ঢাকা, শুক্রবার   ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪

অগ্নিঝরা মার্চ

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইয়াহিয়ার বৈঠক

প্রকাশিত : ০৯:১৪, ১৬ মার্চ ২০১৯

১৯৭১-এর এই দিনটি ছিল লাগাতার চলা অসহযোগ আন্দোলনের পঞ্চদশ দিবস। ১ মার্চ জনাব ভুট্টোর প্ররোচনায় ইয়াহিয়া কর্তৃক ঘোষিত একতরফাভাবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত অহিংস-অসহযোগ ইতিমধ্যে সর্বব্যাপী রূপ লাভ করে। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ৪টি শর্ত মেনে নেওয়ার জন্য সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তানে এক অভূতপূর্ব রাজনৈতিক জাগরণ লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশে স্বাধিকারের দাবিতে আন্দোলনরত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সব সংগঠন পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য সমগ্র বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে তোলে।

রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পূর্ণরূপে বঙ্গবন্ধুর অনুকূলে। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, এখন আর বাঙালি জাতির পরিপূর্ণ স্বাধীনতার আন্দোলনকে বিচ্ছিন্নতাবাদের চোরাবালিতে নিক্ষেপ করা সম্ভব নয়। যারা বঙ্গবন্ধুর কর্মসূচিকে বিচ্ছিন্নতাবাদের ষাড়যন্ত্রিক অভিধায় অভিহিত করতে সচেষ্ট ছিলেন, তারাই এখন বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে দেশে ও বিদেশে চিহ্নিত হয়েছেন। আমি আগেই উল্লেখ করেছি, জনাব ভুট্টো বিভিন্ন সময়ে দেওয়া তার বিতর্কিত অগণতান্ত্রিক বক্তব্যের জন্য খোদ পশ্চিম পাকিস্তানেই বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে কুখ্যাতি অর্জন করেছেন।

পশ্চিম পাকিস্তানের সব রাজনৈতিক দল তাকে ও তার দল পিপলস পার্টিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং অখণ্ড পাকিস্তান ভাঙার প্ররোচনার জন্য দায়ী করে তাদের বক্তব্যাদি প্রদান করে স্ব-স্ব রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট ও মূর্ত নির্দিষ্ট করেছেন। বস্তুত `৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সংরক্ষিত নারী আসনের ৭টিসহ সর্বমোট ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করে এবং বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের ভোটপ্রাপ্তির হার ছিল ৭৫.১০ শতাংশ। অপরদিকে জনাব ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান পিপলস পার্টি জাতীয় পরিষদে পাঞ্জাবে ৬৪টি, সিন্ধুতে ১৮টি, সীমান্ত প্রদেশে একটি ও সংরক্ষিত নারী আসনে ৫টিসহ সর্বমোট ৮৮টি আসনে বিজয়ী হয় এবং পশ্চিম পাকিস্তানে পিপলস পার্টির ভোটপ্রাপ্তির হার ছিল ৩৭ শতাংশ। এ রকম ফলাফলের ভিত্তিতে কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হবে, এটাই ছিল স্বাভাবিক।

পাকিস্তানের উভয়াংশের উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজিত অবস্থায় সর্বমহলের চাপে অবশেষে প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান আজ মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১১টায় কড়া সামরিক প্রহরায় প্রেসিডেন্ট ভবনে বঙ্গবন্ধু মুজিবের সঙ্গে প্রথম দফা আলোচনা বৈঠকে মিলিত হন। প্রথম পর্বের এ বৈঠক ছিল ওয়ান টু ওয়ান এবং রুদ্ধদ্বার আলোচনা। অর্থাৎ প্রায় আড়াই ঘণ্টা স্থায়ী এ বৈঠকে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন না। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে প্রেসিডেন্ট ভবনের দিকে যাত্রার প্রারম্ভে ধানমণ্ডির ৩২নং বাসভবনের সামনে বিপুল সংখ্যক দেশি-বিদেশি সাংবাদিক ও আলোকচিত্রী বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে ধরেন। বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সম্মুখ প্রাঙ্গণ তখন লোকে লোকারণ্য। মনে আছে, প্রদীপ্ত-প্রোজ্জ্বল মুখে স্মিত হাস্যে বাঙালির প্রাণের স্লোগান ‘জয় বাংলা’ রণধ্বনি উচ্চারণ করে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হাত তুলে সবার উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এখন কিছুই বলার নাই।’ উপস্থিত অসংখ্য ভক্ত-অনুরক্ত-সমর্থকদের শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করে শোকের স্মারক কালো পতাকা উড্ডীন সাদা রঙের গাড়িটিতে আরোহণ করেন। সংগ্রামী জনতাও তাদের নেতার উদ্দেশে `জয় বাংলা` রণধ্বনি উচ্চারণ এবং ‘মহান জাতির মহান নেতা শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’ ধ্বনি সহকারে নেতাকে বিদায় জানান। বঙ্গবন্ধুর গাড়ি প্রেসিডেন্ট ভবনের সামনে পৌঁছলে পুনরায় এক ঝাঁক সাংবাদিক তাঁকে ঘিরে ধরেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপ করেই বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রবেশ করেন। সাংবাদিক পরিবেষ্টিত অবস্থায় জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যসহ আমরা অপেক্ষায় থাকি। বৈঠক শেষে ঠিক দুপুর দেড়টায় প্রেসিডেন্ট ভবনের প্রধান ফটকের কাছে গাড়ি থেকে নেমে বঙ্গবন্ধু উপস্থিত অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, `আলোচনা অব্যাহত থাকবে। আগামীকাল প্রেসিডেন্টের সঙ্গে পুনরায় বৈঠক হবে।’ ‘প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনায় খুশি হয়েছেন কি-না?’ জনৈক সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, `আমি রাজনৈতিক ও অন্যান্য সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা করছি। আরও আলোচনা হবে।’ ‘প্রেসিডেন্টের সাথে আলোচনায় কতদূর অগ্রগতি হয়েছে` জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘আলোচনা চলছে, আরও আলোচনা হবে।’ এরপরও সাংবাদিকরা জেরা করার মতো একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকলে বঙ্গবন্ধু মৃদু হেসে বলেন, ‘এর চেয়ে বেশি কিছু আমার বলার নাই।` বঙ্গবন্ধু যখন সতর্কতার সঙ্গে সাংবাদিকদের চাতুর্যপূর্ণ প্রশ্নাবলি এড়িয়ে যাচ্ছিলেন, তখন একজন বিদেশি সাংবাদিক উচ্চকণ্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে দেন, ‘আলোচনার পরিবেশ কি বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল?’ জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আর কোনো প্রশ্ন করবেন না। আলোচনা চলবে। এ জন্য সময়ের দরকার। এটি দু`এক মিনিটের ব্যাপার নয়।’ অতঃপর বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট ভবন হতে স্বীয় বাসভবনের উদ্দেশে যাত্রা করেন।

রাজধানীর ঢাকায় যখন বঙ্গবন্ধু মুজিব-জেনারেল ইয়াহিয়া আলোচনা চলছে, তখন বাংলাদেশের আনাচেকানাচে বিক্ষুব্ধ সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গের মতো তরঙ্গায়িত হচ্ছে অসহযোগ আন্দোলন সৃষ্ট স্বাধিকার থেকে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে জাতীয় মুক্তির ঢেউ। যেসব সরকারি, আধা-সরকারি অফিস-আদালত, স্বায়ত্তশাসিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী চালু রাখার জন্য বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দান করেছেন। কেবল সেগুলো ছাড়া অন্য সব অফিস-আদালত বা প্রতিষ্ঠানে কর্মচারীদের অসহযোগিতা অব্যাহত থাকে। আজ ঢাকা হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে আইনজীবীদের এক সভায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে যে কোনো ত্যাগ স্বীকারের জন্য আইনজীবীরা শপথ গ্রহণ করেন। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত এক প্রস্তাবে বলা হয়, `জাতির প্রতি প্রদত্ত পবিত্র প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ইচ্ছাকৃতভাবে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর বিলম্বিত করেছেন। প্রেসিডেন্ট তার প্রতিশ্রুতি পালনের উদ্দেশে নির্বাচনের অব্যবহিত পর জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করলে এতদিনে ক্ষমতা হস্তান্তরের কাজ সুসম্পন্ন হতো। সেনাবাহিনী কর্তৃক নিরস্ত্র জনগণের ওপর যে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে, আমরা তার তীব্র নিন্দা জানাই। এক্ষণে যত দ্রুত সম্ভব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রদত্ত ৪টি শর্ত মেনে নেওয়ার জন্য প্রেসিডেন্টের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি।’ বিকেলে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও মুর্তজা বশীরের নেতৃত্বে চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্রদের একটি মিছিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে স্বাধিকার আন্দোলনের কর্মীদের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে। সকালে বাংলা একাডেমীতে শিল্পী কলিম শরাফীর সভাপতিত্বে অসহযোগের সমর্থনে ব্রতচারী আন্দোলনের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। অসহযোগের সমর্থনে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে `বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ’ প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। বিকেলে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে ডাক বিভাগের কর্মচারীরা এক সভা আহ্বান করে এবং বঙ্গবন্ধু নির্দেশিত কর্মসূচির সমর্থনে মিছিল বের করে।

কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সার্ভিসগুলোতে ফেডারেশনের উদ্যোগে পূর্ব পাকিস্তান সরকারি অর্থনীতিবিদ ও পরিসংখ্যানবিদ সমিতির এক সভায় বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করা হয়। এ ছাড়াও এদিন চামড়া ব্যবসায়ী সমিতি, ইপি ওয়াপদা অফিসার সমিতি, ইপি মৎস্য উন্নয়ন সংস্থার কর্মচারী সমিতি, পূর্ব বাংলা বীমা সংস্থাগুলোর কর্মচারী সমিতি, নোয়াখালী মুসলিম অ্যাসোসিয়েশন, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সার্ভিস ও পেশাদার সংস্থাগুলোর ফেডারেশনের স্টিয়ারিং কমিটি প্রভৃতি সংস্থার পৃথক পৃথক সভায় আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার এবং বঙ্গবন্ধু ঘোষিত কর্মসূচি মেনে চলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। টঙ্গী ও নারায়ণগঞ্জে বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ কর্মসূচির সমর্থনে শ্রমিকদের বিশাল মিছিল বের হয়। এদিন ডক শ্রমিকরা শীতলক্ষ্যায় এক বিশাল নৌ-মিছিল বের করে। দুপুরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ইস্টার্ন ফেডারেল কর্মচারী ইউনিয়ন বীমা কর্মচারী সমিতির উদ্যোগে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়, `বাংলার মুক্তির জন্য শেখ মুজিবের যে কোনো সিদ্ধান্ত মেনে চলব এবং স্বাধিকার অর্জনে যে কোনো প্রকার ত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকব।` আওয়ামী লীগের সাহায্য তহবিলে মুক্তহস্তে দান করার জন্য দেশের সব বীমা প্রতিষ্ঠানের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। এদিন ঢাকা মেডিকেল ও আইপিজিএমের নার্সিং স্টাফরা আওয়ামী লীগের সাহায্য তহবিলে একদিনের বেতন প্রদানের ঘোষণা দেন।

এদিন পূর্ব পাকিস্তান অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল কর্তৃপক্ষের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘আওয়ামী লীগের নির্দেশক্রমে প্রত্যহ বেলা ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত আইডব্লিউটিএর ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সব উন্নয়ন শাখাসহ নির্দেশিত অন্যান্য দপ্তর খোলা থাকবে বিধায় সংশ্নিষ্ট দপ্তরগুলোর সবাইকে উক্ত সময়ে কাজে যোগদানের জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের নির্দেশক্রমে ঘূর্ণিদুর্গত এলাকায় সাহায্য ও পুনর্বাসন কার্য ত্বরান্বিত করার জন্য সংশ্নিষ্ট দপ্তর খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’

অসহযোগ চলাকালে সর্বস্তরের সব মানুষের সমর্থনে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সহযোগী সমমনা সংগঠনগুলোর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুলে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশগুলো সেদিন আমরা কঠোরভাবে অনুসরণ করেছি, বাস্তবায়ন করেছি।

এসএ/

 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি