বাংলাদেশে বোম্বে ব্লাডগ্রুপ: আতঙ্কিত নয় সচেতন হোন
প্রকাশিত : ২১:০৮, ৩১ মে ২০২২
রক্তের গ্রুপ জানা থাকা বা জেনে রাখা সবারই উচিৎ, নিজের জন্য বা অপরের জন্যও। কেননা কার কখন রক্ত লাগে বা কাকে কখন রক্ত দিতে হতে পারে তার জীবন বাঁচাতে, তা আমরা এন্টিসিপেটরী কেউই জানিনা।
যথাযথ ল্যাব থেকে সঠিক গ্রুপ জানা, সঠিক রোগীকে সঠিক গ্রুপের সঠিক রক্ত/উপাদান সঠিক সময়ে ট্রান্সফিশন দেয়াই নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালনের মূলকথা। এটি শুধু এখন আর প্রফেশনাল এবং ইথিক্যাল অবলিগেশনই নয়, এটি এখন লিগাল অবলিগেশনও।
প্রায় ২৯টি ব্লাডগ্রুপ সিস্টেম আজ পর্যন্ত আইএসবিটি কর্তৃক স্বীকৃত হলেও ক্লিনিক্যাল ট্রান্সফিশন প্র্যাকটিসে চিকিৎসকগণ মাত্র দুটি সিস্টেম- এবিও এবং রেসাস সিস্টেম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাই রক্ত দাতা-গ্রহিতার গ্রুপের এক ও অভিন্নতা নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালনে প্রয়োজন।
১৯০১ সালে কার্ল ল্যান্ড স্টেইনার প্রথম আবিস্কার করেন এবিও ব্লাডগ্রুপ সিস্টেম (ABO Blood Group System) এবং এর ৩৮ বছর পরে আবিস্কৃত হয় রেসাস ব্লাডগ্রুপ সিস্টেম (Rhesus Blood Group System)।
এবিও ব্লাডগ্রুপ সিস্টেমকে ক্লাসিক্যাল এবং ইউনিভার্সাল ব্লাড গ্রুপ বলা হয়, কেননা জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষের মধ্যেই এটি থাকে। বাংলাদেশের প্রতি ১০০ জন মানুষের ২২.৪৪ জন এ গ্রুপের, ৩৫.২০ জন বি গ্রুপের, ৮.৩৯ জন এবি গ্রুপের এবং ৩৩.৯৭ জন ও গ্রুপের এবং ৯৭.৪৬ জন রেসাস পজিটিভ এবং ২.৫৪ রেসাস নেগেটিভ।
রক্তের লোহিত কণিকায় এন্টিজেন এবং সেরামে এন্টিবডির উপস্থিতি-অনুপস্থিতির ভিত্তিতে যেমন এই ব্লাড গ্রুপ বিভাজন, তেমনি এন্টিজেন-এন্টিবডির গুনগত অথবা পরিমানগত বৈসাদৃশ্যতাও এক একটি গ্রুপের সাব-গ্রুপের জন্য নিয়ামক ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে।
আগেই বলেছি, শতকরা ৩৩.৯৭ ভাগ জনগোষ্ঠি বাংলাদেশে ও গ্রুপের। এই ও গ্রুপেরই ভিন্ন একটি রূপ হল- বোম্বে ব্লাড গ্রুপ। অর্থাৎ Oh Phenotype। ১৯৫২ সালে ভারতের বোম্বাই শহরের (এখন যাকে মুম্বাই নামে নামান্তরিত করা হয়েছে) অধ্যাপক ভাটিয়া এবং তার সহকর্মী অধ্যাপক ভেন্ডি এই ফেনোটাইপটির সন্ধান পান। তাদের আবিস্কারের স্বীকৃতি হিসেবে আইএসবিটি ব্লাড গ্রপটিকে বোম্বে ব্লাড গ্রুপ হিসেবে নামকরণ করেছে।
বাংলাদেশের এমিরিটাস অধ্যাপক প্রয়াত মুজিবর রহমান ১৯৯০ এবং ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশে দুটি পরিবারের ৫ জন মেয়ের মধ্যে বোম্বে ব্লাড গ্রুপ নির্ণয় করেছিলেন তদানিন্তন আইপিজিএমআরে। ২০০৭ থেকে মে/২০১৬ পর্যন্ত কমপক্ষে ১৭ জনের মধ্যে বোম্বে ব্লাড গ্রুপ নির্ণয়/শনাক্ত করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগের ল্যাবে। এদের মধ্যে ১৩ জন পুরুষ এবং ৪ জন নারী।
বর্তমানে রক্তের বিরূপ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সচেতনতা যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে সঠিক গ্রুপ নির্ণয়ের সুযোগ। ফলে বেড়েছে বোম্বে ব্লাড গ্রুপ নির্ণয়/অনুসন্ধান। যারা ও গ্রুপ বলে চিহ্নিত, তাদের মাঝে অনুসন্ধান করলে বোম্বে ব্লাড গ্রুপ এর সংখ্যা আরও বাড়বে এবং ভূল করে সাধারণ ও গ্রুপকে বোম্বে বা বোম্বেকে সাধারণ ও গ্রুপ দিয়ে ট্রান্সফিউশন জটিলতার সংখ্যাও কমে আসবে।
বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগে বোম্বে ব্লাড গ্রুপ নির্ণিত/শনাক্তকৃত বেশীরভাগ রোগী এসেছে ট্রান্সফিউশন জটিলতা নিয়ে। সেম ব্লাড গ্রুপের ট্রান্সফিউশন নিয়ে জটিলতা যেমন কিডনী বৈকল্য বা ফেইলিউর নিয়ে। কাউকে আবার ব্লাড গ্রুপ কনফারমেশন করতে ঢাকা বা ঢাকার বাইরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, যেমন- স্কয়ার হাসপাতাল, এপোলো হাসপাতাল, এনআইসিভিডি, ইবরাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল, হলি ফ্যামিলী-রেড ক্রিসেন্ট, খাজা ইউনুস মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা রেনাল সেন্টার ও জেনারেল হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেমাটলজী এবং হেমাট-অংকোলজী বিভাগ থেকে।
এই সব রোগীদের পরিবারে অনুসন্ধান করে বোম্বে ব্লাড গ্রুপ পেয়েছি এবং ট্রান্সফিউশন দিয়ে জটিলতা এড়ানো হয়েছে। যারা ইতোমধ্যে বোম্বে ব্লাড গ্রুপ বলে নির্ণীত হয়েছেন তাদের পরিবারেই বোম্বে ব্লাড গ্রুপ অনুসন্ধান করতে হবে, Oh Phenotype দেখতে হবে। রেয়ার এই ফেনোটাইপের সকলে একটা ডোনার ক্লাব গঠন করলে ভাল হয়, যাতে করে বোম্বে ব্লাড গ্রুপের কারো ইমারজেন্সী অপারেশন বা অন্য কোন ইনডিকেশানে রক্ত প্রয়োজন হলে বোম্বে ব্লাড গ্রুপের ডোনার ক্লাবই রক্ত দিতে পারে। কেননা বোম্বে ব্লাড গ্রুপ, বোম্বে ছাড়া কারো রক্ত নিতেও পারেনা। বোম্বে ব্লাড গ্রুপের ছাড়া কাউকে রক্ত দিতেও পারেনা কখনও।
বাবা-মা যদি হিটারোজাইগাস Oh জীনের ধারক-বাহক হন, তাহলে তাদের ২৫% সন্তান-সন্ততি বোম্বে ব্লাড গ্রুপের হতে পারে। নীচের মেডিকেল জার্নালগুলোতে বোম্বে ব্লাড গ্রুপ নিয় করা গবেষণা ও কাজ প্রকাশিত হয়েছেঃ
১। KYAMC Journal (Vol-1 Number-2, January-2011)
২। BSMMU Heart Journal (Vol-6 Number-2 ,July-2010)
৩। BCPS Journal ( Vol-29 Number-4,October-2011)
লেখক- সমন্বয়কারী, কোয়ান্টাম হার্ট ক্লাব
এনএস//