ঢাকা, সোমবার   ২১ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ ও শেখ ফজিলাতুন্নেছা

ড. সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদ

প্রকাশিত : ১৩:৩৪, ৮ আগস্ট ২০২০

Ekushey Television Ltd.

টুঙ্গিপাড়ার সেই ছোট্ট ‘খোকা’র স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি হয়ে ওঠার পেছনে যিনি সাহস, অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ দিয়ে গেছেন, তিনি বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। পারিবারিক জীবনে মা-বাবার পরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনে স্ত্রীর বিরাট ভূমিকা ছিল। প্রদীপের সলতের মতো জ্বলে আজীবন স্বামীকে সাহস জুগিয়ে গেছেন, দিয়েছেন অনুপ্রেরণা ও গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ। যা অনস্বীকার্য। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পাশে থেকে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন ও আদর্শকে বাস্তবায়ন করেছেন তার ‘প্রিয় রেণু’।

সব সময় দেশের প্রয়োজনকেই বড় করে দেখতেন তিনি। নিজে শয্যাশায়ী থেকেও স্বামীকে ১৯৪৬ সালে দাঙ্গা-আক্রান্ত এলাকায় যেতে বারণ করেননি। বরং উৎসাহ দিয়ে তিনি চিঠিতে লিখেছেন- ‘আপনি শুধু আমার স্বামী হওয়ার জন্য জন্ম নেননি, দেশের কাজ করার জন্যও জন্ম নিয়েছেন। দেশের কাজই আপনার সবচাইতে বড় কাজ। আপনি নিশ্চিন্ত মনে আপনার কাজে যান।... আল্লাহর উপরে আমার ভার ছেড়ে দিন।’

এমনটি কেবল বেগম মুজিব বলেই সম্ভব হয়েছে। তাই তো তিনি হয়েছেন বাঙালির মাতা-বঙ্গমাতা। শৈশবে বাবা-মাকে হারানোর পর ফজিলাতুন্নেছা বেড়ে ওঠেন দাদা শেখ কাশেমের কাছে। তাকে মাতৃস্নেহে আগলে রাখেন চাচি এবং পরে শাশুড়ি শেখ মুজিবের মা সায়েরা খাতুন। বাবার অভাব বুঝতে দেননি বঙ্গবন্ধুর বাবা শেখ লুৎফর রহমানও। শৈশবেই তাদের বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ে সম্পর্কে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে শেখ মুজিব লিখেছেন, ‘আমার যখন বিবাহ হয় তখন আমার বয়স বারো-তেরো বছর হতে পারে।... রেণুর দাদা আমার আব্বার চাচা। মুরব্বির হুকুম মানার জন্যই রেণুর সাথে আমার বিবাহ রেজিস্ট্রি করে ফেলা হলো। আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে। তখন কিছুই বুঝতাম না, রেণুর বয়স তখন বোধহয় তিন বছর হবে।’

বিয়ে হলেও শেখ মুজিবের এন্ট্রান্স পাসের পরই মূলত তাদের সংসার জীবন শুরু হয়। ১৯৪২ সালে শেখ মুজিব ভর্তি হন কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে। সেখানেই তার রাজনৈতিক জীবনের সূচনা ঘটে। তখন বিভিন্ন ধরনের বই পড়ে সময় কাটত শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের। জীবন সংগ্রামের সব কণ্টকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করে বঙ্গমাতা পরিবারও সামলেছেন বেশ গুছিয়ে। তিনি প্রতিটি ঘটনা জেলখানায় দেখা করার সময় বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করতেন। সেখানে বঙ্গবন্ধুর পরামর্শ শুনে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাদের তা জানাতেন বেগম মুজিব। অন্যদিকে কারাগারে সাক্ষাৎ করে বঙ্গবন্ধুর মনোবল দৃঢ় রাখতেও সহায়তা করতেন তিনি।

বঙ্গবন্ধু জেলে থাকা অবস্থায় নিজের ঘরের আসবাবপত্র, অলংকার বিক্রি করেও দল ও নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন শেখ ফজিলাতুন্নেছা। একজন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী হয়েও সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করতেন তিনি। তার বাড়িতে কোনো বিলাসী আসবাবপত্র ছিল না, ছিল না কোনো অহংবোধ।
সন্তানদের যেমন ভালোবেসেছেন, তেমনি শাসনও করেছেন। পালন করে গেছেন পিতামাতা উভয়েরই কর্তব্য। কোমলে কঠোরে মিশ্রিত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এই সাহসী নারী স্বামীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ছেলেমেয়েদের গড়ে তোলেন। ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেফতার রাজবন্দিদের মুক্তি দাবিতে রাস্তায় নামে জনতা। উত্তাল পরিস্থিতিতে বেগম মুজিবকেও গ্রেফতারের হুমকি দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি বিচলিত না হয়ে বরং তীক্ষষ্ট বুদ্ধিমত্তা দিয়ে মামলাটি আইনিভাবে মোকাবিলার প্রস্তুতি নিতে আইনজীবীদের পরামর্শ দেন ও অর্থ জোগানোর চেষ্টা করেন।

বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ক্ষেত্রেও রয়েছে বেগম মুজিবের বুদ্ধিমত্তার ছাপ। ঐ দিনের স্মৃতিচারণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘৭ মার্চের ভাষণের আগে আম্মা আব্বাকে বলেন- অনেকেই অনেক কথা বলবে। তুমি সারাজীবন আন্দোলন-সংগ্রাম করেছ, জেল খেটেছ। তুমি জানো কী বলতে হবে, মানুষ কী শুনতে চায়? তোমার মনে যে কথা আসবে, সে কথাই বলবা।’

এ থেকেই স্পষ্ট যে, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাকে ছিল বঙ্গমাতার মনস্তাত্ত্বিক সমর্থন। এই সমর্থন তাকে সাহস জুগিয়েছিল, নির্ভার থাকতে সহযোগিতা করে। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চের পতাকা উত্তোলনেও বঙ্গবন্ধুর প্রধান উদ্দীপক ও পরামর্শক হিসেবে বিবেচনা করা যায় শেখ ফজিলাতুন্নেছাকে। শুধু তাই নয়, মহান মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয়টি মাস অসীম সাহস, দৃঢ় মনোবল ও ধৈর্য নিয়ে বেগম মুজিব পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন। এ সময়টাতে ছেলেমেয়েদের নিয়ে অনেকটা বন্দিদশায় কেটেছে তার। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির স্বাধীনতা অর্জিত হয়। এরপর ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পান। সেখান থেকে যান লন্ডনে। লন্ডন থেকেই স্ত্রীর সঙ্গে প্রথম কথা হয় শেখ মুজিবের। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। অবসান ঘটে বঙ্গমাতার দীর্ঘ প্রতীক্ষার। এবার স্বামীর সঙ্গে শুরু হয় তার দেশ গড়ার কাজ। অনেক বীরাঙ্গনাকে বিয়ে দিয়ে তিনি তাদের সামাজিকভাবে মর্যাদাসম্পন্ন জীবন দেন।

বাঙালি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতিটি ধাপে বঙ্গমাতার অবদান রয়েছে। সেটি বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী হিসেবে নয়, একজন দক্ষ সংগঠক হিসেবে। যিনি ধূপের মতো নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে ভূমিকা রেখেছেন এবং বঙ্গবন্ধুকে হিমালয়সম আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। শেখ মুজিব-শেখ ফজিলাতুন্নেছার রক্তের উত্তরাধিকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পিতার আদর্শে ও তার দেখানো পথে ‘সোনার বাংলা’ গড়ে তুলতে তিনি দিনরাত কাজ করে চলেছেন। বাংলার মানুষের শেষ আশ্রয়স্থলও শেখ হাসিনা। আমাদের উচিত তার হাতকে শক্তিশালী করা। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছিলেন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সংগ্রামী নারী। তার আদর্শে আপন শক্তিতে বলীয়ান হয়ে নারীর ক্ষমতায়নে দৃষ্টান্ত হোক বাংলাদেশ। এই হোক প্রত্যাশা। ৯১তম জন্মদিনে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের প্রতি পরম শ্রদ্ধাঞ্জলি।

উপাচার্য, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর

এমএস/


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি