ঢাকা, মঙ্গলবার   ০১ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

ডয়চে ভেলের সাক্ষাতকার

‘বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, ধর্মীয় বিধানে বাধ্য করার সুযোগ নেই’

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২০:১৬, ২৯ মার্চ ২০২৫ | আপডেট: ২০:১৮, ২৯ মার্চ ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

বাংলাদেশে ঈদুল ফিতরের প্রস্তুতি, জাকাত বিতরণের সঠিক নিয়ম ও তার কার্যকর প্রয়োগ নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন। জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলে-এর সঙ্গে তাঁর এই গুরুত্বপূর্ণ আলাপচারিতা তুলে ধরা হলো একুশে টেলিভিশনের পাঠকের জন্য। 

ডয়চে ভেলে: এবার ঈদের প্রস্তুতি কেমন?

ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন: আমাদের প্রস্তুতি অত্যন্ত ভালো। এটা একটা সম্মিলিত প্রয়াস। ঈদ-উল-ফিতর উপলক্ষে আমরা ইতোমধ্যে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভা করেছি। যাতে মানুষ ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য ও উৎসবমুখর পরিবেশে এবং নির্বিঘ্নে ঈদ উদযাপন করতে পারে সেজন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এবারও হাইকোর্টের সামনে ঈদগাহে ঈদের প্রধান জামাত অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে প্রধান উপদেষ্টা, উপদেষ্টাবৃন্দ, প্রধান বিচারপতি, তিন বাহিনী প্রধানসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঈদের নামাজ আদায় করবেন।

ডয়চে ভেলে: বাংলাদেশে জাকাতের অর্থ কেমন আসে?

ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন: বাংলাদেশ চতুর্থ মুসলিম বৃহত্তম দেশ। এখানে জাকাত আদায়ের সম্ভাবনার বিষয়ে বেসরকারি কিছু সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিপুল পরিমাণ জাকাত আদায়ের সুযোগ এখানে আছে। কিন্তু বাস্তবতা অন্যরকম। জাকাত আদায় কিন্তু ফরজ বা আবশ্যিক একটা ইবাদত ইসলাম ধর্মমতে। এখানে জাকাতের বিষয়ে মুসলমানদের খুব বেশি প্রভাবিত করে না। যারা জাকাত আদায় করেন, তাদের অধিকাংশই ব্যক্তিগতভাবে আদায় করে থাকেন। সরকারিভাবে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীনে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে একটা জাকাত বোর্ড আছে, সেখানে অর্থ জমা দেওয়ার জন্য আমরা উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। গতবছর এই তহবিলে ১১ কোটি ১২ লাখ ৩১ হাজার ১ টাকা জমা পড়েছিল। আগামী বছরের জন্য আমরা ২৫ কোটি টাকা আহরণের টার্গেট করেছি এবং ওই টাকা অভাবগ্রস্থ লোকের মধ্যে বিতরণ করবো।

ডয়চে ভেলে: বাংলাদেশে জাকাত ব্যবস্থা কি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে?

ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন: আপনি জানেন, বাংলাদেশ সাংবিধানিকভাবে একটা ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। এখানে ইসলামি শরিয়তের বিধান মানতে রাষ্ট্রীয় কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, যদিও আমাদের একটা জাকাত বোর্ড আছে, কিন্তু এর নিজস্ব কোনো জনবল নেই। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের জনবল দিয়েই আমরা এটা পরিচালনা করি। যে কারণে জাকাত বোর্ডকে খুব বেশি গতিশীল করা সম্ভব হয়নি। এ দেশের মানুষ জাকাত দেয় ভলান্টিয়ারি, এদের বাধ্যতামূলক করার কোনো বিধান নেই।

ডয়চে ভেলে: আমাদের দেশে কোন কোন খাতে জাকাতের অর্থ দেওয়া হয়ে থাকে?

ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন: সরকারিভাবে জাকাতের অর্থ মূলত চিকিৎসা, শিক্ষাবৃত্তি, দুঃস্থ, অসহায়, অনাথ, ক্ষুদ্র ব্যবসা, সেলাই মেশিন, রিক্সা-ভ্যান ক্রয় এবং পুনর্বাসনের সহায়তা করা হয়।

ডয়চে ভেলে: সবাই কি ঠিকভাবে জাকাত দেন? এটা নিশ্চিত করার কোনো ব্যবস্থা আছে?

ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন: সাধারণত আমাদের কাছে যখন কোনো ব্যক্তি জাকাত দেন, তখন তিনি নিজেই তার জাকাতের পরিমাণ নির্ধারণ করে থাকেন। আমাদের জাকাত বোর্ডে যারা জাকাতের অর্থ জমা দেন, তাদের টাকাটা আমরা শরিয়তের বিধান অনুসারে বিতরণ করে থাকি।

ডয়চে ভেলে: এই অর্থ কি সঠিকভাবে খরচ হয়? অনেকে এই অর্থ খরচে দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন...

ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন: সরকারি জাকাত বোর্ডের তহবিলে প্রাপ্ত অর্থ সম্পূর্ণরূপে শরিয়তের বিধান অনুসারে বিতরণ করা হয়ে থাকে। এখানে অনিয়মের কোনো সুযোগ নেই। আমরা যে অর্থ জাকাত হিসেবে পাই, তার ৮০ ভাগ অর্থ আমরা জেলা প্রশাসক ও ইউএনওর মাধ্যমে বিতরণ করি। কেন্দ্রে আমরা কিছু অর্থ রাখি। সেটাও মন্ত্রণালয়ের সচিব ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক শরিয়তের বিধান অনুসারে বিতরণ করে থাকেন। দুর্নীতির এখানে কোনো সুযোগ নেই। এটা অত্যন্ত স্বচ্ছ ও প্রত্যেকটা হিসাব আমাদের কাছে সংরক্ষিত আছে। আমরা ক্রস চেকের মাধ্যমে জাকাতের অর্থ বিতরণ করে থাকি।

ডয়চে ভেলে: জাকাতের অর্থের সঠিক ব্যবহার হলে দারিদ্র্য কমে যেত বলে অনেকেই বলেন। বিষয়টি কি এমন?

ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন: ইসলামিক শরিয়তে জাকাত হলো প্রধান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থার প্রচলনই হয়েছে দ্ররিদ্রতা দূরীকরণের জন্য। সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে, আমরা যদি শরিয়তের বিধান অনুযায়ী জাকাতের অর্থ আদায় ও বিতরণ করতে পারি, তাহলে ১০ বছরের মধ্যে দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব। একটা জরিপে বলা হচ্ছে, যদি সঠিকভাবে জাকাতের অর্থ আদায় করা হয়, তাহলে সেটা হবে এক লাখ কোটি টাকা। সেই টাকা যদি ধর্মীয় স্কলার এবং সরকারি ব্যবস্থাপনায় বিতরণ করা হয়, তাহলে ১০ বছরের মধ্যে দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব।

ডয়চে ভেলে: সঠিকভাবে জাকাতের অর্থ আদায়ে মন্ত্রণালয় থেকে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কি?

ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন: এটা সেকুলার স্টেট হওয়ার কারণে ধর্মীয় কোনো বিধান বাধ্যতামূলক করার সুযোগ নেই। এজন্য আমরা এটা করতে পারি না। বিষয়টি আমরা মোটিভেশনাল পর্যায়ে রেখেছি। সবাইকে বুঝাচ্ছি, এখানে গরিবের হক আছে। জাকাত। দেওয়া আপনার জন্য ফরজ। কিন্তু বাধ্যতামূলক তো আমরা করতে পারি না।

ডয়চে ভেলে: কেউ সঠিকভাবে জাকাত না দিলে ইসলামে কী বিধান আছে?

ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন: যেহেতু এটা সেকুলার স্টেট, ফলে রাষ্ট্রীয় কোনো আইন নেই। এটা ব্যক্তির আমল হিসেবে চিহ্নিত করা আছে। জাকাত ফরজ, অর্থাৎ, বাধ্যতামূলক হওয়ার পরও যারা জাকাত দেবে না তাদের জন্য কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা আছে। আল্লাহ তাদের শাস্তি দেবেন পরকালে।

ডয়চে ভেলে: আপনার মন্ত্রণালয় থেকে ঈদ উপলক্ষে কী ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে?

ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন: ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে ঈদের জামাতের আয়োজনসহ কেন্দ্রীয় যে ঈদ জামাত হবে, সেখানে দেড় লাখ মানুষের আয়োজন করা হয়েছে। এই ব্যবস্থাপনার জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আমরা আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকও করেছি। সরকারের নিরাপত্তা বিভাগ নিরাপত্তার বিষয়টি দেখছে। নির্মাণের দিকটা দেখছে সিটি কর্পোরেশন। আমি, আমার সচিবসহ মন্ত্রণালয়ের স্টাফরা সকাল ৮টা ৩০ মিনিটে নামাজ আদায় করব। সেখানে অতিথিদের রিসিভ করার দায়িত্বে আমার মন্ত্রণালয়। ঈদ উপলক্ষে বেতার ও টেলিভিশনে নানা ধরনের অনুষ্ঠান প্রচার হবে। বিশেষ সংখ্যা প্রচার করা হবে। সরকারি হাসপাতাল, কারাগার, শিশু সদন, অনাথ আশ্রমে উন্নত মানের খাবার পরিবেশন করা হবে। এছাড়া ঈদের পরদিন রাষ্ট্রীয় নীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ অনুষ্ঠান করা হবে। এভাবে দেশের ভেতরে ও দেশের বাইরে নানা কর্মসূচি আমরা নিয়েছি। ঈদের দিন বঙ্গভবনে সকাল ১০টায় সংবর্ধনা আছে। রাষ্ট্রপতি অতিথিদের আমন্ত্রণ করবেন। বিকেল ৪টায় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে একটা সংবর্ধনা আছে। এ বছর আমরা ব্যতিক্রমভাবে প্রধান উপদেষ্টার ওখানে মুসলিম ছাড়াও হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের লোকজনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি, যাতে আমাদের যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলি, সেটার বাস্তব উদাহরণ মেলে।

ডয়চে ভেলে: সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিষয়টি ভাবনায় রেখে আপনার মন্ত্রণালয় থেকে কী ধরনের উদ্যোগ নিয়েছেন?

ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন: আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে আমার মন্ত্রণালয় থেকে বহুমাত্রিক কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। দুর্গাপূজার সময় আগের সরকার ২ কোটি বা ৩ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। কিন্তু আমাদের প্রধান উপদেষ্টা ৪ কোটি টাকা দিয়েছেন। আমাদের মন্ত্রণালয়ে কিন্তু হিন্দু কল্যাণ ট্রাস্ট আছে। আমি পদাধিকার বলে সেটির চেয়ারম্যান। আমি ট্রাস্টের নেতৃবৃন্দের সহায়তায় সেই টাকা বিতরণ করেছি। তিন দিন আগেও আইন-শৃঙ্খলা কমিটির বৈঠকে আমি বলেছি, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের কারো ওপর যেন কোনো ধরনের অত্যাচার না হয়, সে ব্যাপারে আমাদের সচেতন থাকতে হবে। কোথাও কোনো ঘটনা ঘটলে যেন আমাদের ভিডিও ফুটেজ পাঠানো হয়। আমরা যদি প্রমাণ পাই কেউ এটা করেছেন, তাহলে তার শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। আমি নিজে উদ্যেগ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা কার্যালয়ে তাদের নিয়ে বসেছি। কারণ, দেশের উন্নয়নে সবার অবদান আছে। প্রত্যেকটি মানুষের ধর্ম চর্চার ক্ষেত্রে সাংবিধানিক অধিকার আছে। আমার এটা সব ধর্মের মন্ত্রণালয়। সবার জন্য আমার মন্ত্রণালয়ের দরজা সব সময় খোলা থাকবে।
এসএস//


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি