বাংলা ভাষার প্রথম প্রস্তাবকারী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত
প্রকাশিত : ১১:৫৬, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
বাংলা ভাষার জন্য যিনি প্রথম কথা বলেছিলেন, তিনি হলেন ভাষা সৈনিক শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। ভাষা সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলা ভাষার মর্যাদা-প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের অগ্রপথিক এবং প্রবর্তক। সরকারি নথিতে বাংলা ভাষাকে মর্যাদা দানের প্রথম প্রস্তাবকারী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। ছিলেন অকুতোভয় স্বাধীনতা সংগ্রামীও।
১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে উর্দু ও ইংরেজিতে বাংলা ভাষাকে মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানিয়ে বক্তব্য দিয়েছিলেন সাহসী এই ভাষা সৈনিক। মূলত তখন থেকেই পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূত্রপাত হয়েছিল।
গণপরিষদ অধিবেশনের শুরুতে পূর্ব বাংলার কংগ্রেস দলীয় সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বলেছিলেন, বাংলা একটি প্রাদেশিক ভাষা হলেও সমগ্র পাকিস্তানের মোট ৬ কোটি ৯০ লাখ লোকের মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লাখ লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে। অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠি বাঙালি এবং তাদের ভাষা বাংলা। কিন্তু ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে পাকিস্তান সরকার যে ভূমিকা পালন করেছে তা মোটেই সমর্থনযোগ্য নয়।
ভাষা-সম্পর্কিত একটি নির্দোষ সংশোধন আলোচনা যে শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রভাষার দাবীতে পর্যবসিত হয়, তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত-লিয়াকত আলী খানের তর্কযুদ্ধে। শহীদ দত্ত দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানান, “So, Sir, I know I am voicing the sentiments of the vast millions of our State and therefore Bengalee should not be treated as a Provincial Language. It should be treated as the language of the State. সময় এবং সঠিক সময়ই প্রকৃত সত্য উদঘাটন করে। শেষ বাক্য It should be treated as the language of the state-ই ঘোষণা দেয় রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। সেই দাবি তুঙ্গে ওঠে ঠিক চার বছর পর; ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ সালে।
প্রয়াত কথা সাহিত্যিক রশীদ হায়দার তার এক প্রবন্ধে লিখেন- আজ আমরা নিঃসংশয়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি, ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে করাচীতে পাকিস্তান গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত যে দুঃসাহসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন তা পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠি তথা সামরিক জান্তা ভোলেনি, ভুলতে পারেনি। তার অকুতোভয় ভূমিকাই যে পাকিস্তানকে দ্বিখন্ডিত করার বীজ বপন করেছিলেন তা পরবর্তীকালে দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে গেছে, প্রমাণিত হয়েছে।
১৯৭১ এর মার্চে তিনি নিজের হাতে কুমিল্লার বাড়িতে তুলেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। এরপরই তার রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল শ্যামল বাংলার মাটি। ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ রাতে ছোট ছেলে দিলীপ কুমার দত্তসহ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তাদেরকে ময়নামতি সেনানিবাসে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। তবে হত্যার সঠিক দিনক্ষণ জানা যায়নি।
১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ রাতে তুলে নিয়ে যাওয়ার ধীরেন্দ্রনাথ কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে কী অমানবিক অত্যাচারের শিকার হয়েছিলেন, তার বর্ণনা পাওয়া যায় ক্যান্টনমেন্টের তখনকার নাপিত রমণীমোহন শীলের সাক্ষাৎকার থেকে। এক সাক্ষাৎকারে “ধীরেন বাবু সম্পর্কে বলতে গিয়ে রমণী শীলের চোখের জল বাঁধন মানেনি। মাফলারে চোখ মুছে তিনি বলেন, ‘আমার সে পাপের ক্ষমা নেই। বাবু স্কুলঘরের বারান্দায় অতি কষ্টে হামাগুড়ি দিয়ে আমাকে জেজ্ঞেস করেছিলেন কোথায় প্রস্রাব করবেন। আমি আঙ্গুল দিয়ে ইশরায় তাকে প্রস্রাবের জায়গা দেখিয়ে দিই। তখন তিনি অতি কষ্টে আস্তে আস্তে হাতে একটি পা ধরে সিঁড়ি দিয়ে উঠানে নামেন। তখন ঐ বারান্দায় বসে আমি এক জল্লাদের দাড়ি কাটছিলাম। আমি বারবার বাবুর দিকে অসহায়ভাবে তাকাচ্ছিলাম বলে জল্লাদ উর্দুতে বলে, ‘এটা একটা দেখার জিনিস নয়-নিজের কাজ কর।’ এরপর বাবুর দিকে আর তাকাবার সাহস পাইনি। মনে মনে শুধু ভেবেছি বাবু জনগণের নেতা ছিলেন, আর আজ তাঁর কপালে এই দুর্ভোগ। তাঁর ক্ষতবিক্ষত সমস্ত দেহে তুলা লাগান, মাথায় ব্যান্ডেজ, চোখ ও হাত বাঁধা অবস্থায় উপর্যুপরি কয়েকদিনই ব্রিগেড অফিসে আনতে নিতে দেখি।”
১৮৮৬ সালের ২ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার রামরাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এই ভাষা সৈনিক। তার বাবা জগবন্ধু দত্ত ছিলেন মুন্সেফ আদালতের সেরেস্তাদার। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন দেশভাগের পর নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলনের প্রথম ভাষা সৈনিক।
শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন ভাষাপ্রেমিক, দেশপ্রেমিক। জনগণের প্রতি তার দায়িত্ব ও কর্তব্য বোধ এবং আত্মত্যাগের কথা বাঙালি আজীবন পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নামে রাজধানীতে স্মরণীয় স্থাপনা নির্মাণের মাধ্যমে শ্রদ্ধা প্রদর্শন এখন সময়ের দাবি।
এএইচ