বাংলা নববর্ষ ও ইলিশ বিতর্ক
প্রকাশিত : ১৩:৫৬, ১৩ এপ্রিল ২০১৯
বাংলা পঞ্জিকার মাস গণনা শুরু হয় বৈশাখ দিয়ে। আর তাই বৈশাখের প্রথম দিনটি বাঙালিরা উদ্যাপন করতে চায় একটু ভিন্নভাবে। আর এই ভিন্নতায় সাম্প্রতিক সংযোজন পান্তা-ইলিশ। বৈশাখের প্রথম প্রহরে খাবারের তালিকায় মানুষ চায় এক টুকরা ইলিশ ভাজির সঙ্গে এক থালা পান্তা।কিন্তু বাংলা নববর্ষে পান্তা ইলিশ খাওয়ার প্রচলন আগে একবারেই ছিল না। এর সঙ্গে হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির কোনও সংযোগ নেই।
বাংলা নববর্ষ সৌর পঞ্জিকা অনুসারে প্রবর্তিত হয়। এই এলাকায় পান্তা ভাত সব সময়ই কৃষকের কাছে পরিচিত খাবার। এর সঙ্গে বিভিন্ন শাকসবজি ও শুটকি ভর্তা ছিল খাবারের তালিকায়। কিছু এলাকায় কচু শাকের ডাঁটা মিশিয়ে চাঁদা মাছের শুটকির প্রচলন বেশি ছিল বলে জানা যায়।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাংলা নববর্ষ উৎসবের দুটি দিক আছে। প্রথমটি আবহমান বাংলায় ধারাবাহিকভাবে চলে আসা সামজিক রীতি। অন্যটি ষাটের দশকে পাকিস্তানি শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত সাংস্কৃতিক আন্দোলন। রমনা পার্ককে ঘিরে শুরু হলেও বর্তমানে যার বিকশিত রূপ সারা বাংলাদেশ এবং বিশ্বে প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট।
জানা যায়, আশির দশকে রমনাকে কেন্দ্র করে নববর্ষে কিছু খাবারের দোকান বসে। যারা ছায়ানটের অনুষ্ঠান দেখতে যেতেন তারা সেখানে খেয়ে নিতেন। এমনই একবার অল্প কয়েকজন মিলে পান্তা ভাতের সঙ্গে ইলিশ মাছ ভাজা বিক্রি করলেন এবং তা সব বিক্রি হয়ে গেল। কয়েকজন বেকার তরুণ এই কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন। তাদেরকে উৎসাহিত করতে এবং ‘নতুন একটা কিছু প্রবর্তন’ করার মানসিকতা নিয়ে একটি গ্রুপ এর প্রচারণা চালাতে লাগলেন। যাদের মধ্যে দুই একজন গণমাধ্যমকর্মীও ছিলেন। বিষয়টা আর কয়েকজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। মুনাফালোভী গ্রুপ সক্রিয় হয়ে ওঠে। এরই মধ্যে বৈশাখের অনেক কিছুই করপোরেটদের দখলে চলে যায়।
করপোরেট সংস্কৃতি সব কিছুকেই পণ্য বানাতে চায়। সে জন্য তারা উপকরণ খোঁজে। পান্তা ইলিশ হয়ে যায় সেই উপকরণ। বৈশাখী খাবারের ব্র্যান্ডে পরিণত হয় পান্তা ইলিশ।
তাই নববর্ষে ইলিশ মাছ খাওয়া কতটা জরুরি? এমনই প্রশ্ন এখন তুলছেন অনেকে। ইলিশের প্রজনন মৌসুম হওয়ায় পহেলা বৈশাখে ইলিশ বর্জন করে মাছ বাঁচানোর আহ্বান জানাচ্ছে সচেতন মহল। বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে বেশ ভালোভাবেই চলছে এমন প্রচার।
আসলে বাংলাদেশের জাতীয় মাছ হিসেবে ইলিশ ইতিমধ্যে ভৌগলিক নিবন্ধন পেয়েছে। বিশ্বে উৎপাদিত ইলিশের ৭০-৭৫ শতাংশ বাংলাদেশে উৎপাদন হয়। দিনে দিনে এই ইলিশ উৎপাদন ক্রমাগত বাড়ছে। তবে কিছু ব্যবসায়ী এবং ভ্রান্ত ধারণার কারণে মা-ইলিশ ও জাটকা ইলিশ ধরাও বাড়ছে। জানা যায়, দেশে সারা বছর যতো জাটকা ধরা হয় তার ৬৫-৭০ শতাংশ ধরা হয় এপ্রিল মাসে বৈশাখ উপলক্ষ্যে।
মৎস্যসম্পদ গবেষক অধ্যাপক আবদুল ওয়াহাব জানিয়েছেন, ‘মার্চ-এপ্রিলে ইলিশ থাকে জাটকা অবস্থায়। তাই তা ধরার ওপরে নিষেধাজ্ঞা থাকে। কারণ জাটকা ইলিশ ধরা হলে এর উৎপাদনও কমবে। এখন যে দামে ইলিশ বিক্রি হচ্ছে তা মূলত উচ্চবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত ছাড়া কেউ কিনতে পারছেন না। ইলিশকে সারাবছর সব শ্রেণির মানুষের কাছে সহজলভ্য করতে চাইলে বৈশাখে ইলিশ খাওয়া বন্ধ করতে হবে।’
আগামীকাল রোববার বাংলা নববর্ষকে বরণ করতে সারা বাংলা প্রস্তুত। এই উৎসবকে ঘিরে তাই ইলিশ নিয়ে যেন একটা হইচই পড়ে যায়। অতীতে এমন দিনে বাজারে চলতো দামের প্রতিযোগিতা। অবশ্য এখনও তা চলমান। কিন্তু বাংলাদেশে এই রেওয়াজে কিছুটা ভাটা পড়ে ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডাকে।
প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে পয়লা বৈশাখে ইলিশ না খাওয়ার আহ্বান জানান। বলেন, আপনারা ইলিশ খাবেন না, ইলিশ ধরবেন না। পয়লা বৈশাখের খাদ্য তালিকা হিসেবে-খিচুড়ি, সবজি, মরিচ ভাজা, ডিম ভাজা ও বেগুন ভাজার কথা উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা।
কিন্তু মীনা বাজার, আগোরার মতো ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষমতা কি রাষ্ট্রের চেয়ে বেশি? যেখানে প্রধানমন্ত্রী টানা গত কয়েক বছর পহেলা বৈশাখে ইলিশ খেতে বারণ করছেন। তিনি নিজে পহেলা বৈশাখের মেনু থেকে বাদ দিয়েছেন ইলিশ। তখন এই ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানগুলো নেমেছে বাজারে অফারের বিভিন্ন আয়োজন নিয়ে। রাষ্ট্র যখন ইলিশ সংরক্ষনের তৎপর। তখনই এক বানোয়াট সংস্কৃতিচর্চার হাত ধরে এই করপোরেট লুটেরাগুলো মাঠে নেমেছে। সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে বিশিষ্ট সাংবাদিক অঞ্জন রায় এমন ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
তিনি বলেন, এখন সিদ্ধান্তে আসা দরকার-আমরা কি অবাধে কনজ্যুমারইজমের বলি হয়ে এই সময়ে ইলিশ ধরে বাকি বছরের ইলিশের উৎপাদনে বড় ঘাটতি করতে সহায়তা করবো, নাকি এই করপোরেটদের হাতের বদলে গালে ইংরেজি কায়দায় হাই ফাইভ দিয়ে শিক্ষা দেব- এখানে হাই ফাইভ দেওয়া বলতে আমি বুঝাতে চাইছি আগ্নিমূল্যে ইলিশ না কেনা। এতেই এদের মুনাফার আর লোভের গালে চড় পরবে। আগামী বছরে এই বেনিয়ারা ধান্দার ব্যবসার আগে ভাববে চালান থাকবে কি না?
নববর্ষে পান্তা ইলিশ খাওয়া প্রসঙ্গে ছায়ানটের সভাপতি ও রবীন্দ্র-গবেষক সন্জীদা খাতুন মন্তব্য করেন, ‘এক সময় আমাদের অনুষ্ঠানস্থলের (ছায়ানটের প্রভাতী আয়োজন) আশপাশে অনেক দোকান বসত। সেখানে পান্তা-ইলিশ খাওয়ানো হতো। মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এ সব দোকান দিত। দোষটা এসে চাপে আমাদের ঘাড়ে। অথচ গ্রামের হালখাতার নববর্ষ আর রমনার নববর্ষ উদযাপনের মধ্যে পার্থক্য আছে। এটা হচ্ছে বাঙালির নবজাগরণ। যারা বোঝেন না, তারা এ নিয়ে বিদ্রুপ করেন। পত্র-পত্রিকায় উপসম্পাদকীয়ও লেখেন। এ সব কথায় কখনও কান দিইনি। নববর্ষ উদযাপনে পান্তা ইলিশ খেতে হবে- এমনটা কখনও দেখিনি, শুনিনি। কারণ গ্রামের মানুষ এ সময় কাঁচা মরিচের সঙ্গে কাঁচা পেঁয়াজ দিয়ে অথবা শুকনা মরিচ পুড়িয়ে পান্তা ভাত খায়। সেখানে ইলিশ থাকে না। ইলিশ তো খুব দামি মাছ। এটা গ্রামের মানুষ কোথায় পাবে?’
লোক গবেষক শামসুজ্জামান খান মনে করেন, ‘বৈশাখে খরার মাসে যখন কোনও ফসল হতো না তখন কৃষকদের হাতে পয়সাও থাকতো না। সুতরাং তাদের পক্ষে ইলিশ কিনে খাওয়া সম্ভব হতো না। সুতরাং এটা মোটেও সত্যি নয় যে, কৃষকরা নববর্ষ উদযাপনে পান্তা ইলিশ খেয়ে বছর শুরু করতো। গ্রামবাংলায় নববর্ষের উৎসবই ছিল খুব ছোট আকারে। কৃষাণী আগের রাতে একটি নতুন ঘটে কাঁচা আমের ডাল ভিজিয়ে রাখতো, চাল ভিজিয়ে রাখতো। সকালে কৃষক সেই চাল পানি খেত, এবং শরীরে কৃষাণী পানিটা ছিটিয়ে দিত। তারপর সে হালচাষ করতে যেত। দুপুরবেলায় পান্তা খেতে পারতো কাঁচামরিচ, পেঁয়াজ দিয়ে। কখনও কখনও একটু শুটকি, একটু বেগুন ভর্তা ও একটু আলু ভর্তা দিয়ে খেত।’
আসলে বৈশাখের সঙ্গে ইলিশের সংযোগ এমনভাবে ঘটানো হয়েছে যে, মনে হয় পান্তা ইলিশ ছাড়া বৈশাখের কোনও মানে নেই। যার প্রভাব পড়ে আর্থ-সামজিক পরিমণ্ডলে। বৈশাখকে কেন্দ্র করে এ সময় মা ইলিশের ডিমসহ নিধন কেবল একটি মাছ নয়, লাখ লাখ ভবিষ্যতের ইলিশকেও ধ্বংস করা হয়।
একে//