বগুড়ার দই ও ঘি অনলাইনে বিক্রি করছে গোয়ালা
প্রকাশিত : ১৪:০৮, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৭ | আপডেট: ২০:৪২, ৩ জানুয়ারি ২০১৮
উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী খাবার দই। বাংলার সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে দুগ্ধজাত এ খাবারটি। এক সময়ের বাংলার নবাব পরিবারের খাবার দই ছাড়া এখন বাংলার কোন ভোজ উৎসব ভাবাই যায় না। আর বগুড়ার দই হলে তো কথাই নেই! কিন্তু বাংলার বিখ্যাত বগুড়ার খাটি দই আর ঘি রাজধানীতে পাওয়াই এখন দুরুহ ব্যাপার। ভেজালের ভিড়ে কোনটি যে আসল বগুড়ার দই তাই বোঝা দায়। তবে এ কাজটিকেই সহজ করে দিচ্ছে একটি প্রতিষ্ঠান। রাজধানীতে নিজ ঘরে বসেই পাবেন বগুড়ার খাটি দই এবং ঘি। আর তাও অনলাইনেই। রাজধানীবাসীর জন্য এই নতুন উদ্যোগ নিয়ে কাজ করছে ‘গোয়ালা’।
এন্টারপ্রেনারশিপের সংজ্ঞানুযায়ী এন্টারপ্রেনারশিপ বা উদ্যোগ হচ্ছে নতুন কোন ব্যবসা অথবা পুরনো কোন ব্যবসাকেই নতুন উদ্যোগে ভিন্ন আঙ্গিকে পরিচালনা করা। আর যে এ উদ্যোগ নেয় সে হচ্ছেন উদ্যোক্তা। ‘গোয়ালা’ এ সংজ্ঞারই এক উত্তম উদাহরণ। সম্প্রতি ইটিভি অনলাইনের সঙ্গে বিশেষ এক সাক্ষাৎকারে অংশ নেয় গোয়ালা’র একজন উদ্যোক্তা। আলোচনা হয় গোয়ালার বিভিন্ন দিক নিয়ে। সাক্ষাৎকার নেন ইটিভি অনলাইনের সহ-সম্পাদক সোলায়মান শাওন।
ইটিভি অনলাইন: শুরুতেই জানতে চাইব আপনি ‘গোয়ালা’ পরিচয়েই কেন সাক্ষাৎকার দিবেন? আপনার পরিচয় কেন গোপন রাখতে চাইছেন?
গোয়ালা: আমি এবং আমার দলের বাকি সবাই চাই আমাদের উদ্যোগের নাম ‘গোয়ালা’ বেশি পরিচিতি পাক। গোয়ালা শুধু আমাদের প্রতিষ্ঠানের নামই না। আর এটি শুধু একটা শব্দও না। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলার ঐতিহ্য। আমরা চাই আমাদের ব্যক্তি পরিচয়ের থেকেও আমাদের প্রতিষ্ঠানটিকে মানুষ আরও বেশি চিনুক।
ইটিভি অনলাইন: আপনাদের শুরুর গল্পটা জানতে চাই।
গোয়ালা: আমরা প্রথমে দুই জন মিলে শুরু করি গোয়ালা। পরবর্তীতে আমাদের সঙ্গে আরও একজন যুক্ত হয়। উদ্যোক্তা হিসেবে আমরা তিন জন আছি গোয়ালাতে। প্রাথমিক চিন্তাভাবনা শুরু হয় ২০১৬ এর সেপ্টেম্বর মাসে। আর মূল কার্যক্রম শুরু করি সে বছরেরই ২১ নভেম্বর থেকে। বাংলার ঐতিহ্যবাহী খাবার দইকে কীভাবে তার ঐতিহ্যের মধ্যে রেখেই রাজধানীবাসীর কাছে আনা যায় সেই উদ্দেশ্য নিয়েই আমাদের যাত্রা শুরু। বগুড়ার স্থানীয় দই উদপাদনকারী কারখানার সঙ্গে ‘জয়েন ভেঞ্চার’ ভিত্তিতে আমরা একটি কারখানা নিয়ে শুরু করি।
ইটিভি অনলাইন: বগুড়া থেকে দই এনে ঢাকায় অনলাইনে বিক্রি করছেন। গুণগত মান কীভাবে বজায় রাখতেছেন?
গোয়ালা: গুণগত মান বজায় রাখতে আমরা সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করি। সাধারণত দই তৈরি হওয়ার পর সাধারণ তাপমাত্রায় ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত ভাল থাকে। বগুড়া থেকে দই তৈরি হওয়ার পর ক্ষেত্রবিশেষে পাঁচ থেকে আট ঘণ্টা সময় লাগে ঢাকায় পৌঁছে। ঢাকায় আসার পর সেগুলোকে আমরা ‘কিউসি’ করি। সেখান থেকে বাছাইকৃত দই এর সরা গুলোকে ‘চিলার’-এ রাখি। গ্রাহকরা যখন অর্ডার দেয় তখন এখান থেকেই সরবরাহ করা হয়।
এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আমরা দই এনে মজুদ করে রাখি না। যেদিন দই আসে ঢাকায় তার পরের দিনই সেগুলো গ্রাহকের কাছে সরবরাহ করা হয়। প্রি-অর্ডার ভিত্তিতে আমরা দই নিয়ে আসি বগুড়া থেকে। যে কারণে আমাদের দই নষ্ট হবার সুযোগও কম। আর আমাদের দই বিএসটিআই অনুমোদিত।
ইটিভি অনলাইন: আপনারা দই নিয়েই কেন কাজ শুরু করলেন?
গোয়ালা: আমরা যখন প্রাথমিক আলোচনা শুরু করি তখন দেখলাম অনলানে অনেক কিছুই পাওয়া যায়। অনলাইনে ভিন্নধর্মী কিছু কী বিক্রি করা যায় এ দিকেই চিন্তাভাবনা চলতে থাকে আমাদের। তখন আমরা পেলাম যে, দই নিয়ে কাজ করা যায়। খুবই ব্যতিক্রমী হবে এ উদ্যোগ। বাংলার ইতিহাসে দই এর প্রায় ২০০ বছরের পুরনো ঐতিহ্য আছে। ঢাকায় বগুড়ার দই এর নামে অনেক ভেজাল দই বিক্রি করা হয়। সেই সমস্যা দূর করার লক্ষ্য নিয়েও আমরা কাজ শুরু করি। মূলত খুবই ব্যতিক্রমী কিছু করার উদ্যোগ থেকে আমাদের দই নিয়ে কাজ করা। দই এর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের গোয়ালাতে বগুড়ার খাটি ঘি-ও পাওয়া যায়।
ইটিভি অনলাইন: আপনাদের দই-ঘি বগুড়ারই এর নিশ্চয়তা কী?
গোয়ালা: প্রথম কথা হচ্ছে আমরা কোন গ্রাহকের সঙ্গে বিতর্কে জড়াতে চাই না যে আমাদের দই বা ঘি বগুড়ার। যারা বগুড়ার দই খেয়েছেন বা নিয়মিত খান তারা জানেন যে, এ অঞ্চলের দই এর স্বাদ কেমন। আমরা আমাদের গ্রাহকদের বলি যে, আমাদের দই খেয়ে দেখুন। সেই স্বাদটা তারা পায় কী না। যদি কেউ মনে করেন যে, আমাদের দই বগুড়ার দই না তাহলে তিনি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আমাদেরকে জানালে দই এর পুরো মূল্যই আমরা রিফান্ড করে দেই। আমাদের বিশ্বাস আমাদের গ্রাহকেরা সে স্বাদ পেয়ে আসছে। যে কারণে এখন পর্যন্ত প্রতারিত হবার কোন অভিযোগ আসেনি।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে যে, বাজারে যদি প্রতারণা থাকে তাহলে বিশ্বাসও থাকবে। আস্থা থাকবে। গোয়ালা দই বা ঘি যারা ইতোমধ্যে খেয়েছেন তাদের সেই আস্থার জায়গায় স্থান পেয়েছে গোয়ালা। আশা করি বাকিদের ক্ষেত্রেও তাই হবে।
ইটিভি অনলাইন: আপনাদের নাম গোয়ালা কেন?
গোয়ালা: গোয়ালা নামকরণের পিছনে আমাদের দুইটি কারণ আছে। আগেই বলেছি গোয়ালা শুধু একটি শব্দ নয়। বাংলার ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এটি। বাংলার খুবই প্রাচীন পেশাগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে গোয়ালা। আগেকার সময়ে রাজা-নবাব বা জমিদারদের গোয়াল ঘরে যারা গরুর পরিচর্যা করতেন তাদেরকেই গোয়ালা বলা হত। তবে গোয়ালা শব্দটাও এখন বাংলা ভাষায় খুব একটা শোনা যায় না। মৃতপ্রায় এ শব্দটিকে বাঁচিয়ে রাখতেই আমরা গোয়ালা নাম নিয়ে যাত্রা শুরু করি। এটি প্রথম কারণ।
আরেকটি কারণ খুবই ব্যবসায়িক। দই-ঘি এগুলো হচ্ছে দুগ্ধজাত খাবার। আমরা এমন একটি নাম খুঁজছিলাম যা দিয়ে দুগ্ধজাত খাবারগুলোকে প্রকাশ করা যায়। তাই গোয়ালাকেই বাছাই করা।
ইটিভি অনলাইন: আমরা জানতে পারি আপনাদের মোড়কটি বেশ আকর্ষণীয়। গ্রাহকদের মাঝে ব্যাপক প্রশংসিত হয় এ মোড়কটি। এর কারণ কী?
গোয়ালা: আসলে দই বা ঘি উদপাদিত হয় বগুড়ায়। আমি শুধু ঢাকায় এনে বাড়ি বাড়ি ডেলিভারি করি। আমরা তখন ভাবলাম এর সঙ্গে কী বিশেষত্ব যুক্ত করা যায়। আমরা দেখলাম যে, আমাদের কাজ করার জায়গা একটাই। আর তা হচ্ছে এর মোড়ক। আমরা তখন এর মোড়কটিকে আকর্ষণীয় করতে কাজ শুরু করলাম। সেভাবেই আসলে এ মোড়কটি করা।
আরেকটি দিক আছে এ মোড়কের। আমরা যেহেতু গ্রাহকের বাড়িতে গিয়ে ডেলিভারি দিয়ে থাকি এ দই সেহেতু আমাদেরকে একটি ব্যবস্থা করতে হয় যেন এটিকে বহন করা যায়। বগুড়ায় সাধারণত ছোট কলসির মত মাটির পাত্রে দড়ি দিয়ে বেধে দেওয়া হয়। অথবা পলিথিনে করে। এভাবে তো ঢাকায় দেওয়া যায় না।
আবার বাংলার একটি বহুল প্রচলিত রীতি আছে। কোন বাড়িতে বেড়াতে গেলে মিষ্টি নিয়ে যায় এ অঞ্চলের মানুষ। আমরা ভাবলাম তাহলে তো দই নিয়েও যাওয়া যায়। আমরা এমন একটি মোড়কে যদি দিতে পারি যা খুব সহজে বহন করা যায় এবং পাশাপাশি আকর্ষণীয় তাহলে দই শুধু মানুষ নিজের জন্যই কিনবে না। আত্মীয় স্বজনের জন্যও কিনবে। প্রতি সরা ৩১০ টাকা মূল্যের দই এর মোড়কেই আমাদের খরচ হচ্ছে ৩৭ টাকা।
ইটিভি অনলাইন: আপনাদের এ উদ্যোগে ঢাকাবাসীর সাড়া কেমন পাচ্ছেন?
গোয়ালা: আমরা খুবই ইতিবাচক সাড়া পাচ্ছি। সত্যি কথা বলতে শুরুতে বেশ চিন্তায়ই ছিলাম যে কেমন হবে না হবে। তবে উদ্যোক্তা হিসেবে আপনাকে ঝুকি নিতেই হবে। তবে সময় যত বাড়তে থাকে দিনদিন গ্রাহকের সাড়াও বাড়তে থাকে। শুরুতে আমরা শুধু দই দিয়ে শুরু করি। এখন দই এর পাশাপাশি ঘি-ও পাওয়া যাচ্ছে আমাদের গোয়ালাতে। আর আমরা শুধু অনলাইনেই না বরং এখন অফলাইনেও কাজ করছি। মিরপুর ১১নং সেকশনে আমরা আমাদের প্রথম আউটলেট চালু করি এ মাসেই। গ্রাহকের জোরালো সমর্থনের কারণেই এগুলো সম্ভব হচ্ছে। এজন্য আমরা আমাদের গ্রাহকদের কাছে কৃতজ্ঞ।
ইটিভি অনলাইন: একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। এমন একটি ভিন্নধর্মী উদ্যোগ আপনাদের। কী কী সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন?
গোয়ালা: প্রথম সমস্যা হচ্ছে আমরা যারা ই-কমার্সে কাজ করছি আমাদেরকে ব্যাংক লোন দিতে চায় না। এ সমস্যা কোন রকমে কাটিয়ে উঠলেও আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে ডেলিভারি। ডেলিভারি দেবার জন্য এখন যে মোটরসাইকেলগুলো ব্যবহার করছি আমরা এগুলোকে প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তন করতে পারি না আমরা। অথচ ঢাকা শহরের মত একটা মেগাসিটিতে মোটরবাইক ডেলিভারি ব্যবস্থা ছাড়া ইকমার্স চিন্তাও করা যাবে না। বাইকের পিছনে যে বক্স থাকে সেগুলো বসানর অনুমতি দেয় না পুলিশ বা বিআরটিসি। যে কারণে পুলিশের মামলার জরিমানা গুণতে হয় আমাদের প্রতিনিয়ত। কিছু জায়গায় সাইকেল দিয়ে দিচ্ছি। তবে শুধু সাইকেল দিয়ে তো পুরো ঢাকা শহরের চাহিদা মেটানো যায় না। এছাড়াও অপারেশনাল আরও কিছু প্রতিবন্ধকতা তো আছেই।
ইটিভি অনলাইন: আপনাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
গোয়ালা: আগেই উল্লেখ করেছি যে, আমাদের এখন মিরপুরে একটি আউটলেট। আগামী বছর নাগাদ ঢাকা শহরে অন্তত ১০টি আউটলেট করার পরিকল্পনা আছে আমাদের। এছাড়াও এখন আমরা শুধু দই ও ঘি বিক্রি করছি। অতি শিগগিরই আমরা দুধ বিক্রি করার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছি। অনলাইনে দুধ অর্ডার করবে গ্রাহক। কোন ধরনের পানি বা অন্য কিছুর মিশ্রণ ছাড়াই শতভাগ ভেজালমুক্ত সে দুধ আমরা গ্রাহকের বাসায় পৌঁছে দিব। আর আমাদের ঘি ও দই চালডাল ডট কমেও অর্ডার করা যায়। এভাবে আমাদের পণ্যগুলোকে আরও সহজলভ্য করার জন্য কাজ করছি।
ইটিভি অনলাইন: নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য আপনাদের পরামর্শ কী থাকবে? বিশেষ করে কেউ যদি আপনাদের মতই দুগ্ধজাত পণ্য নিয়ে কাজ করতে চায়?
গোয়ালা: নতুনদের জন্য পরামর্শ এটাই থাকবে যে, যারাই এ ব্যবসায় আসতে চায় তারা যেন ব্যবসাটা বুঝে তারপর আসে। আগে শুরু করি তারপর দেখা যাক-এমন মন মানসিকতা নিয়ে উদ্যোগ না নেওয়াই ভাল। ঢাকা শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে দুগ্ধজাত পণ্যের চাহিদা আছে। সামনে এ চাহিদা আরও বাড়বে। বিশাল একটি বাজার সামনে অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। তাই যারা এ বিষয়ে কাজ করতে ইচ্ছুক তারা যেন হোমওয়ার্কটা করে তারপর আসে।
ইটিভি অনলাইন: আপনাকে ধন্যবাদ।
গোয়ালা: ইটিভিকেও ধন্যবাদ।
//এসএইচএস//এসএইচ
আরও পড়ুন