ঢাকা, বুধবার   ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪

প্রশ্ন ফাঁসের সমাধান কোথায়

প্রকাশিত : ২৩:৫২, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ২৩:০৭, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

সরকারের একটি মন্ত্রণালয়ের নির্বাহী প্রধান হচ্ছেন মন্ত্রী। তার নির্দেশ পালন করেন মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক প্রধান সচিবসহ অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ। যদিও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের পরামর্শ নেন মন্ত্রীরা, আমলারা নিজেদের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার আলোকে মন্ত্রীদের বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তারপরও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসে মন্ত্রীর তরফ থেকে, মন্ত্রীর স্বাক্ষরেই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। তাই যেকোন মন্ত্রণালয়ের সফলতা বা ব্যর্থতার দায়ভার চাপে মন্ত্রীর কাঁধে। সফলতার জন্য বাহবা না পেলেও ব্যর্থতার জন্য সমালোচনার হাত থেকে রেহাই পান না কোনো মন্ত্রী। তবে উন্নত এবং অনুন্নত বিশ্বে এই চিত্র ভিন্ন হয়।

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা বর্তমানে ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে বলে নানামহলে আলোচনা সমালোচনা চলছে। প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা, জুনিয়র সমাপনী পরীক্ষা, মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে হরহামেশা। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা, মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা এমনকি বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস হয়েছে বলে গণমাধ্যমে বারবার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ফাঁস হওয়া প্রশ্নের মধ্যে বিভিন্ন চাকুরীর নিয়োগ পরীক্ষাসহ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নও রয়েছে।  এবছর এসএসসির সকল প্রশ্নপত্র পাওয়া গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, যা পরীক্ষার প্রশ্নের সাথে হুবহু মিলে গেছে।

সরকারের পক্ষ থেকে নানারকম পদক্ষেপ নেওয়া হলেও রোধ করা যাচ্ছে না প্রশ্নপত্র ফাঁস। সরকারী প্রেস, যেখানে প্রশ্নপত্র ছাপানো হয় সেখানাকার কর্মচারী, বিভিন্ন কোচিং সেন্টার, স্কুল এবং কলেজের শিক্ষকসহ বেশ কিছু সন্দেহজনক ব্যক্তিকে আটক করেও ফল হচ্ছেনা। গত কয়েকদিনে ঢাকা চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে জড়িত সন্দেহে কয়েকজন শিক্ষকসহ বেশ কয়েকজনকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আটককৃতরা বিগত কয়েক বছর ধরে প্রশ্নপত্র ফাঁস করছিল বলে দাবী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। এদিকে প্রশ্নফাঁসের প্রমাণ পেয়েছে সরকার গঠিত পরীক্ষা মূল্যায়ন কমিটি। তার মধ্যে কোনটির আংশিক ও একটির পুরোপুরি প্রশ্নফাঁস হয়েছে। আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেবে কমিটি। কমিটির মতে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে অনেক হাইপ্রোফাইল ব্যক্তি জড়িত থাকতে পারে, যাদের নজরদারিতে রেখেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এবারের এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছিলেন। গত ৪ ফেব্রুয়ারি প্রশ্নফাঁসকারীদের ধরিয়ে দিতে ৫ লাখ টাকা পুরস্কারেরও কথা ঘোষণা করেন তিনি। এরপর গত ১২ ফেব্রুয়ারি পরীক্ষা কেন্দ্রের আশপাশে ২০০ মিটারের মধ্যে মোবাইল ফোন বহন করার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। দেওয়া হয় গ্রেফতারের নির্দেশ। পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসরোধে এগিয়ে  এসেছে মহামান্য হাইকোর্টও। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রশ্নফাঁসে জড়িতদের খুঁজে বের করতে ও প্রশ্নফাঁস প্রতিরোধে করণীয় নির্ধারণে বিচার বিভাগীয় ও প্রশাসনিক কমিটি গঠন করে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। এতকিছুর পর এখন পর্যন্ত ঠেকানো যায়নি প্রশ্ন ফাঁস। ২৫ ফেব্রুয়ারি এসএসসি পরীক্ষা শেষ পর্যন্ত হওয়া পর্যন্ত কতগুলো প্রশ্ন ফাঁস হয় আর সরকার নতুন কি কি পদক্ষেপ নেয় সেটা সময়েই বলে দেবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেশের শিক্ষাব্যবস্থা দেখভাল করা। যেহেতু একের পর এক প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে এবং সেটা প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে মন্ত্রণালয়, তাই স্বাভাবিক ভাবেই শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের পদত্যাগের দাবী উঠেছে। রাজনৈতিক, শিক্ষাবিদসহ সুশীল সমাজে এ দাবী জোরালো হচ্ছে। এমনকি সরকারের শরীক জাতীয় পার্টির এক নেতা সংসদে শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ দাবী করেছেন। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি সোমবার জাতীয় সংসদে সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেছেন শিক্ষাক্ষেত্রে প্রশ্নফাঁসের মহামারীর কারণে শিক্ষার্থীই শুধু নয় অভিভাবকদেরও সরকার সম্পর্কে বিরুপ ধারণা জন্মাচ্ছে। এর আগে গণ মাধ্যমে খবর এসেছিল, শিক্ষামন্ত্রী নাকি প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে পদত্যাগের ইচ্ছা পোষণ করেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শিক্ষামন্ত্রীকে দায়িত্ব পালন করে যেতে নির্দেশ দিয়েছেন। তবে এবার শিক্ষামন্ত্রী খোদ উড়িয়ে দিলেন পদত্যাগের কথা। একটি অনলাইন নিউজপোর্টালে দেখলাম শিক্ষামন্ত্রী বলছেন, “আমার পদত্যাগ করা নিয়ে কিছু অনলাইনে নিউজ প্রকাশ করা হয়েছে। পদত্যাগের ফাইল নাকি প্রধানমন্ত্রীর টেবিলে জমা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতালি সফর থেকে দেশে ফিরলেই আমি পদত্যাগ করতে যাব।” তিনি আরো বলেন, “এসব সংবাদের কোনো সত্যতা ও ভিত্তি নেই। আমার পদত্যাগ করার মতো কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। কোনো অন্যায়কারীকে আমরা প্রশ্রয় দেই না। শক্তহাতে তা প্রতিরোধ করা হচ্ছে। আমাকে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য কিছু গণমাধ্যমে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে।“

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে অবশ্য একটি ব্যতিক্রম ছাড়া পদত্যাগের কোন নজির নেই। কোন এক অজানা কারণে পদত্যাগ করেছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজ। এছাড়া আর কোন মন্ত্রী চেয়ারের মোহ ছাড়তে পারেন নি। আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরও কয়েক মন্ত্রী পদত্যাগ করেননি, এমন পরিস্থিতিও হয়েছে বাংলাদেশে। শুধু বাংলাদেশ নয়, তৃতীয় বিশ্বের প্রায় সবগুলো দেশে একই চিত্র দেখা যায়। তবে এসব ক্ষেত্রে সরকারের কর্তাব্যক্তির আশ্রয় প্রশ্রয়ও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

উন্নত বিশ্বে দায় স্বীকার করে পদত্যাগের ভুরি ভুরি নজির দেখা যায়। অতি সাম্প্রতিক সময়ে আমার আপাত আবাস যুক্তরাজ্যে এক মন্ত্রী লর্ড বেটস পদত্যাগ করেছেন শুধু পার্লামেন্টে প্রশ্নোত্তর পর্বে ৬০ সেকেন্ডেরও কম দেরীতে আসার কারণে। ব্যর্থতা বা কোনো ধরনের বিতর্কে জড়ালেতো কথাই নেই, কালবিলম্ব না করে পদ ছেড়ে দেন মন্ত্রীসহ সরকারের কর্তাব্যক্তিরা। ওয়াটারগেট কেলেংকারীতে জড়িয়ে পদত্যাগ করেছিলেন খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন। যদিও একই ধরনের কেলেংকারিতে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠার পরও ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী পদত্যাগ করেননি। যুক্তরাজ্যে ইউরোপিয় ইউনিয়ন ত্যাগের প্রশ্নে অনুষ্ঠিত গণভোটে হারার পদ প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দিয়েছিলেন ডেভিড ক্যামেরন। এছাড়া যৌন কেলেংকারীতে জড়িত থাকার অভিযোগে কাছের বন্ধু ফার্স্ট সেক্রেটারি অব স্টেট ডমিয়েন গ্রিনকে বরখাস্ত করেছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে।

আবার বাংলাদেশের কথাই আসি। যে প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে এত বির্তক যাতে শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগের দাবী উঠেছে, তার সমাধান কি? এক মন্ত্রী পদত্যাগ করলেই কি প্রশ্নপত্র ফাঁস হবেনা? এমন আশা করা মনে হয় বোকামি হবে। অতীতের দিকে তাকালে দেখা যায় পুলিশ সদর দফতরের তথ্য মতে দীর্ঘ দিন ধরে প্রশ্নপত্র ফাঁস হলেও ১৯৭৯ সালে এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা প্রথম ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। বিএনপিসহ চার দলীয় জোট সরকারের শাসনামলে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের এক সদস্য প্রশ্নপত্র ফাঁসের সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ওই সময় দুটি পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠে। গোয়েন্দা সংস্থা ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রসহ জড়িতদের আটক করে। এ ঘটনা আর আলোর মুখ দেখেনি। এরই ধারাবাহিকতায় প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। ২০১০ সালে রংপুরে সরকারি মাধ্যমিক স্কুলশিক্ষক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে গোয়েন্দা জানতে পারেন তিনস্তরে কাজ করে প্রশ্নপত্র ফাঁসকারী সিন্ডিকেট। বিজি প্রেস ও পিএসসির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রয়েছে প্রথম স্তরে। দ্বিতীয় স্তরে রয়েছে সারা দেশে শিক্ষা দপ্তর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী, শিক্ষক এবং কোচিং সেন্টারের মালিকেরা । সর্বনিম্ম স্তরে কাজ করে মাঠ পর্যায়ের দালালরা।

এ সমস্যার সমাধান করতে হলে দেখতে হবে প্রশ্নপত্র তৈরি এবং পরীক্ষার হলে পৌঁছানো পর্যন্ত এতে কারা থাকেন। প্রশ্ন পত্র তৈরিতে নিয়োজিত কমিটি কতটুকু বিশ্বস্ত সেটা খতিয়ে দেখা উচিত। তাদের শিক্ষাজীবন হতে শুরু করে আদর্শ, রাজনৈতিক কার্যকলাপ এমনকি পারিবারিক ইতিহাসও ঘেটে দেখা দরকার। তাদের মধ্যে কেউ সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য এমন করছে, এমন আশংকা অমূলক নয়। আবার এসব প্রশ্নপত্র যেখানে ছাপা হয়, সে প্রেসের কেউ এ কাজ করছে কিনা সেদিকেও কড়া নজর রাখতে হবে। বিজি প্রেসের কয়েক কর্মচারীকে আটক করা হয়েছিল, যার মধ্যে একজন জেলে মারা যান। তার মৃত্যু নিয়ে অনেক রহস্য রয়েছে, সেটিও খতিয়ে দেখা উচিত। প্রশ্নপত্র পরিবহনের সময়ও ফাঁস হতে পারে। ইদানিং দেখা যাচ্ছে পরীক্ষার কয়েক ঘণ্টা পূর্বে ফাঁস হচ্ছে প্রশ্নপত্র। তাহলে সেটা সংশ্লিষ্ট কেন্দ্র থেকে হতে পারে। এসব কিছু বিবেচনা করে সরকারকে সর্বশক্তি নিয়োগ করে সিন্ডিকেট ভাঙ্গতে হবে। এতে যদি রাঘববোয়াল কেউ জড়িত থাকে তাতে পিছপা হওয়া যাবেনা। বিভিন্ন সময় আটককৃতরা জানিয়েছে, বর্তমানের এমসিকিউ পদ্ধতি যতদিন থাকবে ততদিন প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করা যাবে। সরকার বিষয়টি আমলে নিয়ে এমসিকিউ পদ্ধতি বাতিলের চিন্তাভাবনা করছে বলে জানিয়ে শিক্ষা সচিব মো. সোহরাব হোসাইন বলেছেন, প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে পরীক্ষা পদ্ধতিই পাল্টে ফেলা হবে। আগামী বছর থেকে নতুন পদ্ধতিতে এসএসসি পরীক্ষা নেওয়া হবে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও নাকি পরীক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তনের জন্য সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে। ফলে আগামীতে আর কোনো পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হবেনা বলে আশান্বিত হয়ে গদির স্বাদ নিতে পারেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ।

লেখক: চীফ নিউজ এডিটর, চ্যানেল আই ইউরোপ


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি