃত্বও দিয়েছি।”
এবিষয়ে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাজিব আহসান ইটিভি অনলাইনকে বলেন, “আমরা চাই ডাকসুসহ সব ছাত্র সংসদ নির্বাচন হোক। কিন্তু সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসাশনের সদিচ্ছার অভাবে নির্বাচন আটকে আছে। আসলে দেশ পরিচালনা জন্য যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হলে ডাকসু নির্বাচনের বিকল্প নেই। এই নির্বাচনের দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসাশনকেই নিতে হবে।”
এ বিষয়ে ছাত্র ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক স্নেহাদ্রী চক্রবর্তী রিন্টু ইটিভি অনলাইনকে বলেন, “ডাকসু নির্বাচন না হওয়ার জন্য সরকারের সদিচ্ছার পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দায়ী। ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ার কারণে শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস ও দখলদারিত্বই কেবল বাড়েনি, শিক্ষার পরিবেশও বিঘ্নিত হয়েছে। এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, সরকার-সমর্থক ছাত্রসংগঠনটির বাইরের নেতা-কর্মীদের ক্যাম্পাসে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে। এ অবস্থার উত্তরণ তথা শিক্ষাঙ্গনে সুস্থ ছাত্ররাজনীতি চর্চার জন্য ডাকসু নির্বাচনের বিকল্প নেই।”
এদিকে সম্প্রতি জাতীয় সংসদে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ডাকসুসহ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদগুলোর নির্বাচন না হওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাহসের অভাবকে দায়ী করেছেন। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, ডাকসু নির্বাচন আয়োজনে সদিচ্ছার কোনো অভাব নেই।
ডাকসু নির্বাচন প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নতুন উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান বলেন, “ডাকসু নির্বাচন বিরাট একটা বিষয়। আর সাথে জড়িত রয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক নিরাপত্তা, জাতীয় রাজনীতি এসকল বিষয় সমন্বয় করে নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করা দরকার। এসকল বিষয় মাথায় রেখে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। সার্বিক বিষয় সমন্বয় হলে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে।”
টিআর/টিকে
আরও পড়ুন