বাংলা ভাষার মর্যাদা বাড়াতে পারবে তরুণরাই
প্রকাশিত : ১৪:৫৩, ১৮ মার্চ ২০২১ | আপডেট: ১৩:৫৭, ১৯ মার্চ ২০২১
অভিভাবকদের প্রায়ই প্রশ্ন করি, সন্তানকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াচ্ছেন কেন? উত্তর একটাই আমরা কি সন্তানের ক্যারিয়ারের কথা ভাবব না? যুক্তিসঙ্গত কথা, এতে আমি অন্যায়ের কিছু দেখিও না। শিক্ষা ও জীবিকার সঙ্গে যে ভাষা যুক্ত সে ভাষাকেই মানুষ গ্রহণ করবে, এটাই স্বভাবিক।
কিন্তু এতে সমাজে বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে। বিভাজন সবসময়ই খারাপ। প্রথমত, লেখাপড়ার শুরুতেই কিছু শিক্ষার্থী বাংলা মাধ্যমে, কিছু ইংরেজি মাধ্যমে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, বাংলায় যারা পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে তারা একটা হোঁচট খায়। কারণ এদেশে উচ্চশিক্ষার মাধ্যমটা হলো ইংরেজি। ফলে সে ইংরেজি মাধ্যমের সহপাঠীর সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। তাই ভাষাকে সার্বজনীন না করা, ভাষাকে জীবিকা ও শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত না করার পরিণামে সমাজের বৃহত্তর একটি শ্রেণি শিকার হচ্ছে বৈষম্যের। বিশেষত নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা। এটা অন্যায়ও বটে।
এই বৈষম্য-মুক্তির উপায় কী? উপায় আমাদের তরুণ প্রজন্মের হাতে। তরুণরাই পারে মহান ভাষা আন্দোলনের সেই স্লোগানটি বাস্তবায়ন করতে ‘সর্বস্তরে বাংলা চালু করো’। আজকের তরুণদের বলতে চাই তোমরা যদি উঠে দাঁড়াও অর্থাৎ মাতৃভাষার সঠিক চর্চা করো এবং সবার মাঝে আশাবাদের সঞ্চার করতে পারো, তাহলে সমাজের সবাই সচেতন হয়ে উঠবে। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও আমরা আমাদের ভাষাকে নিয়ে যেতে পারব। বিন্দু থেকে সিন্ধুর জন্ম হয় এভাবেই।
উদাহরণ দেই। ইউরোপে মধ্যযুগ ছিল ল্যাটিন ভাষার স্বর্ণযুগ। বিভিন্ন জাতি সে-সময় নিজেদের মাতৃভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করে। মাতৃভাষা চর্চার পথ ধরে ইউরোপে উদ্ভব ঘটে জাতিরাষ্ট্রের। সূচিত হয় রেনেসাঁ, জ্ঞানচর্চা ও শিল্পবিপ্লব। আবার চীনা ও জাপানি ভাষার বর্ণলিপি হলো প্রাগৈতিহাসিক লিপি, খুবই জটিল। সেই ভাষায় যদি ব্যবসাবাণিজ্য, মহাকাশ গবেষণা, আন্তর্জাতিক যোগাযোগ চলতে পারে তাহলে বাংলার মতো উন্নত ভাষাতেও তা অবশ্যই করা যাবে।
ইদানীং অধিকাংশ তরুণকে দেখি, শুধু নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তিত বিদেশি ভাষা শিখবে, বিদেশে যাবে। কিন্তু ব্যক্তিগত উন্নতির পাশাপাশি প্রত্যেকের রয়েছে কিছু সামাজিক দায়বদ্ধতা। একজন কবি শুধু বিনোদনের জন্যে কবিতা লিখতে পারেন না, সমাজের বিকাশেও তার কিছু করণীয় আছে। ভাষার ক্ষেত্রেও তরুণদের এজন্যেই এগিয়ে আসতে হবে। ভাষা আন্দোলনে তা-ই হয়েছে। তরুণদের অন্তরে থাকে সমাজ বদলের তীব্র আকাক্সক্ষা, যা তাদের সবকিছু বিসর্জন দিতে সাহস জোগায়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধেও একটা বিরাট অংশ জুড়ে ছিল তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা। আমি নিজেও ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছি ২৩ বছর বয়সে। আমি তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের শেষ বর্ষের ছাত্র।
৪০-এর দশকের শেষ দিকে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা যখন প্রায় নিশ্চিত, তখন থেকেই মুসলিম লীগের নেতাদের অনেকে বলতে থাকেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এর প্রতিক্রিয়ায় বাঙালি সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীরা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সোচ্চার হন, যা ধীরে ধীরে একটি গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। ৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠিত জনসভায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন বললেন, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হইবে উর্দু, তখনই সৃষ্টি হয় প্রতিবাদের দাবানল। জানা গেল, ২১ ফেব্রুয়ারি শুরু হবে পূর্ববঙ্গ আইনসভার প্রথম বাজেট অধিবেশন। ছাত্র-জনতা সিদ্ধান্ত নিল, সেদিনই বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সারাদেশে হরতাল, সমাবেশ ও মিছিল করবে।
পাকিস্তানি সরকার ভয় পেয়ে ২০ ফেব্রয়ারি ঘোষণা দিল ২১ ফেব্রয়ারি থেকে একমাস পর্যন্ত ঢাকায় সভা-সমাবেশ-মিছিল সবকিছু নিষিদ্ধ। ১৪৪ ধারা জারি থাকবে। ঘোষণা শুনেই বন্ধুদের সাথে দেখা করতে ছুটে গেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শহীদুল্লাহ হলে। গিয়ে দেখি সবাই বলছে, আমরা যে-কোনো মূল্যে ১৪৪ ধারা ভাঙব। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররাও চিৎকার করে উঠল ১৪৪ ধারা মানি না।
সে-বছর বেশ শীত ছিল। ২১ ফেব্রয়ারি ভোরের আলো ফোটার আগেই স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আনাগোনায় সরব হয়ে উঠল ঢাকা মেডিকেল কলেজ ব্যারাক ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। তখনকার আর্টস বিল্ডিং, এখন যেটা ঢাকা মেডিকেলের ইমার্জেন্সি, ওখানকার আমতলায় সভা হলো। ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন বক্তব্য রাখলেন। ১০ জন করে ছোট ছোট মিছিল নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। বিরামহীন স্লোগান উচ্চারিত হচ্ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। মিছিল গেট পর্যন্ত যেতেই পুলিশি আক্রমণ শুরু হয়ে গেল। ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়া হলো, বেশ কিছু ছাত্রকে গ্রেপ্তার করা হলো। নিরস্ত্র ছাত্র ও সাধারণ মানুষের সাথে চলতে থাকল সশস্ত্র পুলিশের সংঘর্ষ।
আমার চোখে দেখা মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজের ছাত্র রফিকের মাথায় গুলি লেগে তিনি তৎক্ষণাৎ মৃত্যুবরণ করলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবুল বরকতের উরুতে গুলি লাগে, অস্ত্রোপচার করেও বাঁচানো গেল না। আবদুল জব্বারের গুলি লাগল তলপেটে, তিনিও শহিদ হলেন।
ছাত্র নিহত হয়েছে, এই খবর পেয়ে সাধারণ মানুষ একে রূপ দিল গণ-আন্দোলনে। নিহতদের স্মরণে সবাই গর্জে উঠলেন নতুন স্লোগানে ‘শহিদ স্মৃতি অমর হোক’। দেশের সমস্ত জেলা, এমনকি গ্রামগুলোতেও শুরু হলো মিছিল, সমাবেশ ইত্যাদি। পরের বছর থেকে শুরু হলো একুশে ফেব্রয়ারি ‘শহিদ দিবস’ পালন, যা পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের ক্ষেত্রে বড় প্রেরণা জুগিয়েছে। এর পথ ধরেই রচিত হয়েছে ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন এবং একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ। অবশেষে জন্ম নিল স্বাধীন ভাষিক রাষ্ট্র বাংলাদেশ। পরবর্তীকালে ১৯৯৯ সালে বাংলা ভাষা পেল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি।
আজকের তরুণদের বলব, মাতৃভাষা বিকাশের এই মন্ত্রটা তোমরা গ্রহণ করো। যা এখনো সম্ভব হয় নি, তোমরা তা সম্ভব করো। আন্তরিকতার সাথে চেষ্টা করো যাতে উচ্চশিক্ষা, বিজ্ঞান শিক্ষা, উচ্চ আদালত এবং জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে বাংলা চালু হয়।
লেখক : কবি, প্রবন্ধকার, গবেষক ও ভাষাসৈনিক।
সূত্র : কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন, মুক্ত আলোচনা, ২ ফেব্রয়ারি ২০১৭
আরও পড়ুন