বঙ্গোপসাগরে ঝলমল করছে কুতুবদিয়া
প্রকাশিত : ১০:৫৭, ৩১ জুলাই ২০২৩
পুরো কুতুবদিয়া দ্বীপটি এখন বঙ্গোপসাগরে বিশাল বাতিঘরের মতো জ্বলজ্বল করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশের প্রত্যেকটি ঘর আলোকিত করার অঙ্গীকার পূরণের অংশ হিসাবে এই দ্বীপ উপজেলার ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দীপঙ্কর তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রতি এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘এক সময় সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে অন্ধকারে নিমজ্জিত কুতুবদিয়া গত এপ্রিল থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ পেয়ে বঙ্গোপসাগরের বুকে যেনো বাতিঘরে পরিণত হয়েছে।’
তিনি বলেন, দ্বীপের লোকেরা বিদ্যুৎ সংযোগ পেয়ে বেশ আনন্দিত। তারা এখন ছোট ব্যবসার দিকে ঝুঁকছে। তারা মাছ ও বরফ শিল্পের অনুমোদনের জন্য যোগাযোগ করছে।
বিদ্যুৎ সংযোগ পাওয়ায় শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, জীবিকা ও ব্যবসার মতো প্রতিটি খাতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। ক্ষুদ্র্র শিল্প ও বাজারের উন্নতির ফলে বিশাল আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি খুঁজে পেয়েছেন।
এখন ব্যবসা দ্রুত সম্প্রসারিত হওয়ায় শিল্প-কারখানা নির্মাণ, মৎস্য ভাণ্ডার ও কোল্ড স্টোরেজসহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি উন্নয়ন কর্মকাণ্ড দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে।
তারা জানান, বিদ্যুৎপ্রাপ্তির পর যোগাযোগের উন্নয়ন ঘটছে। ফলে এখন দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। দ্বীপে উৎপাদিত সামুদ্রিক মাছ, শুঁটকি, লবণ, তরমুজ, সুপারিসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হচ্ছে।
বাজারগুলো মধ্যরাত পর্যন্ত খোলা থাকছে। রাত ১১টায়ও লোকজনকে বাজারে গল্প-গুজব করতে দেখা যাচ্ছে। গত এপ্রিল থেকে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে দ্বীপটি জাতীয় গ্রিডের সাথে যুক্ত হওয়ায় বিদ্যুতের আলো এখন দ্বীপে রাতের অন্ধকার দূর করছে।
কয়েক মাস আগেও গর্ভবতী মায়েদের সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ ডিঙ্গিয়ে ঝুঁকি নিয়ে চকরিয়া বা কক্সবাজার যেতে হতো।
তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, ‘এখন দৃশ্যপট বদলে গেছে। গর্ভবতী মায়েদের আর সাগর পাড়ি দিয়ে দ্বীপের বাইরে যেতে হবে না। দ্বীপের ৫০ শয্যার সরকারি হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটার চালু করা হয়েছে। এখানে সিজারিয়ান অপারেশন করা হচ্ছে।
বিদ্যুৎ সংযোগ পাওয়ার পর ছয়টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত ২১৫.৮০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দ্বীপের প্রায় ২ লাখ মানুষের জীবনযাত্রায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে।
কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ী থেকে মগনামা ঘাট পর্যন্ত ৩৩ কেভি লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। সেখান থেকে সাগরের তলদেশে ফাইবার অপটিকসহ ৫ কিলোমিটার ডাবল সার্কিট সাবমেরিন লাইন নির্মাণ করে কুতুবদিয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে।
গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য এখানে প্রায় ২ কিলোমিটার বিতরণ লাইন নির্মাণ করা হয়েছে।
বিদ্যুতের কারণে উপজেলার প্রায় সব এলাকায় ব্যাপক আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন হচ্ছে।
এক সময় কুতুবদিয়ার বাসিন্দারা আইসক্রিমের স্বাদ কেমন তা দেখেননি। এলাকার মনির, আজাদ ও জাকিরের মতো কিশোররা জানান, আইসক্রিমের স্বাদ কেমন তা তারা জানতো না। অথচ কুতুবদিয়া দ্বীপে এখন প্রতিদিন ৩ লাখ টাকার আইসক্রিম বিক্রি হচ্ছে বলে সূত্র জানায়।
বাসিন্দারা জানান, আধুনিক কৃষি, শিক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগ না থাকায় একসময় এটি আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন থেকে পিছিয়ে ছিল।
তারা বলেন, কিন্তু এখন দ্বীপবাসী বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি উন্নয়ন কর্মকাণ্ড দেখতে পাচ্ছেন।
ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ুয়া ১৩ বছর বয়সী রহিম জানায়, ঘরে বিদ্যুৎ পাওয়ায় তারা সহজে লেখাপড়া করতে পারছে। বিদ্যুৎ সংযোগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এবং কর্মঘণ্টা বাড়ায় কারণ রাতের বেলা রাস্তার আলোর কারণে মানুষ নিরাপদে বাড়িতে পৌঁছতে পারে।
প্রায় ৪ শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০২০ সালে হাতিয়া দ্বীপ, নিঝুম দ্বীপ ও কুতুবদিয়া দ্বীপ ১০০ শতাংশ নির্ভরযোগ্য ও টেকসই বিদ্যুতায়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয় বলে প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে। চলতি বছরের জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের আগেই কুতুবদিয়া দ্বীপে বিদ্যুৎ পৌঁছে যায়।
মানোয়ারখালী গ্রামের কৃষক রাকিব বলেন, ‘আগে তেল দিয়ে জেনারেটর চালিয়ে মোবাইল চার্জ করতাম। তেল না থাকলে অন্যের বাড়িতে গিয়ে সৌরবিদ্যুৎ দিয়ে চার্জ করতে হতো। এখন আমার বাড়িতে বিদ্যুৎ আছে।’
আরস সিকদারপাড়ার ৬৪ বছর বয়সী বজল করিম বলেন, ‘আগে সোলার দিয়ে বাল্ব জ্বালাতাম। এখন বাড়িতে রাইস কুকারে ভাত রান্না হয়। ফ্রিজ কিনেছি তাতে সামুদ্রিক মাছ রাখতে পারি।’
কুতুবদিয়া উপজেলা সদরের বড়ঘোপ বাজারের ব্যবসায়ী করিম উদ্দিন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার কুতুবদিয়াবাসীর স্বপ্ন পূরণ করেছে।
তিনি বলেন, ‘কখনও ভাবিনি কুতুবদিয়ায় বিদ্যুৎ আসবে। ১২ এপ্রিল রাত থেকে আমরা বিদ্যুৎ পেয়েছি। বিদ্যুৎ গতিতে আমাদের জীবন বদলে গেছে।’
কুতুবদিয়া তিন দিকে বঙ্গোপসাগর দ্বারা বেষ্টিত। উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ এবং পূর্বে কুতুবদিয়া চ্যানেল।
লবণ আহরণ দ্বীপের প্রধান পেশা। এখানে একটি বাতিঘর, সমুদ্র সৈকত এবং কুতুব আউলিয়ার মাজার রয়েছে।
সূর্যাস্ত দেখার জন্য কুতুবদিয়া সমুদ্র সৈকতের তুলনা নেই। এখানে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত অবস্থিত। এই সৈকতের অন্যতম আকর্ষণ গাঙচিল।
মাছ চাষের কারণে এখানে প্রচুর গাঙচিল আসে। প্রকৃতিপ্রেমীরা গাঙচিলের ডানা ঝাপটানোর অনিন্দ্য সুন্দর দৃশ্য দেখতে সেখানে ভিড় জমায়। (বাসস)
এএইচ
আরও পড়ুন