বাংলা ভাষার মাধ্যমেই আমাদের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করতে হবে
প্রকাশিত : ২৩:১৯, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২
অধিকাংশ উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় তাদের দেশপ্রেম, রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের যে ইতিহাস তাঁর পেছনে বড় ভূমিকা তাদের নিজস্ব ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির নিবিড় চর্চা। ইউরোপ, আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্স, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ পৃথিবীর প্রাচীন ও নবীন উন্নত দেশগুলির উন্নয়নের ইতিহাস একই সূত্রে গাঁথা।
তাদের নাগরিকরা নিজ নিজ দেশের মাতৃভাষাকে সম্মান এবং অধিক মর্যাদার আসনে বসিয়ে নিজেরা জ্ঞানে সমৃদ্ধ হয়ে শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও অর্থনীতিকে ইর্ষানীয় উন্নয়নের চূড়ান্ত শিখরে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। পক্ষান্তরে আমাদের হাজার বছরের (মতান্তরে পাঁচ হাজার বছর) পুরাতন ভাষা আজও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অবহেলিত রয়ে গেছে। আমাদের প্রিয় মাতৃভাষাকে কেড়ে নেয়ার জন্য পাকস্তানী উপনিবেশিক শাসক গোষ্ঠি আমাদের ছাত্র-জনতার বুকে গুলি চালিয়েও ভাষা আন্দোলন দাবিয়ে রাখতে পারেনি, অথচ ১৯৫২ থেকে ২০২২ সাল অর্থাৎ ৭০ বৎসর সময় পেরিয়ে গেলেও আমাদের রক্তস্নাত বাংলা ভাষাকে নিজেরা কতটা মর্যাদা দিয়েছি সে প্রশ্ন কি উপেক্ষা করা যায়?
সম্মানিত পাঠক “ভাষা আন্দোলনের গোড়ার কথা” শীর্ষক প্রবন্ধের ধারাবাহিকতায় ফিরে আসি, তৎকালীন পূর্ববাংলায় ভাষা আন্দোলনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও আবেগিক বিষয় পুনরায় জোরালো হবার পেছনে ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিনের নেতিবাচক ভাষণ আন্দোলনের প্রধান নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন খাজা নাজিমুদ্দিন ২৫ জানুয়ারি ঢাকায় আসেন এবং ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানের জনসভায় তিনি মূলত জিন্নাহ সাহেবের কথারই পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। তিনি এও বলেন, কোনো জাতি এক সাথে দুটি রাষ্ট্রভাষা নিয়ে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারেনা। নাজিমুদ্দিনের বক্তৃতার প্রতিবাদে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২৯ জানুয়ারি ঢাকায় প্রতিবাদ সভা এবং ৩০ জানুয়ারি সর্বাত্মক ছাত্র ধর্মঘট পালন করে। সেদিন ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সমবেত হয়ে ৪ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট ও প্রতিবাদ সভা এবং ২১ ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী সর্বাত্মক হরতাল পালনের ঘোষণা দেয়। পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুয়ায়ী ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এসে একত্রে সমবেত হয়। সমাবেশ থেকে আরবি লিপিতে বাংলা লেখার প্রস্তাবের প্রতিবাদ এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের দাবি জানিয়ে সমাবেশ শেষে ছাত্র-জনতা ঢাকার রাজপথে বিশাল বিক্ষোভ মিছিল বের করে।
সরকার স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে পূর্বেই ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকায় এক মাসের জন্য সকল প্রকার সভা, সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিভিন্ন হলে সভা করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকার নবাবপুর রোডস্থ আওয়ামী মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে একই বিষয়ে পৃথক পৃথক সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত হয়। ২১ শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২, ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রশ্নে পুরাতন কলাভবন প্রাঙ্গণে আমতলায় অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক ছাত্রসভায় পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচী অনুযায়ী সকাল ৯টা থেকে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এসে জড়ো হয়। সমাবেত ছাত্ররা ১৪৪ ধারা জারির বিপক্ষে স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত করে তোলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস এবং পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্যদের ভাষা সম্পর্কে সাধারণ জনগণের মতামতকে বিবেচনা করার আহব্বান জানাতে থাকে। পুলিশ অস্ত্র হাতে সভাস্থলের চারদিক ঘিরে রাখে। বিভিন্ন অনুষদের ডীন, শিক্ষক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সমাবেশে উপস্থিত হয়। বেলা সোয়া এগারোটার দিকে ছাত্ররা গেটে জড়ো হয় এবং আবু নছর মোহাম্মদ গাজীউল হকসহ অন্যান্য ছাত্ররা একযোগে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে পুলিশের প্রতিবন্ধকতা ভেঙে রাস্তায় নেমে পড়লে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে ছাত্রদের ছত্র ভঙ্গ করার চেষ্টা করে।
গাজীউল হকসহ কিছু ছাত্ররা ওই সময় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের দিকে দৌঁড়ে চলে গেলেও অন্যান্যরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে পুলিশ দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে এবং পুলিশের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। উপাচার্য পুলিশকে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ বন্ধ করতে অনুরোধ জানান এবং ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ত্যাগের অনুরোধ করেন। ছাত্ররা ক্যাম্পাস ত্যাগ করার সময় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের অভিযোগে পুলিশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করলে চারদিকে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ কিছু ছাত্রকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় এবং পরে ছেড়ে দেয়া হয়। এ ঘটনায় ছাত্ররা আরও ক্ষুব্ধ হয়ে পুনরায় তাদের বিক্ষোভ শুরু করে। বেলা ২টার দিকে আইন সদস্যরা আইনসভায় যোগ দিতে এলে ছাত্ররা তাদের বাঁধা দেয়। কিন্তু পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে যখন কিছু ছাত্র সিদ্ধান্ত নেয় যে, তারা আইনসভায় গিয়ে তাদের দাবি উত্থাপন করবে। ছাত্ররা ওই উদ্দেশ্যে আইনসভার দিকে রওনা করলে বেলা ৩টার দিকে পুলিশ ছাত্রাবাসে গুলিবর্ষণ শুরু করে। পুলিশের গুলিবর্ষণে আবুল জব্বার এবং রফিক উদ্দিন আহমদে ঘটনাস্থলেই নিহত হন। এছাড়া আবুস সালাম, আবুল বরকতসহ আরও অনেকে সে সময় নিহত হন। ঐদিন অহিউল্লাহ নামের ৯ বছরের একজন কিশোরও নিহত হন। ছাত্র হত্যার সংবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে সর্বস্তরের জনগণ ঘটনাস্থলে ছুটে আসে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সমস্ত অফিস, দোকানপাট ও পরিবহন বন্ধ হয়ে যায়। ছাত্রদের শুরু করা আন্দোলন সাথে সাথে একাট্টা হয়ে জনমানুষের গণআন্দোলনে রূপ নেয়। রেডিও শিল্পীরা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে শিল্পী ধর্মঘট আহব্বান করে এবং রেডিও স্টেশন পূর্বে ধারণকৃত অনুষ্ঠান সম্প্রচার করতে থাকে। ওই সময় গণপরিষদে অধিবেশন শুরুর প্রস্তুতি চলছিল। পুলিশের গুলির খবর জানতে পেরে মাওলানা তর্কবাগিশসহ বিরোধী দলীয় বেশ কয়েকজন অধিবেশন কক্ষ ত্যাগ করে বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের পাশে এসে দাঁড়ান। গণপরিষদের মনোরঞ্জণ ধর, বসন্তকুমার দাস, শামসুদ্দিন আহমেদ এবং ধীরেন্দ্রনাথ দত্তসহ ছয়জন সদস্য মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনকে হাসপাতালে আহত ছাত্রদের দেখতে যাওয়া এবং শোক প্রদর্শনের জন্য অধিবেশন স্থগিত করার অনুরোধ করলে মুখ্যমন্ত্রী তাদের অনুরোধ রাখেনি বরং মুখ্যমন্ত্রী অধিবেশনে বাংলা ভাষার বিরোধিতা করে বক্তব্য দেন।
২২ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে মিছিল ও বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠে। জনগণ ১৪৪ ধারা অমান্য করার পাশাপাশি ছাত্র-জনতা শোক পালন করতে থাকে। বিভিন্ন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কর্মস্থল ত্যাগ করে ছাত্রদের মিছিলে যোগ দেয়। সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শহরের নাগরিক সমাজ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রাবাস পরিদর্শন করেন। পরে তাদের অংশগ্রহণে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে বিশাল ছাত্র-জনতা মিছিলে অংশগ্রহণ করে। বেলা ১১টার দিকে ৩০ হাজার মানুষের মিছিলটি কার্জন হলের দিকে অগ্রসর হলে পুলিশ মিছিলে গুলিবর্ষণ করে। ওই ঘটনায় সরকারি হিসাব মতে ৪ জন নিহত হয়। শহরের বিভিন্ন অংশে একইভাবে জানাজা ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন কলেজ, ব্যাংকসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে লোকজন মিছিলে অংশ নিতে আসে। বিকেলে আরেকটি বিশাল মিছিল পুলিশ দ্বারা আক্রান্ত হয়। বিক্ষুব্ধ জনতা সরকার পক্ষের প্রথম সারির দুটি সংবাদপত্র জুবিলী প্রেস এবং মর্নিং নিউজ অফিসে অগ্নিসংযোগ করে। একই দিনে বিভিন্নস্থানে পুলিশ দ্বারা আক্রমণ ও হত্যার ঘটনা ঘটে। নবাবপুর রোডের বিশাল জানাজার মিছিলে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। এই গুলিবর্ষণে শহীদ হন ঢাকা হাইকোর্টের কর্মচারী শফিউর রহমান, ওয়াহিদুল্লাহ এবং আবদুল আউয়াল। পুলিশ কিছু লাশ কৌশলে সরিয়ে ফেলে। পাকিস্তান সরকার সারা দেশে ভাষা আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রচারপত্র বিলি করে। সংবাদপত্রগুলোকে তাদের ইচ্ছানুসারে সংবাদ পরিবেশনে চাপ সৃষ্টি করতে থাকে।
পাশাপাশি ব্যাপক হারে সাধারণ জনগণ ও ছাত্রদের গ্রেফতার অব্যাহত রাখে। ২৫ ফেব্রুয়ারি আবুল বরকতের ভাই থানায় হত্যা মামলা দায়ের করতে গেলে উপযুক্ত কাগজপত্রের অভাব দেখিয়ে সরকারের নির্দেশে থানা কর্তৃপক্ষ মামলা গ্রহণ করেনি। রফিকউদ্দিন আহমেদের পরিবার একই ধরনের প্রচেষ্টা নিলে, তার মামলাও থানা গ্রহণ করেনি। ১৪ এপ্রিল গণপরিষদের অধিবেশন শুরু হলে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন সামনে চলে আসে। এ সমস্যা নিরসনের পক্ষে অনেক সদস্য মত প্রকাশ করলেও মুসলিম লীগের সদস্যরা এ ব্যাপারে নীরব ভূমিকা পালন করেন।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে শহীদ মিনার তৈরির কাজ শুরু করে। কাজ শেষ হয় ২৪ তরিখ ভোরে। হাতে লেখা কাগজে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ লেখা হয়। শহীদ মিনার নির্মাণের খবর দৈনিক সংবাদপত্রগুলোতে পাঠানো হলে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় শহীদ মিনার নির্মাণের খবর ছাপা হয়। শহীদ শফিউরের পিতা অনানুষ্ঠানিকভাবে শহীদ মিনার উদ্বোধন করার পরে শহীদ মিনার ভেঙে ফেলা হয়। পুনরায় শহীদ মিনার নির্মাণ করলে ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন শহীদ মিনার পুনরায় উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনের দিনই পুলিশ ও সেনাবাহিনী মেডিক্যালের ছাত্রদের আবাসিক হোস্টেল ঘিরে ফেলে এবং শহীদ মিনার ভেঙে ফেলে। এরপর ঢাকা কলেজেও একটি শহীদ মিনার তৈরি করা হয়, এটিও একসময় সরকারের নির্দেশে পুলিশ ভেঙে দেয়। ক্রমবর্ধমান গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৫৪ সালের ৭ মে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গৃহীত হয়।
১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে সংবিধানের ১১৪ অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে লিপিবদ্ধ করা হয়। অবশেষে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেবার পরে ১৯৫৭ সালে সরকারিভাবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের কাজ শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির তত্ত্বাবধানে ১৯৬৩ সালে শহীদ মিনারের কাজ শেষ হলে একই বৎসরে ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ বরকতের মা শহীদ মিনারটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। কেন্দ্রীয় সর্বদলীয় কর্মপরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারি স্মরণে শহীদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয়ভাবে দিবসটি পালনে দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ভাষা আন্দোলনের এক বছর পূর্তিতে সারা দেশব্যাপী যথাযোগ্য মর্যাদায় শহীদ দিবস পালিত হয়। ওই দিন অধিকাংশ অফিস, ব্যাংক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা হাজারো মানুষ প্রভাত ফেরীতে যোগ দেন। হাজার হাজার মানুষ নগ্ন পায়ে শোকের প্রতীক কালো ব্যাজ ধারন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আসে এবং মিছিল করে প্রাঙ্গণ ত্যাগ করে। প্রায় লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতিতে ভাষা শহীদদের স্মরণে ঢাকার আরমানিটোলায় ছাত্র জনতার বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এককভাবে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জনের পর পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে নির্বিচারে বাঙালীদের উপর নির্যাতন ও গণহত্যা শুরু করে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেসকোর্স ময়দানে দেয়া ঐতিহাসিক ভাষণে সমগ্র বাঙালী জাতিকে ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণের আহব্বান জানান। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর নির্যাতনের মাত্রা আরো বেড়ে তীব্রতর হলে বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন, শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে পাকবাহিনীর হাতে এদেশের ৩০ লক্ষ মানুষ নিহত এবং ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় লাভের পর আজকের বাংলাদেশের জন্ম।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে বেরিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে ১৯৭২ সালেই বিশ্বের সেরা লিখিত সংবিধান বাঙালী জাতিকে উপহার দেন। সেই সাথে ১৯৭২ সালের সংবিধানে 'বাংলা একমাত্র রাষ্ট্রভাষা' হিসাবে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। সরকার সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে “বাংলা ভাষা প্রচলন আইন পাশ” করে। এরপর পদ্মা-মেঘনা-যমুনার অনেক পানি গড়িয়ে গেছে, ভাষা শহীদদের রক্তের ঋণ আজও আমরা শোধ করেছি কিনা এটিই প্রশ্ন? ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা কালে জাতিসংঘের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইউনেস্কো ‘বাংলা ভাষা আন্দোলন'-কে মানুষের ভাষা এবং কৃষ্টির অধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ঘোষণা করেছে। যা সমগ্র বিশ্বের মানুষ শ্রদ্ধা ও যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে উদযাপন করছে। ১৯৭১ সালে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়েছি। আজ বাংলাদেশ বিশ্ব সভায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারি শোক দিবস থেকে সারা দুনিয়ার মানুষের শ্রদ্ধার জায়গায় দাঁড়িয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে গ্রহণ করেছে। ভাষা শহীদের রক্ত বৃথা যায়নি, বৃথা যেতে পারে না। মাতৃভাষা বাংলাকে আমরা কতটা মূল্যায়ন করেছি সে প্রসঙ্গ আজ থাক! ভাষা শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও লাখো কোটি সালাম।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলার আপীল বিভাগের সরকারী কৌশুলী।
এসি
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।