ঢাকা, বুধবার   ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪

প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে হবে

প্রকাশিত : ১৩:০২, ৩ মার্চ ২০১৮ | আপডেট: ১০:০৬, ৮ মার্চ ২০১৮

কেমন চলছে বাংলাদেশের শিক্ষা? আমার মত চার দশকেরও বেশি পাঠদান করা কোন শিক্ষককে এমন প্রশ্ন করা হলে ম্লানমুখে কিছুক্ষণ নীরব থাকতে হবে। তারপর ধীরে ধীরে আমার কণ্ঠে বেদনা, ব্যর্থতা, দুঃখ, ক্ষোভ, অভিযোগ, প্রতিবাদ, জ্বালা ইত্যাদির প্রকাশ দেখা যাবে।

সাফল্য বা ভালো লাগার কথা কি থাকবে না? থাকবে। মুখমণ্ডল আমার উজ্জ্বল হয়ে ওঠে যখন মফঃস্বলের রাস্তা দিয়ে যাবার সময় বাংলাদেশের সব অঞ্চলেই দেখি সারি বেঁধে মিছিল করে বালিকার দল স্কুলে যাচ্ছে বা স্কুল থেকে ফিরছে। সরকার যে প্রতি পয়লা জানুয়ারিতে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত সব জায়গায় বিনামূল্যে বহুবর্ণ সব বই পৌঁছে দেয় শিক্ষার্থীদের হাতে, সেকথাও বড় মুখ করে বলা যায়। প্রাথমিক স্তরে স্কুলে যাওয়ার বয়সী প্রায় একশ’ ভাগ শিশুকে ভর্তির আওতায় আনা গেছে। এসব নিঃসন্দেহে সুখকর সংবাদ।

২০১০ সালে এই স্বাধীন বাংলাদেশে একটা জাতীয় শিক্ষানীতি সংসদে গৃহীত হয়েছিল। এটাও ছিল একটা বড় মাপের কাজ। কিন্তু, এবার অনেকগুলোর কিন্তুর কথা বলতে হবে। ২০১০ সালে গৃহীত ওই শিক্ষানীতিতে যেসব সুপারিশ করা হয়েছিল, সাত বছর অতিক্রান্ত হয়ে যাবার পর তার কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে?

এই বিষয়ে যদি সরকার বা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জবাবদিহিতা চাওয়া হয়, বোধ হয় তাদের মিন মিন করা ছাড়া বিকল্প কোন উত্তর থাকবে না। সবচেয়ে বেদনা ও উৎকণ্ঠার কথা এই যে, এখন মনে হয় না যে সরকার ২০১০ সালের ওই শিক্ষানীতি বিষয়ে আর কোন দায় বোধ করে। আমরা বিশেষভাবে ওই শিক্ষানীতি বিষয়ে উৎসাহিত বা আশাবাদী ছিলাম। ব্যক্তিগতভাবে আমি ওই শিক্ষানীতির সপক্ষে বহু জায়গায় বক্তৃতা দিয়েছি, বেশ কিছু লেখা লিখেছি। করণীয় অনেক বিষয়ের উল্লেখ ছিল ওই শিক্ষানীতিতে। সর্বপ্রধান যে সুপারিশ ছিল তা হল, শিক্ষার প্রাথমিক পর্যায়কে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত উন্নীত করা। উন্নত ও উন্নয়নশীল সব দেশেই এই ব্যবস্থা প্রচলিত। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক স্তর শেষ করতে পারলে ১৪/১৫ বছরের বালক/বালিকা এমন কিছু দক্ষতা অর্জন করতে পারে, যাতে তারা নিজেদের পরবর্তী জীবন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

তাছাড়া প্রাথমিক শিক্ষা যেহেতু বাধ্যতামূলক, তাই সব নাগরিকের জন্য অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার ব্যবস্থা করার জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা যায়। কিন্তু বেদনা ও ব্যর্থতার কথা হল, শিক্ষানীতিতে সুপারিশকৃত প্রাথমিক শিক্ষার এমন উন্নয়নে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সক্রিয় উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। গত বছরের সংবাদপত্রের একটি খবরে দেখেছি, সরকার এখন বিষয়টাকে বাদ দিতে চাইছে। অথচ আমরা যে প্রতিষ্ঠানকে ‘মহান সংসদ’বলি, এবং এমপিদের দৌর্দণ্ডপ্রতাপ ভূমিকা সম্পর্কে নানা কাহিনী শোনা গেলেও, প্রতিদিন নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণ এবং মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হচ্ছি এমন সরব ঘোষণা সত্ত্বেও প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত উন্নীত করার বিষয়ে সরকার সচেতনভাবে উদাসীন, নীরব ও নিষ্ক্রিয়।

শিক্ষানীতির বিভিন্ন সুপারিশ অবহেলার বিষয়টা গভীরভাবে বেদনাদায়ক ও হতাশাজনক বলে সেই প্রশ্নটা আগেই তুললাম। তা না হলে বাস্তবতার দিক থেকে বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস তো আবশ্যিকভাবেই সবচেয়ে বড় খবর এবং আলোচনার সর্বশীর্ষে। দু’দশক আগে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ধর্ষণ বা নারী নির্যাতনের সংবাদ পড়ে আমরা অস্বস্তি বোধ করতাম, প্রতিবাদ-মিছিল আয়োজিত হত, ওই কলঙ্কের কলুষ যেন দেশের আমাদের মত সংবেদনশীল নাগরিকদের মুখ ঢাকতে প্ররোচিত করত। এই অপরাধ এখন এমন ব্যাপকতা লাভ করছে, বোধহয়, দেশের কোথাও ধর্ষণ কলঙ্কবিহীন কলুষহীন কয়েক’ একর জমি খুঁজে পাওয়া যাবে না।

পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের বিষয়টা যেন ব্যাপকতার দিক থেকে নারী নির্যাতনের মাত্রাকেও ছাড়িয়ে গেছে। এক অপ্রতিরোধ্য মহামারী সমাজকে আক্রমণ করেছে। এই ব্যাধির কোনো প্রতিষেধক তো কার্যকর হলোই না, এমনকি যেসব পদক্ষেপকে প্রতিরোধী এন্টি-বায়োটিক হিসেবে ব্যবহার করা যাবে বলে মনে হয়েছিল, সেগুলিও প্রয়োগক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। মহামারী ও কলঙ্ক যে কী ভয়াবহ তা বুঝতে পারি যখন সংবাদ পাওয়া যায় যে, অনেক অঞ্চলে প্রথম শ্রেণী থেকে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত বিদ্যালয়ের আওতাধীন পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁস হচ্ছে এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে শক্তিধর প্রশ্নপত্র ফাঁসকারী চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে যে, সে প্রতিটি বিষয়ে প্রশ্ন আগে ফাঁস করে দেবে, এবং ব্যাপারটা ঠিক সেইভাবেই ঘটছে, এবং ঔদ্ধত্যের মাত্রাটা এমন যে, ওই অপরাধী তার ফোন নম্বরটিও জানিয়ে দিচ্ছে। আর সত্যিই শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিছু করতে পারল না, সচেতনে এবং নীরবে তারা দেখল ২০১৮ সালের চূড়ান্ত মাধ্যমিক পরীক্ষার সব বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে গেল।

ব্যর্থতাকে স্বীকার করে নিয়ে এই মন্ত্রণালয় এতটাই ব্যাকফুটে যে, প্রথম দিনের পর কর্তাব্যক্তিরা আর টিভি সাংবাদিক সমভিব্যহারে পরীক্ষা কেন্দ্র পরিদর্শন করতে যাননি, আগের বারের মত জোর কণ্ঠে অস্বীকার করে বলেননি যে, প্রশ্নপত্র ফাঁসের মত কোন ঘটনা ঘটেনি। শুধু সমাজ থেকে যে গুঞ্জন উঠেছে, এর দায় নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নেতৃবৃন্দের পদত্যাগ করা উচিত কিনা তার প্রতিক্রিয়ায় কিছু কঠিন শব্দ শ্রবণ করেছি আমরা। পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের কলঙ্ক কী এমনই উড়ো ধুলো যে তা আমাদের সত্যিকারের উন্নয়ন প্রক্রিয়ার গায়ে সামান্যও বর্ণবিচ্যুতি ঘটাবে না?

সরকারের গায়ে কালির ফোঁটা লাগছে না, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। পরীক্ষায় (এবারের এসএসসি) প্রশ্নফাঁসের অপরাধী হিসেবে দেড় শতাধিক ব্যক্তিকে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেফতার করেছে। আমার ঘোর আশঙ্কা, এদের মধ্যে সিংহভাগের বিরুদ্ধে আইনমাফিক অপরাধ প্রতিষ্ঠিত করার প্রক্রিয়ায় সমস্যা দেখা দেবে। আটক করার বিষয় তো আগেও ঘটেছে, কিন্তু কারো বড় ধরনের শাস্তি হয়েছে সে কথা জানা যায়নি। এমন অপরাধীদের মধ্যে কারো কারো বিশেষ সংগঠন বা গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগ থাকার কথা শোনা গেছে। অভিজ্ঞতা বলে, ধর্ষক সদস্যকে বহিষ্কার করেই সংগঠন দায়মুক্তি গ্রহণ করে, তার অপরাধের শাস্তি প্রদান করার জন্য কোনো সক্রিয় ভূমিকা পালন করে না। এখন আমরা শুনছি, পরের বছর পরীক্ষা পদ্ধতিতে বা প্রশ্নপত্র প্রণয়নে আরো উন্নত সংস্কার সাধন করা হবে। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই বিষয়ে জোর দিচ্ছে না যে, যেসব অপরাধী ধরা পড়েছে তাদের দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালে শাস্তি দেয়া হবে; অপরাধের মূল হোতাদের যে কোন মূল্যে আটক করা হবে। দুষ্টের দমন না হলে অপরাধ বাড়তেই থাকবে, তা বুঝেও তাদের ভূমিকায় কোন সর্বব্যাপী তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না।

প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণীর প্রশ্নপত্র ফাঁসের ক্ষেত্রেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার কথা শোনা যায়নি। পুলিশের হাতে যেসব অপরাধী ধরা পড়েছে, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন শিক্ষক আছেন। প্রাথমিক সমাপনী এবং জুনিয়র সার্টিফিকেট পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁস হয়েছে। এই অপরাধটাকে তো সমাজ ও নৈতিকতার দিক থেকে দেখতে হবে। দেশের সাত থেকে চৌদ্দ বছরের শিশু শিক্ষার্থীরা প্রতি বছর দেখছে, প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। স্কুলের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষায় এবং পাবলিক পরীক্ষায়। এ যেন গ্রীষ্মকালে আম পাকা অথবা বর্ষায় বৃষ্টিপাতের মত স্বাভাবিক বিষয়। যে অনৈতিকতাকে  দূরে সরিয়ে রাখাই শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য, তা পূরণের কোনো উদ্যোগ নেই। শিক্ষা কর্মকর্তাদের জন্য এটা যেন কোন সমস্যাই নয়। শিক্ষার্থীরা নকল দেখছে, প্রশ্নপত্র ফাঁস দেখছে, শিক্ষকদের অনৈতিক কাজে লিপ্ত হতে দেখছে, দেখছে অভিভাবকরা তাদের জন্যই পকেটের পয়সা খরচ করে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র কিনছে দামাদামি করে। আর এরাই আমাদের ভবিষ্যৎ নাগরিক, এমন কথাইতো আমরা বলে থাকি। সমাজের নৈতিক অবক্ষয় একটা অবশ্যম্ভাবী এবং প্রায় অপ্রতিরোধ্য বাস্তবতা বলে স্বীকার করে নেওয়া হচ্ছে। শিক্ষাব্যবস্থা কেমন চলছে সেই উত্তর পাবার জন্য অন্যসব উপাদানের বিচার-বিশ্লেষণ না করলেও তো চলে।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় ছাত্রভর্তির ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ অন্যান্যদের চেয়ে অনেকটা এগিয়ে থাকলেও শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। আমাদের শিক্ষার্থীরা যে ভালভাবে শিখছে না, সেকথা বলা হচ্ছে বেশ কয়েক বছর ধরেই, এমনকি যখন ফলাফল প্রকাশের বেলায় এ প্লাস পাবার বন্যা দেখা গেছে তখনো। এই পরিস্থিতির বিস্তার ঘটেছে প্রধানত দু’টি কারণে। পরীক্ষায় ভালো ফল করার একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থাকে বিপথগামী করে তুলেছে। এখন আর স্কুলে শিক্ষার্থী ভর্তি হয় না, ভর্তি হয় পরীক্ষার্থী। শেখার প্রশ্নটা গৌন হয়ে গেছে শিক্ষকদের কাছে, শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কাছে, অভিভাবকদের কাছেও, আর শিশু শিক্ষার্থীরা এমন এক কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে মুখস্থ পাঠ, নোটবইনির্ভর পড়াশোনা, কোচিং-এর চাপ এবং মডেল টেস্ট ছাড়া পড়াশোনা বলতে আর কিছু বোঝে না। অতএব আমরা দেখছি, হাজার হাজার এ প্লাস পাওয়া সফল পরীক্ষার্থী পরবর্তী পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষায় ভাল করতে পারছে না। অন্য কারণটা হল, যতই ঢাক ঢোল বাজিয়ে, কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও প্রকাশ করা হোক না কেন, ওই সব বই শিক্ষার্থীদের সত্যিকারভাবে আকর্ষণ করতে পারে না, শিখতে তাদের আগ্রহী করে তোলে না। বিষয়বস্তু ও অধ্যায় বিন্যাসের ক্ষেত্রে নানা ঘাটতি থেকে যায়।

ঢাকাসহ দেশের বহুসংখ্যক নামকরা স্কুলে সরকার বা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড প্রকাশিত বই পড়ানো হয় না। নোটবই গাইডবই অনুসরণ করে পড়ানো হয়। পরীক্ষার যে ধারা আমরা তৈরি করেছি, তাতে এনসিটিবি-র পাঠ্যপুস্তক কাজে লাগে না।

মাসাধিক কাল আগে আমাদের দেশের শিক্ষাচিত্রের একটা আলাদা দৃশ্যমান রূপ সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। টেলিভিশনের কল্যাণে সারা দেশের মানুষ তা দেখেছে। ঢাকার প্রেস ক্লাবের সামনে, শহীদ মিনার চত্বরে হাজার হাজার শিক্ষক সমবেত হয়েছেন। একদল জড়ো হয়েছেন, তাদের এমপিওভুক্তির দাবি নিয়ে, অন্যদল চায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সরকারীকরণ। না, এরা বিরোধী কোন দল নয়। মাধ্যমিক শিক্ষকদের বিশাল অংশ সরকারের কাছ থেকে বেতনের নিরাপত্তা চান। তাদের মধ্যে বহুজনই নাকি বিগত ১৫/২০ বছর ধরে বিনা বেতনে চাকরি করেছেন, তাদের করুণ সংলাপ শুনেছি, সন্তানদের আবদার মেটাতে পারেন না, নানা কিছু। এত বছর বেতন না পেয়েও তারা বিকল্প চাকুরির খোঁজ করেননি। সমগ্র জমায়েতের মধ্যে দারিদ্র্যের লক্ষণ যে তেমনভাবে শনাক্ত করা গেছে তা-ও বলতে পারব না। সরকারীকরণের অন্তর্ভুক্ত হয়নি এমন প্রাথমিক শিক্ষকরাও অনশন করেছেন। এর পরে ঢাকায় সমবেত হয়েছেন এবতেদায়ী মাদ্রাসার শিক্ষকবৃন্দ। নিজের অথবা পরিবারের কারো নামে স্কুল স্থাপন করে, নিয়োগের ক্ষেত্রে পছন্দের ব্যক্তিকে অগ্রাধিকার দিয়ে এবং যোগ্যতার ওপর মনোযোগ না দিয়ে দেশে নিম্ন মানের শিক্ষা প্রদানের একটা ধারা সৃষ্টি হযেছে। সরকার এসব বিষয়ে যুক্তিযুক্ত নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেনি, আবার জনসংখ্যার চাহিদা অনুযায়ী নির্দিষ্ট দূরত্বে যথাযথ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা না করে এক এলোমেলো পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। অনশনরত শিক্ষকবৃন্দ ব্যানারে লিখেছিলেন ‘না খেয়ে ভালো মানের শিক্ষা দেওয়া যায় না’। অকাট্য সত্যি কথা। ভালো মানের শিক্ষার জন্য যা যা করা দরকার, সরকার তার সুচিন্তিত ও দায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। যথাযথ ও যোগ্য কর্তৃপক্ষ সৃষ্টি করে শিক্ষাব্যবস্থাপনায় বিকেন্দ্রীকরণের উপযোগিতা থাকলেও বাংলাদেশের কোন সরকারই দলীয় স্বার্থনিরপেক্ষভাবে এমন চিন্তাকে প্রশ্রয় দেয়নি।

আমাদের দেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার সুদূরপ্রসারী প্রভাবের কথা আমরা এখন আর আলোচনা করি না। আমাদের সংবিধানে ১৭ সংখ্যক ধারায় বলা আছে, দেশের সব মানুষকে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সাক্ষরতা প্রদান করতে হবে। আমরা আর তিন বছরের মধ্যে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করব। কিন্তু স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে যে অর্জনের কথা বলি না কেন, দেশের আনুমানিক চল্লিশ ভাগ মানুষ এখনো নিরক্ষর। বাস্তব সাক্ষরতার হারে আমাদের অগ্রগতি অত্যন্ত শোচনীয়।

আনুষ্ঠানিক প্রাথমিক/মাধ্যমিক শিক্ষায় ভর্তির হার ভাল হলেও সমাপনী হার অত্যন্ত দুঃখজনক। অর্থাৎ বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী শিক্ষার প্রথম পর্যায়ে অথবা মাঝপথে ঝরে পড়ছে। এটা রোধ করার বিষয়ে এবং সাক্ষরতা কর্মসূচির বিস্তার ও সাফল্য বিষয়ে সরকারি উদ্যোগ তেমন দ্রষ্টব্য নয়। অথচ বর্তমান প্রশাসনিক কাঠামো, শিক্ষা অবকাঠামো এবং কিছু আর্থিক বরাদ্দ বৃদ্ধির মাধ্যমে যদি এ বিষয়ে গুরুত্ব প্রদান করা হয়, তাহলে দেশের উৎপাদনশীলতা দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে।

আমাদের প্রাথমিক/মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত বৈষম্য সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করেছে। মুক্ত স্বাধীন দেশে আমাদের শপথ ও পরিকল্পনা ছিল, দেশে একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু হবে, তখন আমাদের লক্ষ্য ছিল বৈষম্যবাদী ক্যাডেট কলেজ ও মাদ্রাসাশিক্ষার সংস্কার সাধন। শৈশব/কৈশোরে আমাদের ভবিষ্যৎ নাগরিকরা যাতে বিভেদ পন্থার মাধ্যমে বেড়ে না ওঠে, তাদের সবাইকে যেন দেশীয় সংস্কৃতির চর্চায় ও দেশগঠনে ভূমিকা রাখার জন্য একই ধারার শিক্ষায় প্রশিক্ষিত করে তোলা যায়, তেমন একটা অভিন্ন পাঠক্রমের মাধ্যমে সবাইকে প্রস্তুত করার অঙ্গীকার ছিল। সেই পথে আমরা সত্যিই হয়তো এগোতে পারতাম, যদি ১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্টের বিপর্যয় না ঘটত।

আমাদের দেশের মহাস্থপতি ও স্বাধীনতাযুদ্ধের মহানায়ককে হত্যার মাধ্যমে এদেশের সাংস্কৃতিক পরিচয় নিয়েই নতুন করে সংকট সৃষ্টি হয়। এই রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সামাজিক প্রতিক্রিয়ায় আমাদের জাতীয় পরিচয়কে গৌণ করে ধর্মীয় পরিচয়কে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের সংখ্যাবৃদ্ধির মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের মধ্যে সামাজিক বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে। একই শহরে বা স্থানে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল, সরকারি স্কুল, নিবন্ধনকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা, ক্যাডেট কলেজ বা আবাসিক স্কুল ইত্যাদির বিস্তার সমাজে বিভক্তি সৃষ্টি করেছে। এই বিভক্তি এখন এমন বাস্তবতা যে, দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে একমুখী করার কোনো প্রকল্পও নেওয়া সম্ভব নয়। মাদ্রাসা শিক্ষা আগ্রাসনী আয়তনে বাড়ছে। সরকারের নীরব নির্দেশনায় স্কুলপাঠ্য বিষয়কে সাম্প্রদায়িক চরিত্র দেওয়া হচ্ছে। মাদ্রাসা শিক্ষার মধ্যেও নানান বিভিন্নমুখী ধারা বিদ্যমান। তাদের সমবেত শক্তি বাংলাদেশের অনাদি সংস্কৃতিকে আক্রমণ করতে চায়। দেশের শিক্ষা সমন্বয়বাদী না হয়ে দিন দিন বিরোধাত্মক হয়ে উঠেছে। আমরা সবাই অশনি সংকেত শুনতে পাচ্ছি।

লেখক : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক।


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি