বঙ্গবন্ধু মুক্ত হলেন যে দিন
প্রকাশিত : ১৩:৩৭, ১০ জানুয়ারি ২০২১
উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ, আতঙ্ক, সংশয় আর দোলাচলে তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলার মানুষসহ বিশ্ববাসী, বাঙালী জাতির অবিসংবাদিত নেতা, মুকুটহীন সম্রাট কখন মুক্ত হবেন পাকিস্তানী ‘জিন্দাখানা’ থেকে। ফাঁসির আদেশ দিয়ে পাক সামরিক বাহিনী হত্যার সব আয়োজন সম্পন্ন করলেও বিশ্ববাসীর চাপে আর তা পেরে ওঠেনি।
বাংলাদেশ হানাদারমুক্ত হওয়ার পর বাইশ দিন পেরিয়ে যায়, তবু তার স্থপতি, তার প্রতিষ্ঠাতা ফেরেনি। সারা বিশ্ব তাকিয়ে বাঙালির মতোই কখন মুক্ত হবেন দীর্ঘ নয় মাস ধরে নিঃসঙ্গ কারাবন্দী বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালির প্রাণপ্রিয় নেতা, ভাই, বন্ধু, পিতা, স্বজন। পুরো বাঙালি জাতির আশা ও বাসনাকে একটি বিন্দুতে মিলিয়েছিলেন তিনি। তাঁরই আহ্বানে, তাঁরই ডাকে পুরো জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাঁধে কাঁধ রেখে লড়াই করেছে। যে স্বাধীনতা ও মুক্তির ডাক দিয়েছিলেন, নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে, ত্রিশ লাখের প্রাণের আত্মাহুতিতে আর তিন লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে সেই দেশকে স্বাধীন করেছে।
পাক হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণে হয়েছে বাধ্য। বিশ্বের মানচিত্রে নতুন দেশ ‘বাংলাদেশ’ আলোকিত সূর্যের মতো রেঙ্গে উঠেছে। সেই তেতাল্লিশ বছর আগে, ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি ছিল বাঙালি জাতির ইতিহাসের এক উজ্জ্বল উদ্ধার। মুক্ত হলেন বাঙালির স্বপ্নদ্রষ্টা জাতির কান্ডারি শেখ মুজিব বাঙালিসহ বিশ্ববাসী স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিল। একাত্তরের পঁচিশে মার্চ রাতে পাক জল্লাদ বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে বত্রিশ নম্বরের বাসভবন থেকে আটক করে। ব্যাপক গুলিবর্ষণও করে। আটক হওয়ার আগেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে উঠেছে তখন। সারাদেশে পাকবাহিনী গণহত্যাযজ্ঞ শুরু করে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে। বঙ্গবন্ধুকে গোপনে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং লায়ালপুর জেলে আটক রাখা হয়। পাক জল্লাদ বাহিনী প্রধান ইয়াহিয়া খান একাত্তরের ৩ আগস্ট রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ এনে কোর্ট মার্শালে বঙ্গবন্ধুর বিচার করার ঘোষণা দিলে, সাড়ে সাত কোটি বাঙালিসহ বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষ ও তাদের প্রতিনিধিরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, যিনি বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের ছিলেন নেপথ্যে প্রধান সহায়ক, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রাণ রক্ষার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের কাছে আবেদন জানান। তিনি হুঁশিয়ার করে দেন, ‘শেখ মুজিবের কোর্ট মার্শালে বিচার করা হলে তার পরিণতি হবে গুরুতর।’
জাতিসংঘের মহাসচিব থেকে আন্তর্জাতিক জুরিস্ট কমিশনও প্রতিবাদ জানায়। বিশ্ববাসীর প্রতিবাদ সত্ত্বেও পটুয়া কামরুল হাসানের ‘জানোয়ার’ ইয়াহিয়া বিচার শুরু করে। বঙ্গবন্ধু আত্মসমর্পণ করতেও রাজি হননি। বঙ্গবন্ধুর জন্য জেলখানার পাশে কবর খোঁড়া হয়েছিল। এমনকি সামরিক ঘাতক বাহিনীও পাঠানো হয়েছিল জেলখানায়। কিন্তু জেলার সতর্ক ও সহৃদয় থাকায় সম্ভব হয়নি।
তিন ডিসেম্বর আদালতের তথাকথিত কার্যক্রম শেষ হয় এবং ৪ ডিসেম্বর পাক হানাদার বিচারকরা মৃত্যুদণ্ডে দন্ডিত করে রায় দেয়। বঙ্গবন্ধু আদালতে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, মামলার রায় আগেই সাজানো আছে। তাই আত্মসমর্পণ বা আইনজীবী নিয়োগের আগ্রহ দেখাননি। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় ঘোষণার আগেই ৩ ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সহায়ক হয়ে যৌথবাহিনী গড়ে তোলে এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ইয়াহিয়া তখনও অনড় বঙ্গবন্ধুকে মৃত্যুদণ্ড প্রদানে। বিশ্ববাসীর চাপও বাড়তে থাকে।
অবশেষে খোদ ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট পদ ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। ২০ ডিসেম্বর ভুট্টোর হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেন। সারা বিশ্বের চাপে ২১ ডিসেম্বর ভুট্টো ঘোষণা দেন যে, শেখ মুজিবকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে গৃহবন্দী করা হয়েছে। ক্ষুব্ধ বাংলার মানুষসহ বিশ্ববাসী। তারা তখনও জানে না, বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে দেয়া হবে কি না। অথবা ছেড়ে দিলে কবে তিনি ফিরে আসবেন। ভুট্টো জেল থেকে মুক্তি দিলেও গৃহবন্দী করেন বঙ্গবন্ধুকে। নানা ফন্দি কৌশল এঁটেও সুবিধা হয়নি। বঙ্গবন্ধু শোনালেন ভুট্টোকে, ‘আজ দীর্ঘ নয় মাস পর আমি আমার দেশে-আমার মানুষের কাছে যাব। তাদের সঙ্গে কোন কথা না বলে আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারি না।’ দীর্ঘ নয় মাস কারাগারে নিঃসঙ্গতার মধ্যে বঙ্গবন্ধু মানসিকভাবে কাবু হননি পাক জান্তার অপতৎপরতায়ও। ‘জীবনমৃত্যু পায়ের ভৃত্য’ তখন বঙ্গবন্ধুর। উপায়হীন ভুট্টো ঘোষণা করতে রাজি হন ‘আপনি মুক্ত’।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তান থেকে মুক্তি পান ৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের স্থানীয় সময় ভোর রাত ৩টায়। আর বাংলাদেশে তখন ভোর চারটা এবং লন্ডনের সময় রাত দশটা। বঙ্গবন্ধু এবং ড. কামাল হোসেনকে পরিবারসহ বিমানে তুলে দেন স্বয়ং ভুট্টো। ৮ জানুয়ারি লন্ডন সময় ভোর ৬টা ৩৬ মিনিটে হিথরো এয়ারপোর্টে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পাকিস্তানী বিমানটি অবতরণ করে। তখন ব্রিটেনে ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। বিশ্ববাসী তখনো জানে না বঙ্গবন্ধুর মুক্তির খবর। বাংলার মানুষ উদগ্রীব। যুদ্ধজয়ের পর বেতার থেকে প্রচারিত হলো; বঙ্গবন্ধু মুক্তি পেয়েছেন পাকিস্তানের কারাগার থেকে। তিনি রাওয়ালপিন্ডি থেকে রওয়ানা হয়েছেন অজানার উদ্দেশে। এতে বাংলার মানুষের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা আরও বেড়ে যায়।
বাংলার মায়েরা সৃষ্টিকর্তার কাছে দু’হাত তুলে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও সুস্বাস্থ্য কামনা করে দীর্ঘ নয় মাসের পর তখনও প্রার্থনা করছেন। তখন বিকেল পেরুচ্ছে। শীতের সন্ধ্যা। বিবিসি থেকে প্রচারিত হলো বঙ্গবন্ধু লন্ডনে। তিনি টেলিফোনে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এ্যাডওয়ার্ড হিথ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং সর্বশেষ বেগম মুজিবের সঙ্গে কথা বলেন।
বঙ্গবন্ধুর মুক্তির খবরে সারা বাংলা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে। এতদিনে যেন বিজয়ের স্বাদ পাবার সময় এসেছে। তাঁর নাম, তাঁর আহ্বানে বাংলার তরুণ দামাল ছেলেরা সশস্ত্র যুদ্ধ করে ফিরিয়ে এনেছে রক্তাক্ত পতাকা এবং স্বাধীন ভূখন্ড। বাঙালি যেন ‘মহা হুংকারে কংস-কারার ভাঙিয়া পাষাণ দ্বার/ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরে করিয়া আনিল বার।’
সারা বাংলার পথে পথে আনন্দ মিছিলে নেমেছে তরুণ, যুবা, বৃদ্ধ, শিশু ও নারীরাও। মুক্তির সংগ্রাম শুরুর এক স্বপ্নাবিষ্ট মানুষেরা চাতকের মতো আকাশপানে তাকিয়ে কখন আসবেন জাতির পিতা। বধ্যভূমি, ধ্বংসস্তূপ আর বিধ্বস্ত দেশে আবার নতুন চেতনায় গড়ে তোলার কাজে পুরো জাতিকে করবেন নিবেদিত। মুক্তির খবর শুনে কান্নার জল নেমে এসেছিল অযুত মানুষের চোখে।
ফাঁসির মঞ্চ থেকে বঙ্গবন্ধুকে ফিরিয়ে আনা যাবে কি- এমন ভাবনা কেটে যাবার পর আনন্দের অশ্রুজল মায়েরা মুছে ছিলেন আঁচলে। চারদিকে জয়বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগানে প্রকম্পিত। একটি আত্ম উদ্বোধনে বিকশিত জাতি রক্তরাখি পরে যে বিজয় অর্জন করেছে, তার মূল প্রতিপাদ্য ফিরে আসছেন বাংলায়- আনন্দ যেন বাঙালির জীবনে তখন এসেছিল হৃদয়ের গভীর আবেগে মথিত হয়ে। লন্ডনে সাংবাদিকদের বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বাংলাদেশ একটি ‘অপরিবর্তনীয় বাস্তবতা’। বঙ্গবন্ধুর মুক্তি সারা বাংলাদেশের সেদিনের চিত্র আজকের বাস্তবতায় উপলব্ধি করা কঠিন।
॥ দুই ॥
বঙ্গবন্ধু যখন লন্ডনের হোটেলে; কলকাতায়ও খবর পৌঁছে গেছে। আনন্দবাজার পত্রিকার বার্তা সম্পাদক তখন শান্তি নিকেতনের শিক্ষার্থী শ্রীহট্টের অমিতাভ চৌধুরী, যিনি যুদ্ধকালে কলকাতায় তার বাড়ির ছাদে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে রেখেছিলেন, ফোন করলেন বঙ্গবন্ধুকে নিজের পরিচয় দিয়ে। ‘তার মুখে জয় বাংলা কথাটা শুনে আমি শিহরিত হয়েছিলাম এবং তিনি যখন ওই টেলিফোনেই বলতে শুরু করলেন, ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই, ওরে ভয় নাই,’ তখন আমি বাকরুদ্ধ।’
এর সপ্তাহখানেক পর অমিতাভ চৌধুরী ঢাকায় এলে ৩২ নম্বরের বাসভবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতকালে নিজের পরিচয় দিতেই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘চিনেছি, আপনিইতো আমাকে ফোন করেছিলেন লন্ডনে।’ বঙ্গবন্ধু মিয়াঁওয়ালি জেলে বন্দী সময়ের কথা বলেছেন তাকে; ‘তখন বারবার আবৃত্তি করতেন, ‘নাই নাই ভয়, হবে হবে জয়, খুলে যাবে এই দ্বার।’
বঙ্গবন্ধুর মুক্তির খবর বিশ্বের যে প্রান্তেই বাংলাভাষী মানুষরা ছিলেন, তাদের কাছে স্বস্তির নিশ্বাস নিয়ে এসেছিল। ৮ জানুয়ারি একাত্তর- বাঙালির উপলব্ধিতে জেগে উঠেছিল এই চেতনাটি যে, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের প্রকৃত অর্থেই অভিন্ন ও একাত্ম।
তিনিই সেই বঙ্গবন্ধু যিনি, নির্জন সেলের সামনে কবর খুঁড়তে দেখেও ভয় পাননি; বরং পাক জেলারকে বলেছিলেন, ‘আমি বাঙালি, আমি মুসলমান, আমি মানুষ। মানুষ একবারই মরে, বারবার মরে না। আমি কখনোই আত্মসমর্পণ করব না। যদি তোমরা আমাকে মেরে ফেলো, মৃত্যুর পর আমার লাশটা আমার দেশে আমার মানুষদের কাছে পৌঁছাইয়া দিও।’
ভয় বঙ্গবন্ধুকে কাবু করেনি কখনও। পরম প্রতাপশালী সাহস ছিল জীবনজুড়ে। ভয়কে তুচ্ছ করেছেন। আকাশবাণী কলকাতা থেকে ৮ জানুয়ারি বেজে উঠেছিল শ্যামল গুপ্তের লেখা, শ্যামল মিত্রের সুর দেয়া মান্নাদের কণ্ঠে গান, ‘সাড়ে সাতকোটি মানুষের ভাগ্যবিধাতা শেখ মুজিবুর তোমায় প্রণাম।’ সে এক অভূতপূর্ব আনন্দ যেন বয়ে যাচ্ছিল তরুণ মনে, কিশোর মনেও। শরণার্থী জীবন ছেড়ে আসা স্বদেশের বিধ্বস্ত বাসভূমিতে দাঁড়িয়ে মা-বোনেরা প্রার্থনাই করেছেন বাঙালির আরাধ্য পুরুষের শুভ কামনায়।
॥ তিন ॥
বঙ্গবন্ধুর মুক্তির খবর রটে গেল সারা বিশ্বে। আলোড়িত হয়েছিলেন বাংলাদেশের মানুষ ছাড়াও বহির্বিশ্বেও কোটি কোটি মানুষ। আরো আলোড়িত হয়েছিলেন ৭৫ বছর বয়সী দিলীপ কুমার রায় ওরফে মন্টু। বঙ্গবন্ধুর প্রিয় গান ‘ধন ধান্য পুষ্পভরা আমার এই বসুন্ধরা’র স্রষ্টা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সুযোগ্য পুত্র। সুদর্শন শিক্ষিত আধুনিক বিলেতফেরত দিলীপ কুমার রায় পুরো বিশ শতক জুড়েই ছিলেন আলোচিত, আলোকিত এবং বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু ছিলেন তার বন্ধু স্থানীয় এবং গানের ভক্ত। মহাত্মা গান্ধী তাঁর গানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গান নিয়ে ‘বাহাস’ তো এখন গ্রন্থিত। নজরুলের সঙ্গে ঢাকায় এসেছেন। রাণু সোমকে গান শিখিয়েছেন। কাজী মোতাহার হোসেনের সঙ্গেও ছিল ঘনিষ্ঠতা। একসময় শ্রী অরবিন্দের আশ্রমে পন্ডিচেরিতে কাটিয়েছেন ১৯২৮ থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত। এরপর দেশের নানা জায়গায় গান করতেন, ভাষণ দান এবং ভ্রমণ করতেন, গান শেখাতেনও। ১৯৫৩ সালে ভারত থেকে যে শিল্পী প্রতিনিধি চীন গিয়েছিলেন, তাতে তিনিও ছিলেন। বঙ্গবন্ধু সে সময় চীন সফর করছিলেন। সেখানেই দিলীপ কুমার রায়সহ অন্যান্য বাঙালী শিল্পী সাহিত্যিকদের সঙ্গে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা।
বঙ্গবন্ধু তার গানের মুগ্ধ শ্রোতা ছিলেন। দিলীপ কুমার মন্টু হিসেবেই পরিচিতি পেয়েছিলেন। তাঁর গান সম্পর্কে বলা হয়, ‘সেকি গান, সুরের মধ্যে যেন জাদুস্পর্শ ছিল। প্রত্যেক শ্রোতা সুরে সম্মোহিত হয়ে থাকতেন। তাঁকে সুভাষ বসু বলতেন, দেশ যদি হয় পরাধীন তো দেশের বন্ধন মুক্তিই প্রধান লক্ষ্য। মন্টু সেই লক্ষ্য থেকে নিজেকে চ্যুত করেননি। ভুবন বিখ্যাত সঙ্গীতবিশারদ দিলীপ কুমার রায় পিতা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গান ছাড়াও রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীত, ভজন, গীত, গজল, ঠুংরি গেয়েছেন। বহু শিল্পীকে দীক্ষা দিয়েছেন। বহুমুখী ও বহুমাত্রিক দিলীপ কুমার তার সময়কালে মাতিয়ে রেখেছিলেন সঙ্গীত জগতকে। মহাত্মা গান্ধীর স্নেহ পেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বেশ সমঝদার হিসেবে মূল্যায়ন করতেন। নজরুলের সঙ্গেও ছিল সখ্য।
একাত্তর সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সত্তরোর্ধ্ব বয়সেও যুগিয়েছেন প্রেরণা। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে বিবৃতিও দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির সংবাদ শুনে তিনি যারপর নাই আলোড়িত হয়েছিলেন। নেতাজী সুভাস চন্দ্র বসু, কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা গান্ধী, নজরুল, জসীমউদদীনের সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠা দিলীপ কুমারের কাছে একটি জাতির মুক্তিদাতা হিসেবে মূল্যায়িত হয়েছেন গভীর আলোড়ন থেকেই বঙ্গবন্ধু। আর সে দিনই তিনি লিখে ফেলেন এক গীতিকবিতা। পিতার সৃষ্ট বিখ্যাত গান, যা মুক্তিযুদ্ধকালে বাঙালির প্রেরণা হয়ে বেজেছিল আবারও, সেই ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’ গানটির আদলে লিখে ফেলেন গীতিকবিতাটি। পাঠিয়ে দেন সাপ্তাহিক দেশ সম্পাদক সাগরময় ঘোষকে। ১৫ জানুয়ারি ৭২ সংখ্যায় ছাপা হয় ‘শ্রী দিলীপ কুমার রায়’ এর লেখা কাব্য। শিরোনাম ‘মহামতি মজবুর রহমান’।
বঙ্গবন্ধুর নাম সে সময় কোথাও মুজিবুর, কোথাও মুজিবর, আবার কোথাও মজিবুর কিংবা মজবুর ছাপা হয়েছে। দিলীপ কুমার রায় সম্ভবত ফার্সী উচ্চারণকে প্রাধান্য দিয়েছেন। ত্রিশ লাইনের কবিতায় পাঁচটি স্তবক এবং ৬ লাইনের প্রতি স্তবকের শেষের দু’টি লাইনে পুনরাবৃত্তি ঘটিছে। কবিতার নিচে তারিখ ‘৮/১/৭২’ দেয়া হয়েছে ‘এবং বন্ধনীর মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে ‘(দ্বিজেন্দ্র লালের-‘বঙ্গ আমার জননী আমার সুরে গেয়)’ বঙ্গবন্ধু যখন বাহাত্তর সালের ফেব্রুয়ারিতে কলকাতা যান। দিলীপ কুমার রায় বাংলার মুকুটহীন সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাত করেন এবং গানটি গেয়ে শুনিয়েছিলেন।
৮ জানুয়ারি একাত্তর আলোড়িত করেছে আনন্দের উল্লাসে বাঙালি জাতিকে। দিলীপ কুমার গাইলেন ‘সোনার বাংলা তোমার কণ্ঠে ঝঙ্কৃত মধু মূর্ছনায়/তারি আহ্বানে মুক্তিবাহিনী অভিনন্দিত বাংলা মায়।/ এসো ফিরে বীর গৌরবে, করো বাংলা মায়ের কোলে বিরাজ/ “ভাই ভাই” এই সুর বাংলায় জাগাও তোমার সঙ্খে আজ।/ বাংলা মায়ের দীপ্ত দুলাল! মা গাইছে শোন; “আয় রে আয়!/ কালো বেদনার মেঘের বিদ্যুৎ ফোটে দেখ তোর আরাধনায়!’/
সেদিন সত্যি বিদ্যুৎ ফুটেছিল/বাঙলায়। লাখো লাখো মানুষের আত্মদান, বিধ্বস্ত নগর, জনপদ, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহহীনতা, ধ্বংসের ভেতর আঁধার জেগে ওঠার আকুতির মধ্যে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির পথ চেয়ে থেকেছে বাঙালী। আর মুক্তির ঘোষণা ঝঙ্কার তুলেছিল সাড়ে সাতকোটি তন্ত্রীতে। দিলীপ কুমার রায়ের কবিতাটা এই ৪৯ বছর পর পাঠ করার মুহূর্তে সে সময়ের তারুণ্যের স্মৃতিতে নাড়া দেবে ৮ জানুয়ারি বাঙালীর মুক্তির বজ্রনিনাদ গর্জে ছিল। বাঙালি ফিরে পেয়েছিল তাঁর সাহসের আবরণ। কবিতাটি এখনও সতেজ করে।
লেখক- মহাপরিচালক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি), একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক।
এসএ/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।