ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ০৩ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

বঙ্গবন্ধু কি কারো কোন ক্ষতি করেছিলেন?

পঙ্কজ বণিক

প্রকাশিত : ১৮:১০, ১৭ আগস্ট ২০২১ | আপডেট: ০৮:৫৯, ১৮ আগস্ট ২০২১

Ekushey Television Ltd.

গিন্নিসহ বেরিয়েছি, শহরেই। কিছুটা কাজে কিছুটা কাজহীন সময় ব্যয়ও উদ্দেশ্য। জানুয়ারী মাস, ‘করোনা’র যা কিছু করার তা তখন কেবল শুরু করেছে সুদূর চীন দেশে, এদেশে আমরা তখন চীনাদের সাপ ব্যাঙ বাদুর খাওয়ার নানান কাণ্ডকারখানা নিয়ে মজা করা আর মজা পাওয়ায় ব্যস্ত, আপদ কিংবা নিরাপদ দুরত্ব বজায় রাখার প্রশ্ন সুদুর পরাহত। কাজেই নিরাপদেই রিক্সাভ্রমনে প্রিয়জনের গায়ে গা মিলিয়ে কাছাকাছি থাকবার সুযোগ হেলায় হারাতে চাইনি। বেশ দ্রুতই প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিক কাজ শেষ হয়ে গেলো, তাই তিন চাকার যানে চালক ও চালিত তিন মানব মানবীর নিশ্চিন্ত যাত্রা। কি যেন একটা ভালো লাগা ভাবও কাজ করছিলো মনে, পরিচিত শহরেই চারপাশ রসিয়ে রসিয়ে দেখছি। হঠাৎই গিন্নির নির্দেশে রিক্সা থামলো, অবাকমাখা বোকাভাব চেহারা নিয়ে তাকাতেই গিন্নির দ্বিতীয় নির্দেশ ‘নামো’। বলে নিজেই রওনা। দ্রুত রিক্সাভাড়া মিটিয়ে মহাজনের পথ অনুসরণ (মহাজ্ঞানী মহাজন যে পথে করেছেন গমন ...)। এক অপ্রশস্ত গলির অল্প ভিতরে অতি ছোট একটি ঘরে গিন্নি নক করতেই একজন বয়ষ্ক (আমার থেকে কিছুটা বেশি) ভদ্রলোক দরোজা খুলে প্রবেশের আমন্ত্রণ জানালেন। অনুসরণ করে (উপায় নাই গোলাম হোসেন), বসলাম। ছোট্ট চারপাশ দেখতে দেখতেই সামান্য দ্বিমুখী আলোচনায় বুঝে গেলাম এই বয়ষ্ক ভদ্রলোক জ্যোতিষী এবং গিন্নি মাঝে মধ্যেই তিনাকে দেখান। হাত দেখাদেখিতে আজন্ম মেয়েদের যতটা আগ্রহ এবং দুঃখজনকভাবে আমার ততটাই উল্টো। গিন্নি আর জ্যোতিষী দুজন আলাপ করছে নানান বিষয়ে। যাক বাবা আমি অন্ততঃ এখানে গিনিপিগ হচ্ছি না ভেবে যেই আয়েশ করে চেয়ারে হেলান দিতে যাচ্ছি অমনি নির্দেশ, ‘তোমার ডান হাতটা ওনাকে দাও তো’। মানে কি?  মহাভারতে পড়েছি একলব্য তার গুরুকে আঙ্গুল কেটে দিয়েছিলো, আমার কি এখানে ডান হাতটা কেটে দিতে হবে? প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিয়ে একবার গিন্নির দিকে একবার প্যান্ট শার্ট পরা আধুনিক জ্যোতিষী বাবার দিকে তাকাতেই গিন্নি, ‘ডান হাতটা ওনাকে দেখাও’। আমি নিজে একবার ভালো করে দেখে নিলাম নিজের হাতটাকেই (নাহ্, কোনও পরিবর্তন হয়নি তো, আগের মতোই আছে) তারপর বাড়িয়ে দিলাম আ-আ-স্তে। জ্যোতিষী টানছেন, কাত করছেন, ঘষছেন, ঘুরাচ্ছেন, আতষ কাঁচ দিয়ে দেখছেন আর নানান কথা শুধাচ্ছেন। আমি ‘হুম’ ‘না’ ‘উহু’ এসব শব্দ দিয়ে চালিয়ে নিচ্ছি। শুনছি সব কথাই, বেশ তো, মন্দ লাগছে না। গিন্নির সামনে দু চারটে প্রশংসা কার না ভালো লাগে। মিনিট তিন চারেক হচ্ছে নানান রংয়ের কথা বলে চলেছেন। হঠাৎই একটু থামলেন। আতষ কাঁচটা আরো একটু গভীরভাবে একটা স্থানে স্থির করলেন। বাহ্, বেশ পেশাদার জোতিষ বটে। ক্যামেরার ভাষায় আতষ কাঁচটিকে জুম করে, জুমব্যাক করে, টিল-আপ, টিল-ডাউন করে দেখছেন। চোখ সরিয়ে গিন্নির দিকে নজর বুলিয়ে তার আগ্রহের বর্ধিষ্ণু গতি লক্ষ্য করলাম। জ্যোতিষীও এমন স্থির দৃষ্টিতে আতষ কাঁচের ভিতরে তাকিয়ে আছেন, তার চোখে সূর্যের আলো আর তাপ থাকলে এতক্ষণ হাত আগুনে পুড়ে ছাই। দৃষ্টি স্থির রেখে কিন্তু মনোযোগ কিঞ্চিৎ পরিবর্তন করে জ্যোতিষ এবার ছোট্ট করে একটু কাশলেন।

আচ্ছা, আপনার শত্রু আছে কেমন?

থতমত খেয়ে উপস্থিত দুজনের দিকেই তাকালাম। হঠাৎ এ আবার কি প্রসঙ্গ। ‘শত্রু’!! কি বলবো শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না। আমতা আমতা করে বললাম

না-আ-আ-আ। শত্রু-উ-উ-উ মানে শত্ত্রু কেনো থাকবে, কারো সাথে ঝগড়া করি না বা করার প্রয়োজনও হয় না, আমি তো কারো ক্ষতি করি না কখনো। শত্রু কেন তৈরি হবে?

বঙ্গবন্ধু কি কারো কোন ক্ষতি করেছিলেন?

কথাটা বলেই আতষ কাঁচে জোতিষীর চোখের দৃষ্টি আরো গভীর হলো, মনোযোগের চিহ্নস্বরূপ কপালে আবার একটু ভাঁজ পড়লো। তারপর আমার চোখে চোখ স্থির করে বললো, ‘আপনার জীবনে একটা অপঘাতের চিহ্ন আছে। আপনার বলয়ের কেউ, কাছেরই কেউ আপনার জীবনের উপর বড় হুমকি তৈরি করতে পারে। তাই বলতেছি কি বাকি জীবনে একটু বেশি সচেতন থাকবেন প্লিজ। চারপাশে সবাইকেই সম্পূর্ণ বিশ্বাস করবেন না।

গিন্নির চোখে মুখে শঙ্কা ছেয়ে যাচ্ছে, এখুনি যেন খারাপ কিছু ঘটে যাবে আমার জীবনে। জোতিষ ভদ্রলোক শান্তভাবে নানান কথা বলেই যাচ্ছেন আমার দিকে চেয়ে, আমিও মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে আছি তারই দিকে কিন্তু কানে যাচ্ছে না কিছুই। মস্তিষ্কজুড়ে গড়ে উঠা সমস্ত ভাবনাগুলো জোতিষীর বলা ঐ শব্দগুচ্ছ নিয়ে বারবার জিগ্স পাজল খেলছে। “অর্থাৎ কিনা, আমার অপঘাতে মৃত্যুও হতে পারে। এবং অতি ঘনিষ্ঠজনদের কেউই আমাকে...’ কথাগুলো কেনো বললেন তিনি? কেনো? মস্তিষ্কে নিউরণদের তীব্রগতিতে ছোটাছুটি টের পাচ্ছি। খুঁজছে, কার্যকারণ খুঁজছে...

হঠাৎই মনে হলে জ্যোতিষীর শেষ কথাটা ‘বঙ্গবন্ধু কি কারো কোন ক্ষতি করেছিলেন?’

সত্যিই তো। আমাদের জাতীর পিতা আমাদের বঙ্গবন্ধু, একটা স্বাধীন দেশ দিলেন যিনি, উনি সারাজীবনে কারোরই কোন ধরনের ক্ষতি তো করেনই নি বরং নিজের জীবন যৌবন সংসার সবকিছুকে মৃত্যুর হাতে সঁপে দিয়ে শুধুই আমাদের কথা ভেবেছেন আর কেবলই কষ্ট পেয়েছেন। ঐ যে শয়তান খন্দকার মুশতাক, মেজর ডালিমসহ পিশাচগুলো (নামগুলো উচ্চারণ করতেও ঘৃণা হয়)- এগুলোকে তো বঙ্গবন্ধু সবার চেয়ে আপন জায়গায় স্থান দিয়েছিলেন। অনেক ছবিতে দেখেছি, নানান পত্রিকায় পড়েছি মুশতাককে তিনি প্রায়সময়ই পাশে পাশে রাখতেন, এই মুশতাক খুনি মেজর ডালিমসহ অনেকেই বঙ্গবন্ধুর বাসায় পর্যন্ত নিয়মিত পরমাত্মীয়ের মতো গিয়েছে, শ্রদ্ধা যত্ন আদর গ্রহন করেছে সেই জাতীর পিতামাতার অতি আপন প্রিয়জন আর প্রিয় সন্তানের মতোই। বঙ্গবন্ধুর বাৎসল্য স্নেহ খুনিগুলোর সবাই পেয়েছে। এমনকি পিতৃত্বের সামান্য তিরষ্কারও কখনো করেননি কাউকে। তার বিনিময়ে এত জঘন্য প্রতিদান?

৭৫এর ১৫ই আগষ্টে খুনি পিশাচগুলি তাঁর পরিবারের সদস্যদের নির্দয়ভাবে হত্যা করার পরেও জাতীর পিতা বলেই নিজ মৃত্যুর আগে সন্তান বাৎসল্যে প্রশ্ন করতে পারে, কি চাস তোরা? আর তার উত্তর ব্রাশ ফায়ার।

মেজর জিয়া। বঙ্গবন্ধুর বাসায় সপরিবারে কতবার গিয়েছে, কি ভালোবাসতেন তাকে বঙ্গবন্ধু। তাকে দিয়ে একবার স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করিয়েছেন, স্বাধীনতার পর তাকে কত সম্মানীত করেছেন, উচ্চ পদে বসিয়েছেন অথচ সেই জিয়া এবং তার স্ত্রী খুনিদের নিয়ে কি নোংরা খেলাটাই না খেললো। উপকারীর প্রতিদান এই?

এবার বোধ করি জ্যোতিষীর আশঙ্কার কারণ মেলাতে পেরেছি। আমার জন্ম তারিখ হচ্ছে ১৭ই মার্চ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে। জোতিষ কি সেখান থেকে মিলিয়ে কিছু বলতে চাইছেন আমাকে? যেহেতু জাতির পিতাকে মেরেছে তার বিশ্বাসী কাছের মানুষগুলোই। হায় রে, কার সাথে কার তুলনা। কোথায় স্বাধীনতা এনে দেয়া জাতীর পিতা শেখ মুজিব আর কোথায় আমি পৃথিবীর সাধারন একটা জীব...। কোথায় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম একজন আর কোথায় ‘আমি’ অবশিষ্ট ৭০০ কোটির মধ্যে এক।

ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসায় একবারই গিয়েছিলাম, দ্বিতীয়বার যাবার কষ্ট সইবার মতো সাহস আমার হয় নাই কখনো। জাতীর পিতার জন্ম তারিখে জন্ম নেয়া এই আমি আর এক পৃথিবীসম সাহসী অথচ কোমলতম বুকের পাটা এক জিনিস নয়। একই ১৭ই মার্চে জন্ম নিয়েছি বলে জ্যোতিষীর কাছে কিংবা স্ত্রীর কাছে শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুর মতো মৃত্যুর আশঙ্কাটাই কত গুরুত্বপূর্ণ। আর ভেতরে ভেতরে কত ছোট হয়ে যাচ্ছি আমি, টের পাচ্ছি কত শূন্য, কত ব্যর্থ আমি। জন্ম তারিখ মিলের সাথে তার অসমসাহসী ব্যক্তিত্ব, দুনিয়া কাঁপানো নেতৃত্ব, অতি কোমল হৃদয়, অটবীর মতো আশ্রয়, হিমালয়সম উচ্চতা, মহান পিতৃত্ব, নীলকন্ঠ হয়ে সমস্ত গরল নিজ বক্ষে ধারণ করে জাতিকে যিনি দিতে পারেন অমৃত - এমনি শত সহস্র মানবিক গুণের ছিটেফোঁটাও কি ধারণ করতে পেরেছি নিজের মধ্যে? না পারি নি। কেবল জন্মতারিখ মিলের অহংকারে ধিক্।

আমার অপঘাতে হবু মৃত্যুর সম্ভাবনার সাথে আর এক দেবপুরুষের মৃত্যুর সাথে মিলিয়ে দেয়ার চেষ্টা সেই মহাপুরুষকে ছোট করা, যে যোগ্যতা আমাদের কারোরই নেই। বরং আমার অপরাধী মন আমাকে প্রতিনিয়ত ধিক্কার দিচ্ছে, ‘তুই-ই হত্যা করেছিস তাঁকে তাঁর উপকারের প্রতিদানে’।

হঠাৎই সম্বিত ফিরে পাই কানে আসা জোতিষীর হাসিমাখা স্তুতিবাক্যে, ‘তবে আপনার ভাগ্যটা দারুন ভালো, এরকম একজন মহাপুরুষের জন্মতিথিতে আপনার জন্ম’।

বেশ তো, না হয় ১৫ই আগষ্টের কষ্টগুলো বুকে নিয়ে বাকি জীবন অন্ততঃ ১৭ই মার্চ-এর গর্বটুকু নিয়ে বেঁচে থাকি। ব্যর্থ মানুষের জীবনে এই তো অনেক বড় প্রাপ্তি।

লেখক: একুশে টেলিভিশনের অনুষ্ঠান বিভাগের প্রধান।


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি