ঢাকা, রবিবার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪

ফিরিয়ে দিন আমার প্রভাতফেরী

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৮:২৫, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহান কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে বিশ্বব্যাংক, আইএলও, ইউএনডিপি এবং বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে পরামর্শক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বই- বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি, অর্থনীতি-কড়চা, Freedom for Choice প্রভৃতি।

একুশের যে শৈশব স্মৃতি আমার মনে গেঁথে আছে, তা হচ্ছে- একুশ ফেব্রুয়ারীর প্রভাতফেরী। বরিশালের সেই শীতের সকাল। এমন পাঁচটি শীতের সকালে বিছানা ছাড়তে বড় অনীহা। শুধুমাত্র এবং একমাত্র ওই একুশের সকাল ভিন্ন। তার আগের রাতে উত্তেজনায় ঘুমুতে পারি না। উৎকর্ণ হয়ে থাকতাম কখন প্রভাত হবে, আর কখন বন্ধুরা এসে ডাকবে।

তারপর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এসে উপস্থিত হতো। বন্ধুরা এসে ডাক দিতো, আর আমি বেরুতাম ঘরের বাইরে। নগ্নপদ বন্ধুদের মুখে মৃদু হাসি, হাতে ফুলের গুচ্ছ। চারদিকে মৃদু কুয়াশা, ভোরের আলো ফুটছে- বড় পবিত্র চারপাশ। তারপর সবাই মিলে নগ্নপদে যাত্রা শুরু শহীদ মিনারের দিকে। আমাদের কচিকণ্ঠে প্রতিধ্বণিত হতো- ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি?’ সেই কৈশোরের একুশ ফেব্রুয়ারীর বহু কথাই মনে নেই, কিন্তু প্রভাতফেরীর স্মৃতি আজো ভুলিনি।

কেউ বলেনি, কেউ নির্দেশ দেয়নি, কেউ সাজায়নি, কিন্তু সেই প্রথম থেকেই একুশ উদযাপনের সবচেয়ে পবিত্রতম দিক ছিল প্রভাতফেরী- একুশে ফেব্রুয়ারী ভোরের আলো ফুটলেই স্বত:স্ফূর্ত নগ্ন পদযাত্রা মানুষের শহীদ মিনারের উদ্দেশ্যে। কেউ একা একা, কেউ পরিবার নিয়ে, কখনও বা যুথবদ্ধভাবে। ভোরের আলো ফুটছে, মানুষের শান্ত মিছিল চলছে ধীর পায়ে শহীদ মিনারের প্রতি, পুরুষদের পরিধানে পাজামা-পাঞ্জাবী, নারীদের সাদা শাড়ী, কালো পাড়। হাতে ফুলের মালা, পুস্পস্তবক। শিশুরাও আছে মা-বাবার হাত ধরে, তাদের কচি হাতেও ফুল।

সবার কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে- ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি’? সে অমর গান ছড়িয়ে পড়ছে আকাশে-বাতাসে। কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসছে আবেগে, সে গানের অনুরণন আমাদের প্রতি রোমকূপে - সে এক অনন্য অনুভূতি।

বড় মায়ায়, অনেক শ্রদ্ধায় আমরা হাতের ফুল নামিয়ে রাখছি মিনারের বেদীতে। না, ধাক্কাধাক্কি নেই, আগে যাবার প্রতিযোগিতা নেই, ছবি তোলার উদ্দামতায় একুশকে অবমাননা করার কোনও প্রচেষ্টা নেই। শহীদ মিনার থেকে আজিমপুর গোরস্থান শহীদদের সমাধিস্থলে। সেখানেও সারিবদ্ধ মানুষ ধীর নগ্ন পদযাত্রায়। শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার ছাপ প্রতিটি মানুষের মুখে, একটি পবিত্র কাজ সম্পন্ন করার প্রক্রিয়ায়। 

আজিমপুর থেকে গন্তব্যস্থল বাংলা একাডেমী। সেখানে বসেছে আলোচনা, গান আর কবিতাপাঠের আসর বটবৃক্ষের তলায়। সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছে এখানে-ওখানে। অনুষ্ঠান চলছে কোনও বিধিবদ্ধ নিয়ম না মেনেই। মানুষ আসছে, মানুষ যাচ্ছে, উপভোগ করছে গান, কবিতা, কথা বলা। 

আমাদের কৈশোরে যৌবনে এটাই তো দেখেছি একুশে ফেব্রুয়ারীতে। বাহুল্য নেই, বাণিজ্যিকতা নেই, রাজনীতি নেই- আছে শুধু ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা আর মমতা, বাংলা ভাষার প্রতি অপার মায়া আর নিজের ভাষার প্রতি দৃঢ অঙ্গীকার।

একুশে ফেব্রুয়ারীতে প্রভাতফেরীতে যাওয়া আমাদের কাছে ছিল প্রার্থনার মতো। বড় পবিত্র সে নগ্ন পদযাত্রা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখেছি সে প্রভাতফেরীতে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তাঁর ছাত্রজীবনে দেখেছি সে প্রভাতফেরীতে। একুশ শুরুই হত প্রভাতফেরী দিয়ে। সে প্রভাতফেরীর আমেজ পেতে চাইলে বর্তমান প্রজন্ম শহীদ জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটি দেখতে পারেন। 

আমি বহুকাল প্রভাতফেরীতে যাই না। আসলে ২০ ফেব্রুয়ারীর মধ্যরাতে একুশ শুরু হলে তার আর কোনও প্রভাতফেরী থাকে না। আমরা ভুলে যাই, মধ্যরাতে দিনের শুরু পাশ্চাত্য কায়দায়, প্রাচ্যে দিনের শুরু সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে। বাঙ্গালীর দিনের শুরু উষা লগ্নে।

একুশ আমাদের মুক্তি দিয়েছিল- মুক্তি দিয়েছিল চাপিয়ে দেয়া রাষ্ট্রভাষার শৃঙ্খল থেকে। কিন্তু সেই মুক্তিদাত্রী একুশকে আজ আমরা বন্দী করেছি বাণিজ্যিকতায়, লৌকিকতায়, স্থুলতায়, আনুষ্ঠানিকতায়, আত্মপ্রচারে। আমরা নষ্ট করেছি তার স্বত:স্ফূর্ততা, তার গাম্ভীর্য্য আর তার পবিত্রতা। এবারের একুশের সকালে আমার একটিই কেবল আকুল আবেদন, ‘একুশকে মুক্তি দিন সব আরোপিত কৃত্রিম শৃঙ্খল থেকে এবং আমার চিরায়ত প্রভাতফেরী আমাকে ফিরিয়ে দিন’।

এনএস/


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি