ঢাকা, সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪

‘বর্তমান কর ব্যবস্থায় চাপে সাধারণ মানুষ’

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৯:১৪, ২০ নভেম্বর ২০১৮

বাংলাদেশের একজন উচ্চবিত্ত বা ধনী মানুষ পণ্য কিনতে যে হারে কর দেন, একজন শ্রমিক বা নিম্ন আয়ের মানুষও একই হারে কর দেন। ফলে একদিকে যেমন বৈষম্য বাড়ছে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার খরচও বাড়ছে। আবার বর্তমান কর ব্যবস্থায় বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান, ধনী ব্যক্তি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে অর্থপাচার ও কর ফাঁকিতে উৎসাহিত করছে। ফলে শেষমেশ দেশ চালাতে গিয়ে মানুষের ওপর কর আরোপ করছে সরকার। ফলে জীবন চালাতে চাপে পড়ছেন সাধারণ মানুষ।

মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে একশনএইড বাংলাদেশ আয়োজিত ‘জনগণের কর আদলত’ নামের একটি অনুষ্ঠানে এমন কথা উঠে আসে।

একটি জনবান্ধব কর ব্যবস্থা প্রচলনে সরকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানকে উৎসাহিত করতে এই আয়োজন করে প্রতিষ্ঠানটি। যেখানে দেশের সাতটি বিভাগ থেকে আসা মানুষরা বলেন, দেশের বর্তমান কর ব্যবস্থা দারিদ্র্যবান্ধব নয়। সংসদে বাজেট ও কর নির্ধারণের ক্ষেত্রে গুরুত্ব পায় না দরিদ্রদের অবস্থান, বরং তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় ভ্যাটের বোঝা। এমন প্রেক্ষাপটে সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনে বৈষম্যহীন প্রগতিশীল কর ব্যবস্থা চালু করতে হবে। এজন্য সরকারকে কর্পোরেট করের উপর মনোযোগী হতে হবে।

এই আদালতে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ কর ব্যবস্থাপনা নিয়ে আরও বলেন, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির ওপর সরকার আরোপিত মূল্য সংযোজন কর ব্যবস্থা একটি অসম বন্টন। বর্তমান ব্যবস্থায় মূল্য সংযোজন কর পোশাক শ্রমিক, শিক্ষার্থী ও বস্তিবাসীসহ মধ্য ও নিম্নবিত্ত মানুষের জন্য এক ধরনের বোঝা এবং বৈষম্যমূলক। আবার বিদেশে অর্থপাচার, ধনীদের ট্যাক্স ফাঁকি কিংবা বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কর ফাঁকির কারণে সরকার সাধারণ মানুষের ওপর অতিরিক্ত কর আরোপ করেন। এ কারণে বাংলাদেশে বৈষম্য বাড়ছে বলে মনে করেন সাংসদ ফজলে হোসেন বাদশা।

তিনি বলেন, সংবিধানের সঙ্গে বাজেটের কোন মিল নেই। কারণ সংসদে যারা কর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তারা গরিবের কথা ভাবেন না। বরঞ্চ, তাদের সিদ্ধান্তে ধনী, কর্পোরেট কিংবা বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বার্থই বেশি গুরুত্ব পায়। তাই সংসদে এবং বাজেটে জনবান্ধব কর নিয়ে খুব কম কথাই হয়। যার খেসারত দিতে হয় সাধারণ মানুষকে।

‘কর আদালতে’ পাঁচটি বিষয়ে অভিযোগ উপস্থাপন করা হয়। প্রথম শুনানীতি পোশাক শ্রমিক ফাতেমা বেগম বলেন, “আমার মালিক পণ্য রপ্তানিতে চার শতাংশ ভর্তুকি পান। আবার ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে ঋণও পান। অথচ সামান্য পরিমাণে বেতন বাড়াতে আমাদের রাস্তায় নামতে হয়। অন্যদিকে সীমিত আয়ে সংসার চালাতে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতে মালিকের সমপরিমাণ মূল্য সংযোজন কর দিতে হয় আমাদের। এটা কেমন কর ব্যবস্থা?

বস্তিবাসী ফাতেমা আক্তার বলেন, “বস্তিতে বৈধ বিদ্যুতের ব্যবস্থা, গ্যাস সংযোগ, এমনকি বর্জ্য পরিস্কারের ব্যবস্থাও নেই। পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনের জন্যও সরকার কোন সেবা দেয় না। অথচ বাসা ভাড়া, বিদ্যুৎ ও পানির বিল থেকে শুরু করে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য যেমন ওষুধ, সাবান ও শিশুর লেখাপড়ার জিনিসপত্র কিনতে গেলে ভ্যাট দিচ্ছি আমরা। এমনকি মোবাইল ফোনে কথা বলতেও আমরা ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিয়ে যাচ্ছি। অথচ প্রয়োজনীয় নাগরিক সেবা পাই না। এজন্য বর্তমান কর কাঠামো ও সরকারের পরিচলনাই দায়ী।”

এরপরই কলেজ শিক্ষার্থী শাহাদাত হোসেন বলেন, “শিক্ষা ব্যয় মেটাতে আমার বাবুর্চি বাবার মাসে খরচ হয় ৬৫০০ টাকা। এর মধ্যে ৪০০ টাকাই ভ্যাট। তিন বছরে বাসের ভাড়া বেড়েছে প্রায় আড়াইগুন। সবমিলিয়ে সেবা পেতে এবং ভ্যাটের কারণে বছরে সাড়ে নয় হাজার টাকা অতিরিক্ত গুনতে হয় আমার পরিবারকে। অথচ আমার পরিবারের আয় সেই অনুপাতে বাড়ছে না। ফলে শিক্ষা ব্যয় মিটাতে আমার পরিবারকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।”

আরেকজন নগরবাসী ফজলুর রহমান অভিযোগ করেন, “সরকার পণ্য উৎপাদনকারীদের উপর ভ্যাট বা ট্যাক্স বাড়ালে তারা তাদের পণ্যের দাম বাড়িয়ে তা সমন্বয় করেন। ফলে করের টাকাটা শেষমেষ সাধারণ মানুষের পকেট থেকেই যায়। আবার সেই পণ্য কিনতে গিয়ে আরও ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হয় সেই সাধারণ মানুষদেরই। সুপারশপে কিনলে আরও ৪ শতাংশ যোগ হয়। এতো কর দেওয়ার পরও সরকারের সঠিক সেবা আমরা পাই না। প্রতিবছর বাজেট আসে মরার উপর খাড়ার ঘা হয়ে। বর্তমানে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডেও আয়ের ৩৫ শতাংশই আসে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে। অথচ এটি হওয়ার কথা উল্টো”।

অভিযোগের এমিকাস কিউরি হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলাম বলেন, “কর অন্যায্যতা ও অযৌক্তিতার কারণে ভুক্তিভোগি হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। অতিরিক্ত কর দিয়েও রাষ্ট্রের কাছ থেকে যে সেবা পাচ্ছেন তা অপ্রতুল।”

দ্বিতীয় অধিবেশনে শুনানি হয় কর্পোরেট কর ফাঁকি ও এর প্রভাব নিয়ে। এই অধিবেশনে এই বিষয়ে কিছু তথ্য উপস্থাপন করা হয়। একশনএইড বাংলাদেশ-এর গবেষণা বলছে, সরকারের সঙ্গে চুক্তির ফাঁক দিয়ে বাংলাদেশে কাজ করা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিবছর প্রায় ৭০০ কোটি টাকার কর ফাঁকি দিচ্ছে। জয়পুরহাট থেকে আসা একজন অভিযোগকারী বলেন, “সরকার এই টাকা তোলার দিকে নজর না দিয়ে সাধারণ মানুষের উপর কর আদায়ে চাপ বাড়াচ্ছে। অথচ এই টাকা তুললে সেবাখাতে বিনিয়োগ বাড়তো। করের বোঝা কমতো সাধারন মানুষের উপর থেকে।”

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্যানুসারে, ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৮টি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি ৩৪৫ কোটি টাকার কর ফাঁকি দিয়েছে। অন্যদিকে ৩টি টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানিসহ ১০টি বহুজাতিক কোম্পানির সরকারের কাছে বকেয়া রয়েছে ১৩ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া বিদেশে অর্থ পাচারতো হচ্ছেই।

অনুষ্ঠানের ধারণাপত্রে বলা হয়, বহুজাতিক কর্পোরেট কোম্পানির দ্বারা এই বিপুল পরিমাণ টাকার কর ফাঁকি ও অর্থপাচার যদি রোধ করা সম্ভব হয় তাহলে বিদেশে অর্থ পাচার বন্ধ হবে। আর টাকা দিয়ে সাধারণ জনগণের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসহ উপযুক্ত মানের নাগরিক সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি দেশে প্রচলিত কর প্রথার যেই অসম বন্টন ব্যবস্থা রয়েছে তার প্রতিকার সম্ভব হবে। সাধারণ জনগণের মাথা থেকে ভ্যাটের বোঝাও কমবে।

জনগণের এই কর আদালতের বিচারক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এমএম আকাশ বলেন, “সরকার প্রণীত নীতি ও আইনগুলো এমন যাতে রাজস্ব আয়ের বোঝাটা গিয়ে পড়ছে সাধারন মানুষের উপর। পরোক্ষ করের পরিমাণ যেখানে কম হওয়ার কথা সেখানে সাধারণ মানুষকেই সেই কর বেশি দিতে হয়। অথচ বৈধ-অবৈধ উপায়ে হাজার হাজার কোটি টাকা দেশের বাইরে পাচার করছেন ক্ষমতাসীনরা। আবার কর ফাঁকিও দিচ্ছেন তারা। সেদিকে সরকার খেয়াল নেই। ফলে এখনও এদেশে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের মত জনগুরুত্বপূর্ণ খাতে সরকারের বিনিয়োগ কম। সাধারন মানুষ কর দিয়েও সেখানে সেবা পান না। এটি খুবই দুঃখজনক।”

অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ও বিচারক ফারাহ্ কবির বলেন, “আমরা কর দিতে চাই। তবে সেই কর হওয়া উচিৎ সাধারণ জনবান্ধব। সাধারণ জনগোষ্ঠীর উপর থেকে ভ্যাটের বোঝা কমাতে বাংলাদেশ সরকারের কর্পোরেট কর আহরণের পরিমাণ বাড়াতে হবে। কারণ জাতীয় রাজস্বে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর কর সামান্য পরিমাণেই যোগ হয়। ফলে সরকারকে ভিন্ন উপায়ে যেমন ভ্যাটের উপর জোর দিতে হয় রাজস্ব আদায়ের জন্য। এই সুযোগে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো কর ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছে। আর করের ঘাটতির কারণে উন্নয়ন বাজেটের বরাদ্দ কমে যাচ্ছে, বিশেষ করে গণসেবা খাতসমূহে যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক নিরাপত্তা খাতে। তাদের বাজেট ঘাটতি এবং গরিব মানুষের উপর থেকে ভ্যাটের বোঝা কমাতে কর্পোরেট কর আদায়ের পরিমাণ বাড়াতে হবে।”

অনুষ্ঠানে জনানো হয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে সমান্তরালে অবস্থানকারী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের কর সংগ্রহের হার এখনও অনেক কম। যা ২০০৯ থেকে ২০১৮ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭.৮ থেকে ১০.৩৯ শতাংশ। কিন্তু নেপালে এ অনুপাত ১৪ শতাংশ যেখানে বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় নেপালের প্রায় দ্বিগুন। বিশেষজ্ঞদের মতে সরকার চাইলেই এই অনুপাত সহজেই ১৬ শতাংশে নিয়ে যেতে পারে। আর তার জন্য সরকারকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে কর্পোরেট করসহ অন্তর্ভুক্তিমূলক কর ব্যবস্থার উপর।

এসএইচ/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি