প্রশ্নফাঁসে ক্ষতিগ্রস্ত মেধাবীরা
প্রকাশিত : ১৫:৩৩, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ২৩:৪৫, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
এতোদিন চাকরিসহ বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এখন মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা এমনকি জেএসসি-প্রাথমিকের প্রশ্নও ছড়িয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীদের হাতে হাতে। হয় পরীক্ষার আগের রাতে কিংবা পরীক্ষার দিন সকালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বদৌলতে প্রশ্নপত্র পৌছে যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের হাতে হাতে। চলমান মাধ্যমিক পরীক্ষায়ও প্রশ্নফাঁস প্রমাণের বহু খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ প্রশাসনের পক্ষ থেকে বহু উদ্যোগের কথা বলা হলেও কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছে না এটি। প্রশ্নফাঁস যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এতে সবচেয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ছেন মেধাবী শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা।
অতিসম্প্রতি অনুষ্ঠিত এসএসসির বাংলা প্রথম পত্রের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ উঠে। এটির সুরাহা হওয়ার আগেই একই বিষয়ের দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের জোরালো অভিযোগ উঠে। ফেসবুকে ফাঁস হাওয়া প্রশ্নের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হওয়া পরীক্ষারের প্রশ্নের হুবহুব মিলও পাওয়া গেছে। ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র ও পরীক্ষার মূল প্রশ্নের মিলের বিষয়টি তুলে ধরে গণমাধ্যমে সচিত্র সংবাদও প্রকাশ হয়েছে।
কিছুদিন আগে অনুষ্ঠিত প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের কারণে বরগুনার বেতাগীর ১৪০টি বিদ্যালয়ের গণিত পরীক্ষা বাতিল করা হয়।। এরও কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিট ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রফাঁসের অভিযোগ ওঠে।
এতো গেল পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের নমুনা। এবার আসা যাক চাকরির পরীক্ষার কথায়। গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি বড় নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ উঠে। অতিসম্প্রতি (১৬ জানুয়ারি) অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রায়ত্ব আট ব্যাংকের সমন্বিত নিয়োগ পরীক্ষা বাতিল করা হয় প্রশ্নফাঁসের কারণে। গত বছরের ১৯মে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকে সিনিয়র অফিসার পদের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নের সঙ্গেও ফাঁস হওয়ার প্রশ্নের মিল পাওয়া যায়। ফলে ওই পরীক্ষা স্থগিত করে। নার্সিং অ্যান্ড মিড ওয়াইফারি অধিদপ্তরের অধীনে সিনিয়র স্টাফ নার্স নিয়োগের পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের কারণে বাতিল করে হয় গত ৬ অক্টোবর।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পরীক্ষার আগের রাতে মোটা অংকের টাকায় কেনা-বেচা হয় এসব প্রশ্ন। একটি অসাধু মহল ওইসব পরীক্ষা আয়োজনকারী কিংবা দায়িত্বপালনকারী ব্যাক্তিবর্গের সঙ্গে যোগসাজগে আগেই প্রশ্ন পেয়ে যায়। পরে সতর্কতার সঙ্গে চাকরি প্রার্থী কিংবা পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। কোনো কোনো সময় একটি নির্দিষ্ট স্থানে পরীক্ষার্থীদেরকে রেখে প্রশ্ন ও উত্তর দিয়ে দেওয়া হয়। চাকরি প্রার্থীরা ওই স্থানে রাতযাপন করে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন ও সমাধান থেকে প্রস্তুতি নিয়ে পরদিন পরীক্ষায় অংশ নেয়। আবার অনেক সময় টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন সরাসরি নির্দিষ্ট কিছু পরীক্ষার্থীদের হাতে পৌছে যায়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সেই প্রশ্নের স্ক্যানড কপি মুঠোফোনে থাকা ইন্টারনেট ব্যবহার করে ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নতুন ভাবনায় ফেলেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। বিভিন্ন ফেসবুক আইডি ও ম্যাসেঞ্জার গ্রুপ থেকে চাকরির নিয়োগসহ বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বিজ্ঞাপন দিয়ে ফাঁস করা হচ্ছে। সেখানে নির্দিষ্ট মোবাইল ফোন নম্বরও দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ নম্বরে চাহিদা মতো টাকা পাঠালে পুরো প্রশ্নপত্র পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগে মিলছে। এগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে ছড়িয়েও পড়ে। এছাড়া পরীক্ষার দিন সকালেই কেন্দ্র থেকে প্রশ্নপত্র কেন্দ্রের বাইরে অপেক্ষমান শিক্ষার্থীদের হাতে চলে আসে। ছাত্রছাত্রীরা সেই ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই পরীক্ষা দেয়।
এ বিষয় শিক্ষাবিদেরা বলছেন, অবিলম্বে প্রশ্নফাঁস বন্ধ করতে না পারলে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থার মেরুদণ্ড ভেঙে পড়বে, মেধাহীন হবে জাতি। তারা বলছেন, প্রশ্ন ফাঁসের কারণে একদিকে যেমন দুর্বল মেধার শিক্ষার্থীরা ভালো ফল করে এগিয়ে যাচ্ছে, অন্য দিকে যোগ্য লোক বঞ্চিত হচ্ছে তার কাঙ্ক্ষিত ফল ও চাকরি থেকে। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও মেধাবীরা কাঙ্ক্ষিত চাকরি না পাওয়ায় তাদের মধ্যে বাড়ছে হতাশা। তাদের অনেকের নৈতিক স্খলন হয়ে জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। এদের একটি বড় অংশ হতাশা থেকে মুক্তির পথ খুঁজছে মাদকে। এই করুণ পরিণতি এখনি ঠেকাতে না পারলে ভয়াবহ সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে।
এ বিষয় ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ড. শ্রী কান্ত কুমার চন্দ একুশে টেলিভিশনকে বলেন, প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করতে কাজ করছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। বিষয়টির তদন্ত চলছে। প্রামাণ মিললে সে যেই হোক না কেন, কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হবে। তিনি বলেন, একটি মহল থেকে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য প্রশ্নপত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব সোহরাব হোসেন একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে বলেন, পরীক্ষা শুরু হলে দেখা যায় ফাঁস হওয়া প্রশ্নের কপির সঙ্গে মূলপ্রশ্নের হুবহু মিল। এর কারণ হলো কিছু অসাধু কর্মকর্তা টাকার বিনিময় প্রশ্নফাঁস করছে। মোবাইল দিয়ে ছবি তুলে সামাজিক মাধ্যেমে ছড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন আর পরীক্ষার মূলপ্রশ্নের মিল পাওয়া যাচ্ছে। এটা যারা করছে তাদের নৈতিকতার অভাব। প্রশ্নফাঁস রোধে সরকার সহ সকলের সস্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে বলেন, এসএসসি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের প্রমাণ মিললে পরীক্ষা বাতিল করা হবে। প্রশ্নফাঁসের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, কিছু অসৎ শিক্ষকের কারণে বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস হচ্ছে। প্রতিটি কেন্দ্রে পরীক্ষার দিন আধা ঘণ্টা আগে প্রশ্ন ছাপিয়ে পরীক্ষা নেওয়ার কথা হয়েছে। কিন্তু আমরা যখন বুঝলাম আসল প্রশ্নফাঁসকারী শিক্ষক তখন প্রশ্ন আধা ঘণ্টা আগে দিয়েই লাভ কী। আপনারা তাদের চিহ্নিত করছেন না কেন-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা চিহ্নিত করতে চেষ্টা করছি। তবে এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে।
শিক্ষামন্ত্রী আরও বলেন, কিছু শিক্ষক ক্লাসে না পড়িয়ে বাড়িতে বা কোচিংয়ে পড়ান। এরাই মূলত প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত। তিনি বলেন, এসএসসি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস রোধে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, আধা ঘণ্টা আগে পরীক্ষার হলে প্রবেশ, এক সপ্তাহ আগেই কোচিং সেন্টার বন্ধ, পরীক্ষার হলে ছাত্রদের পাশাপাশি শিক্ষকদেরকেও মোবাইল ফোন নিয়ে ঢুকতে না দেওয়া, কেন্দ্র প্রধানকে ক্যামেরাবিহনী ফোন ব্যবহার প্রভৃতি।
এদিকে শিক্ষামন্ত্রীর এমন বক্তব্যকে দায় এড়ানোর চেষ্টা বলে মন্তব্য করেছেন শিক্ষকরা। তারা বলছেন, শিক্ষামন্ত্রী কথায় কথায় শুধু শিক্ষকদের দোষারূপ করে বক্তৃতা-বিবৃতি দিচ্ছেন। এটা না দিয়ে প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। শুধু বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েই কেউ নিজের দায় এড়াতে পারেন না। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে, প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ শিক্ষা ক্ষেত্রে সব দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে।
এ বিষয়ে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আনু মোহাম্মদ একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, শুধু শিক্ষক নয়, শিক্ষক থেকে শুরু করে মন্ত্রী পর্যন্ত প্রশ্নফাঁস প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। সবসময়ই দেখে আসছি, শিক্ষামন্ত্রী কোথাও প্রশ্নফাঁস হলে অথবা নকলের অস্তিত্ব পাওয়া গেলে এবং তার কাছে অভিযোগ দিলে, তার মধ্যে অস্বীকার করার প্রবণতা কাজ করে। এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা কাজ করে। শুধু তাই নয় পুরো বিষয়টিকে ধামাচাপা দেওয়ার প্রবণতাও কাজ করে তার মধ্যে। এতদিন পর তিনি স্বীকার করছেন প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত শিক্ষকরা। শিক্ষামন্ত্রীর কাছে আমার প্রশ্ন তিনি এতদিন তাহলে এদের (প্রশ্নফাঁসে জড়িত শিক্ষক) রক্ষা করেছেন কেন? তাদের কথা অস্বীকার করছেন কেন? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেলে প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে আসলে কারা জড়িত তা বুঝা যাবে। তবে এবিষয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে আরও গুরু দায়িত্ব নিয়ে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।
প্রশ্নফাঁসকে জাতির জন্য বিপজ্জনক হিসেবে দেখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রফেসর ইমেরিটাস সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে বলেন, প্রশ্নফাঁস ঘটনার সঙ্গে আমাদের নৈতিক বিষয়টি জড়িত। সমাজে অনৈতিকতা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। এটাই তার প্রমাণ। এখন প্রশ্নফাঁস হলে আগে মা-বাবাও দৌড়ান ফাঁস হাওয়া প্রশ্ন যোগার করার জন্য। সন্তানও মা-বাবাকে দ্বিধাহীনভাবে বলছে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন যোগার করে দিতে। কারণ প্রশ্ন যোগার করতে না পারলে তার সন্তানও প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। যে বাবা মা সন্তানকে নৈতিকতা শিক্ষা দিবে সে বাবা মা যদি সন্তানকে অনৈতিক সুবিধা দিতে কাজ করেন তাহলে আমাদের সমাজ নৈতিকতা শিখবে কিভাবে? এই যে চিত্রটা এটা জাতির জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক।
/ এআর /