ঢাকা, শনিবার   ২১ ডিসেম্বর ২০২৪

ফজল-এ-খোদা যেন আরেক নজরুল

মোহাম্মদ মাসুদ খান

প্রকাশিত : ০০:৪৮, ৯ মার্চ ২০২৩ | আপডেট: ০০:৫০, ৯ মার্চ ২০২৩

ফজল-এ-খোদা

ফজল-এ-খোদা

৯ মার্চ ২০২৩ কবি, গীতিকার, সম্পাদক ও শিশু সংগঠক ফজল-এ-খোদা’র ৮২তম জন্মবার্ষিকী। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে তার রচিত গান ‘জনতার সংগ্রাম চলবেই চলবে দিন রাত অবিরাম আমাদের স্বাধীনতা কামী মুক্তিযোদ্ধা ও আপামর জনসধারণকে উদ্দীপ্ত করেছে দারুণভাবে।

২০০৬ সালে বিবিসির জরিপে নির্বাচিত সর্বাকালের সেরা গানের তালিকায় ১২ তম স্থান পাওয়া তাঁর লেখা ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানটি ১৯৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালীন সময় এবং মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে শহীদস্মৃতি স্মরণে সর্বাধিক প্রচারিত শ্রোতা নন্দিত জনপ্রিয় গান।
এছাড়াও তাঁর রচিত অসংখ্য গান ষাট, সত্তর, আশি ও নব্বই দশক জুড়ে মানুষের মুখে মুখে শোনা যেতো। ফজল-এ-খোদা’র উল্লেখযোগ্য গান সমূহ ছিলো
‘যে দেশেতে শাপলা শালুক ঝিলের জলে ভাসে’,
‘বাসন্তী রঙ শাড়ী পড়ে কোন বঁধুয়া চলে যায়’,
 ‘ভালোবাসার মুল্য কত আমি কিছু জানি না’,
 ‘ভাবনা আমার আহত পাখীর মতো পথের ধুলোয় লুটোবে’,
‘কলসি কাঁধে ঘাটে যায় কোন রূপসী’,
আমি প্রদীপের মত রাত জেগে জেগে’,
‘প্রেমের এক নাম জীবন[m1] ’,
‘আমি বন্ধু প্রেমে হইলাম পাগল’,
‘ঢাকা শহর ঘুরতে এসে ঘুরছি গোলক ধাঁধায়’ ইত্যাদি অজস্র গান।

এছাড়াও গানের উপর ফজল-এ-খোদার ৭ টি সংকলন প্রকাশিত হয়েছে।
ইসলামী গানের দুটি সংকলন ইসলামী গান (১৯৮০) ও বন্দেগী (২০০২),
ছোটদের উপযোগী ফুল পাখিদের গান (১৯৮৬),
দেশপ্রেমের গান নিয়ে মন্দিরা (১৯৯৭), নির্বাচিত গানের সংকলন (১৯৯৭)।
পল্লিগীতি, ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া, কীর্তন, শ্যামা, ভজন ইত্যাদি লোক সংগীতের বিভিন্ন ধারার গানের সংগ্রহ কাজল মাটির গান (২০১২), সংগীত ভাবনা (২০১২)।
 
ফজল-এ-খোদা কবিতা, প্রবন্ধ, নাটকও লিখেছেন ।
১৯৬৮ সালে বেরিয়েছে তাঁর কবিতার বই ‘সূর্য স্বর্ণ দ্বীপ’,
১৯৭৩ সালে ‘বিতর্কিত জ্যোৎস্না’,
১৯৯০ সালে ‘নামে যার কেঁপে ওঠে’,
২০০৮ সালে ‘তাড়া করে অশুভ সময়’ এবং
২০১৪ সালে ‘নির্জন পক্তিমালা’।
শিশু কিশোরদের জন্য তিনি অনেক লিখেছেন।
১৯৭৭ সালে ‘মিতা ভাইয়ের আসর’,
১৯৯০ সালে ‘আড়ি’,
২০০০ সালে ‘নাটক নাটক’,
২০০১ সালে ‘জয় মুক্তিযুদ্ধ’
২০০৭ সালে ‘রবীন্দ্র নজরুল বঙ্গবন্ধু জয়নুল’,
২০১১ সালে ‘রয়েল বেঙ্গল’,
২০১২ সালে ‘আড়ং’ ইত্যাদি।
 সব মিলিয়ে ফজল-এ-খোদা রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ত্রিশেরও অধিক। 
শিশু কিশোর সংগঠন শাপলা শালুকের আসরের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক ছিলেন ফজল-এ-খোদা।
শিশু কিশোরদের মাসিক পত্রিকা ‘শাপলা শালুক’ সত্তর দশকে তাঁর অসাধারণ সম্পদনায় প্রকাশিত হতো।
 
বাংলার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম যেমন কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস, শিশু সাহিত্য সহ সাহিত্যের সকল শাখায় রাজত্ব করেছেন তেমনি এবছর মরণোত্তর একুশে পদক প্রাপ্ত ফজল-এ-খোদা’র  তেমনি বিচরণ  দেখা যায় বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায়।  

কাজী নজরুল একাধারে ইসলামী গান যেমন লিখেছেন তেমনি শ্যামা সংগীতও লিখেছেন। ফজল-এ-খোদা’র বেলায়ও তেমনি ঘটনা দেখা যায়। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে কলম ধরে নজরুল লিখেছেন তাঁর বিদ্রোহী কবিতা ‘কারার ঐ লৌহ কপাট …’। 

ঠিক তেমনি ফজল-এ-খোদা পাকিস্তানী শাসনের বিরুদ্ধে এবং আমাদের মুক্তি সংগ্রামে লিখেছেন ‘জনতার সংগ্রাম চলবেই চলবে রাত দিন অবিরাম। ব্রিটিশ শাসনামলে কাজী নজরুল ইসলাম তার বিদ্রোহী লেখনীর জন্য কারাবরণ করেন।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে নিহত হলে ফজল-এ-খোদাকেও কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়।

ত্রিশের দশকে নজরুল ধূমকেতু পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন  আর ফজল-এ-খোদা সত্তর দশকে বেতার বাংলা ও শাপলা শালুক পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন।

ফজল-এ-খোদা ছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের একজন একনিষ্ঠ ভক্ত। নজরুল বিষয়ে তাঁর প্রচুর পড়াশোনা ও জ্ঞান ছিলো। ১৯৮৮-৮৯ সালের ঘটনা । ফজল-এ-খোদা তখন তৎকালীন রেডিও বাংলাদেশের সহকারী আঞ্চলিক পরিচালক। আগারগাও এ অবস্থিত বেতার ভবনের নীচ তলায় তিনি বসতেন। বেতারের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে বহু গুণীজন তাঁর দপ্তরে আসতেন। তিনি তাঁদের কে দারুন শ্রদ্ধা করতেন। একদিন ফজল-এ-খোদার অফিসে আসলেন প্রখ্যাত দার্শনিক অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ যিনি কবি নজরুলের সমসামিয়ক ছিলেন। ফজল-এ-খোদা অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ কে পেয়ে ভীষণ আনন্দিত হলেন। 

তাঁর আসন ছেড়ে অধ্যক্ষ আজরফকে তাঁর পাশে বসালেন। ফজল-এ-খোদা তাঁর পাশে কাগজ কলম নিয়ে বসলেন এবং দেওয়ান আজরফ কে অনুরোধ করলেন ‘স্যার আপনি তো নজরুলের খুব কাছের বন্ধু এবং বিদ্রোহী কবি কে খুব কাছ থেকে দেখেছেন, দয়া করে নজরুল সম্পর্কিত কয়েকটি ঘটনা বলেন?’ অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ তখন ত্রিশের দশকের একটি বিয়ের অনুষ্ঠানের ঘটনা বললেন যেখানে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ও ছিলেন। ফজল-এ-খোদা ২০২১ সালের ৪ জুলাই কভিড এ আক্রান্ত হয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ৮০ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তারও ৪৫ বছর পূর্বে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তৎকালীন পিজি হাসপাতলে ৭৭ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।

বিদ্রোহী কবি নজরুল যেমন মৃত্যুর বহুকাল আগ থেকে বাক শক্তি হারান ঠিক তেমনি গীতিকবি ফজল-এ-খোদাও মৃত্যুর ৫-৬ বছর আগে ডিমেন্সিয়ার আক্রান্ত হয়ে স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। তাঁদের দুজনের তুলনামুলক আলোচনায় বলা যায় ‘ফজল-এ-খোদা যেন আরেক নজরুল’। ফজল-এ-খোদার ৮২তম জন্মবার্ষিকীতে তাই তাঁর প্রতি রইলো আমাদের বিন্ম্র শ্রদ্ধা ও একই সাথে কামনা করছি তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা।

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, শেরেবাংলা নগর শাপলা শালুকের আসর।


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি