ঢাকা, মঙ্গলবার   ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪

‘বডি স্প্রে কালচার’ দূরে ঠেলে ফিরুক সাশ্রয়ের সংস্কৃতি

অমল সরকার

প্রকাশিত : ২১:২২, ১৩ নভেম্বর ২০২২ | আপডেট: ১৯:০৭, ২৭ ডিসেম্বর ২০২২

করোনা পরবর্তী বিশ্ব অর্থনীতি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে গোটা পৃথিবী এক নতুন সংকটের মুখোমুখী। অর্থনীতির পণ্ডিতেরা বলছেন, আগামী দিনগুলিতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার নিতে পারে। বিশ্বজুড়ে খাদ্য সংকট, দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না অনেকে।

কোনও সন্দেহ নেই, পরিস্থিতি তেমন দিকে গড়ালে সবচেয়ে বিপদে পড়বেন বিশ্বের ধনী দেশের নাগরিকেরা যাদের সংকট মোকাবিলার অভিজ্ঞতা নেই। অনটন শব্দটি যাদের অভিধানে নেই। 

একটু অবাক করা মনে হলেও একথাটি সত্যি যে টিকে থাকার লড়াইয়ে এগিয়ে থাকবে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি, যেখানে নাগরিকদের একাংশকে সংকট মোকাবিলা করেই সম্বৎসর বাঁচতে হয়। এই তালিকায় ভারত, বাংলাদেশ-সহ উপমহাদেশের সব দেশই আছে। বাংলাদেশের মানুষের যে দুর্লভ অভিজ্ঞতাটি রয়েছে তা হল, দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতির মধ্যে যুদ্ধ করে তারা নিজেদের দেশকে পাক হানাদার বাহিনীর কবল মুক্ত করেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অভিজ্ঞতা যে কোনও পরিস্থিতির মোকাবিলাতেই তাদের পাথেয়।

তবু কিছু বাস্তব সমস্যা মনে রেখে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনাচিন্তা জরুরি। আমার মনে হয়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই কারণেই দেশবাসীকে আরও উৎপাদনমুখী হতে আর্জি জানিয়েছেন। বলেছেন, যেখানে যতটুকু জমি আছে তাতে কিছু না কিছু চাষ শুরু করতে। কারণ, মন্দা তীব্রতর হলে সবচেয়ে বেশি বিপদ আসে আমদানিতে। টাকা থাকলেও বিদেশ থেকে খাদ্যপণ্য আনা সহজ হবে না তখন। তাছাড়া, স্বয়ম্ভরতার কোনও বিকল্প হয় না। পরনির্ভরশীলতা এক ধরনের পরাধীনতাই। 

যে কোনও সংকটই মানুষকে সৃজনশীল করে তোলে। অর্থনৈতিক সংকট মানুষকে করে তোলে সংযমী এবং মিতব্যয়ী। করোনাও এর ব্যতিক্রম ছিল না। করোনা মহামারীর দিনগুলি, বিশেষ করে লকডাউনের সময় আমি একেবারে ব্যক্তিগত উদ্যোগে একটা কাজ করেছি। পরিচিত, অপরিচিত বহু মানুষের কাছে আমি তখন জানতে চেয়েছি, সংসার কীভাবে চলছে। 

অনেকের মতো এক-দু’জনকে আর্থিক সহায়তা করতে হয়েছে বটে, কিন্তু বেশিরভাগেরই তার প্রয়োজন হয়নি। তারা বাজেট কাটছাট করে ঠিক চালিয়ে নিয়েছেন। অনেকেই তখন বলেছেন, করোনা অনেক জীবন কেড়ে নিচ্ছে বটে, কিন্তু এই ধাক্কাটা আসাতে আমরা বুঝতে শিখলাম কীভাবে সংকটের মোকাবিলা করতে হয়। অনেকেই বলেছেন, করোনাকালে সবচেয়ে বড় শিক্ষা হল, সংসারটা অনেক কম টাকায় চালানো যায়। বিশেষ করে খাবার এবং সংসারের আনুষঙ্গিক খরচ অর্ধেকে নামিয়ে এনেও অভাববোধ হয়নি। 

এমন অভিজ্ঞতা, উপলব্ধির কারণ, আমরা আসলে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যয় করছিলাম। গোটা বিশ্বে এটা বিরাট এক সমস্যা যে, মানুষ বড্ড বেহিসেবি হয়ে উঠেছে। খাওয়াদাওয়া, পোশাকআশাক, সাজগোজ থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনের সব কিছুতেই আমরা আসলে ‘বডি স্প্রে সংস্কৃতি’র শিকার। 

‘বডি স্প্রে সংস্কৃতি’ কথাটি আমারই ভাবনাজাত। এটা বলতে বোঝাতে চাইছি, আমরা যেভাবে শরীরে সুগন্ধী ছেঁটাই। মনে আছে, ছোটবেলায় সেন্টের শিশি থেকে এক ফোঁটা তুলোয় নিয়ে আমরা পোশাকের নানা জায়গায় লাগিয়ে দিতাম। তাতেই দিন কয়েক কাজ চলে যেত। এখন রোজ শরীরের সর্বত্র সুগন্ধী স্প্রে করি এবং তা করার সময় আমাদের কোনও হুঁস থাকে না। খাওয়াদাওয়া থেকে শুরু করে বাকি সব ব্যাপারেই আমরা খরচ করি অনেকটা শরীরে বেহিসেবিভাবে সুগন্ধী স্প্রে করার মতো করে। 

ভোগবাদী ব্যবস্থা আমাদের আরও বেশি করে এদিকে ঠেলে দিচ্ছে। আজকাল লক্ষ্য করি, নিমন্ত্রণ বাড়িতে যাওয়ার আগে লোকে দিনভর নানা ওষুধপত্র খেয়ে নিজেকে তৈরি করছে ভালমন্দ খাবে বলে। আবার খাওয়াদাওয়া শেষ করেই টপাটপ গুচ্ছ ওষুধ উদরস্থ করে। 

ওষুধের সহজলভ্যতা আমাদের মধ্যে এক ধরনের নেতিবাচক আত্মবিশ্বাস তৈরি করেছে। শরীর নেবে না জেনেও আমরা এটা, ওটা খাই। কারণ, জানি, পেট, শরীর গড়বড় করলে ওষুধ আছে।

শুধু খাওয়াদাওয়াই কেন, আরও অনেক ব্যাপারেই আমরা বেহিসেবী। প্রয়োজনের অতিরিক্ত খরচ করি। রোজকার জীবন থেকে কিছু সাধারণ দৃষ্টান্ত দেব, যা শোধরানো প্রয়োজন। যেমন, ধরুন, সাবানের ব্যবহার। আমরা ছোটবেলায় পুকুরে, নদীতে স্নান করতে গিয়ে সাবান মাখতাম অনেক যত্ন করে। ডুব দিতে পাড়ে এসে সাবান মেখে তারপর সেটি আড়ালে রেখে স্নান করতাম। যাতে কাক, পাখি সেটা নিয়ে যেতে না পারে। স্নান শেষে যত্ন করে সাবানটি শুকিয়ে নিতাম, যাতে গলে নষ্ট না হয়। লক্ষ্য করে দেখবেন, এখন সাবানের অর্ধেকটা বাথরুমে গলে নষ্ট হয়ে যায়। একই কথা প্রযোজ্য শ্যাম্পু, টুথপেস্টের ক্ষেত্রেও। অনাবশ্যক বেশি ব্যবহার করছি আমরা। 

আমার মনে হয়, যে সংকট আসছে বলে আশঙ্কা ঘনিভূত হয়েছে, তার মোকাবিলায় আমাদের সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে এই ‘বডি স্প্রে সংস্কৃতি’। যা আসলে সাশ্রয়ের সংস্কৃতির ঠিক বিপরীত এবং ততধিক ভয়ঙ্কর। 

সাশ্রয় এবং সঞ্চয়, এই দুটি ব্যক্তি নাগরিক থেকে রাষ্ট্র, সর্বত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণভাবে আমরা মনে করি সঞ্চয় হল, প্রয়োজনের অতিরিক্ত অংশ জমানো। সেটা টাকা পয়সা, খাবারদাবার, সব কিছুই হতে পারে। আর সাশ্রয় হল, প্রয়োজনের পরিমানটাকে কমিয়ে ভবিষ্যতের জন্য জমানো। সেটাও এক ধরনের সঞ্চয়। অর্থাৎ উদ্বৃত্ত হওয়া সঞ্চয়ের পূর্ব শর্ত নয়।

এই সাশ্রয়ের সংস্কৃতির বড় ধারকবাহক ছিলেন আমাদের মা-কাকিমারা। ছোটবেলায় মা’কে দেখেছি, ভাতের জন্য চাল নেওয়ার সময় প্রতিদিনই এক-দু মুঠো করে চাল আবার হাঁড়িতে তুলে রাখতেন। এটাই প্রচলিত রীতি ছিল। এইভাবে প্রতিদিন এক-দু’মুঠো করে জমানো চাল দিয়েই মাস শেষে টানাটানির দিনগুলি চালিয়ে নেওয়া হত। আমার মতে, এটা হল মৌলিক অর্থনীতি। অর্থাৎ যা আছে তার পুরোটা খরচ না করে কিছুটা সাশ্রয় করা, যাতে সংকটে না খেয়ে মরতে না হয়। অর্থনীতির পাঠশালায় না গিয়েও আমাদের মা-কাকিমারাই ছিলেন সেরা অর্থমন্ত্রী। 

অনেকের ধারণা, সাশ্রয় বুঝি গরিবের দায়। আমি একটি উদ্বাস্তু পরিবারে টানাটানির সংসারে বড় হয়েছি। আমাদের পাশের একটি বাড়িটি ছিল অবস্থাপন্ন পরিবার। তারা নিজেদের জমির ধানের ভাত, ডাল, শাক-সবজি, ফল খেত। নিজেদের পুকুরের মাছ খেত। বাড়িতে আলো-পাখা ছিল। ছিল রেডিও, গ্রামাফোন, টেলিফোন, স্কুটার, ফ্রিজ ইত্যাদি। পাড়ায় সবচেয়ে আগে টিভিও আসে ওই পরিবারে। সেই বাড়িতেও কাকিমা, পিসিমাদের দেখেছি, আমার মায়ের মতো যিনি অনটনের সংসার চালানোয় চলমান পাঠশালা হয়ে উঠেছিলেন, তাঁরাও হাঁড়িতে প্রতিদিন এক-দু মুঠো করে চাল, ডাল তুলে রাখতেন। তাঁদের অভাব ছিল না। কিন্তু জীবনচর্যায় সাশ্রয়ের সংস্কৃতি ছিল। অর্থাৎ সাশ্রয়ের সংস্কৃতির গরিব-বড়লোক হয় না। এটা মানবজাতির সংস্কৃতি। 

ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সফরসঙ্গী হয়ে একবার জাপান যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। টোকিও’তে একটি অনুষ্ঠানে কলকাতার এক বাঙালি ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়। তিনি একটি জাপানের একটি বহুজাতিক কোম্পানির টোকিও ডিভিশনের তখন প্রধান। কথায় কথায় জানলাম, কোম্পানি এবং নিজের কেনা মিলিয়ে তাঁর চারটি গাড়ি আছে। কিন্তু ভদ্রলোক বাড়ি থেকে মেট্রোয় চেপে এসেছেন। মেট্রো স্টেশন থেকে হেঁটে এসেছেন মিনিট দশেকের পথ। আমি বিস্ময়ের সঙ্গে কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, অযথা তেল পুড়িয়ে ভাণ্ডার খালি করা, দূষণ সৃষ্টি করার অর্থ হয় না। জায়গাটা মেট্রো স্টেশনের কাছে বলে গাড়ি বের করিনি। দুর্ভাগ্যের হল আমরা, এই উপমহাদেশের সম্পন্ন মানুষেরা এভাবে ভাবতে ভুলে গিয়েছি। 

ফিরে যাই আমাদের সম্ভাব্য সংকট মোকাবিলার প্রসঙ্গে। করোনা মোকাবিলায় আমাদের টিকা নিতে হয়েছে। আরও অনেক অসুখবিসুখ থেকে মুক্ত থাকতে আমাদের নানা ধরনের প্রতিষেধক নিতে হয়। আমার মতে অর্থনৈতিক সংকটের মোকাবিলারও প্রতিষেধক আছে। আর তাহল, সাশ্রয়। সাশ্রয়ের সংস্কৃতি ফেরাতে পারলে দুর্যোগের উত্তাল সমুদ্রে আমরা অনেকটা সময় ভেসে থাকতে পারব। 

‘ফেরাতে হবে’ কথাটি বলছি এই কারণে, যে এটাই আমাদের সংস্কৃতি যা দিয়ে আমরা বহু সংকটের মোকাবিলা করেছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের হল, প্রাচুর্য আমাদের জীবন থেকে সেই সংস্কৃতি মুছে দিয়েছে। 

তবে সময় আছে। আমরা করোনার মোকাবিলা করেছি, আর্থিক সংকটেরও মোকাবিলা করতে পারব সাশ্রয়ের সংস্কৃতিতে ভর করে। তাই চলুন সাশ্রয় করি। শুধু খাওয়াদাওয়া নয়, জীবনের সব কিছুতেই আমরা পরিমিত ব্যবহার শিখি। তাহলে কোনও সংকটই আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না।  

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, দ্য ওয়াল, কলকাতা।

এসি

 


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি