বাইপাস সার্জারি এড়াতে মেনে চলুন এসব
প্রকাশিত : ১৪:৪৫, ২৩ জুলাই ২০১৯ | আপডেট: ১৪:৪৮, ২৩ জুলাই ২০১৯
হার্ট শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। গুরুত্বপূর্ণ এই হার্টে বিভিন্ন সমস্যা হয়। আসলে জীবনযাত্রা যত আধুনিক হচ্ছে হার্টের অসুখে আক্রান্তের হার তত বাড়ছে। যাই হোক, শুধু যে কাটাছেঁড়ার ভয়েই মানুষ বাইপাসকে বাইপাস করতে চান তা কিন্তু নয়৷ টাকাপয়সাও একটা বড় ব্যাপার৷ তাই তারা কী করবেন? কেউ ওষুধে ব্লক গলাতে ছুটবেন, তো কেউ চাইবেন ন্যাচারাল বাইপাস৷ কেউ লেজার সার্জারি করাবেন তো কেউ চাইবেন যন্ত্র দিয়ে পথ খুলতে৷ আর এ সব করে অনেকে ভালও থাকেন৷ অধিকাংশ পদ্ধতির বৈজ্ঞানিক মান্যতাও আছে৷
কিন্তু পদ্ধতিগুলো কী সত্যিই নিরাপদ? কেবলই কষ্ট কমায়, নাকি রোগ কমাতেও ওস্তাদ? বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?
ন্যাচারাল বাইপাস
মনে করুন রাস্তায় যানজট৷ কিন্তু তাতে কি গন্তব্যে পৌঁছানো আটকায়? অলি–গলি খুঁজে আমরা ঠিক পৌঁছে যাই৷ প্রকৃতিও তাই করে৷ ইসকিমিক হৃদরোগের ফলে হার্টের প্রধান ধমনীগুলো যখন বন্ধ হতে শুরু করে তার আশপাশে সরু সরু যে ধমনী আছে (কোল্যাটারালস), যারা এমনিতে তেমন কোনও কাজ করে না, তাদের জাগিয়ে তুলতে শুরু করে সে৷ চওড়া ও রক্তের ঘাত বহন করার ক্ষেত্রে সক্ষম হতে শুরু করে তারা। যাতে রক্ত চলাচলে সুবিধা হয়৷ ফলে রক্তের অভাবে হার্টের যে পেশী ক্লান্ত হয়ে পড়ছিল, সামান্য কাজেই বুকে ব্যথা হচ্ছিল, তার পুনরুজ্জীবন শুরু হয়৷ হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, কোল্যাটারালরা একযোগে নেমে পড়লে ইসকিমিয়া জনিত বুকে ব্যথার প্রকোপ কমে, হার্ট অ্যাটাকের মাত্রা কম থাকে ও ক্ষতি কম হয়৷ চিকিৎসার জন্য বেশ খানিকটা অতিরিক্ত সময় হাতে পাওয়া যায়৷
২০০৮ সালে ‘হার্ভার্ড হার্ট লেটার’-এ প্রকাশিত প্রবন্ধে বিজ্ঞানীরা জানালেন সপ্তাহে ৫–৭ দিন কম করে ২০–৩০ মিনিট ঘাম ঝড়ানো ব্যায়াম করলে, এমন ব্যায়াম যাতে হার্টকে তার সক্ষমতার সীমা অতিক্রম করতে হয়, তবে গিয়ে এ কাজ সম্ভব৷ তার জন্য এমন গতিতে হাঁটতে হয় যাতে ঠাণ্ডার মধ্যেও অল্প ঘাম হয় ও হাঁপিয়ে হলেও দু’–চারটা কথা বলা যায়৷ এই গতিবেগ ধরে রাখতে হয় কম করে ২০–৩০ মিনিট৷ তার পর আস্তে আস্তে কমাতে হয় গতি৷ যারা সাঁতার কাটেন, সাইকেল চালান, ঘাম ঝড়ানো খেলাধুলা করেন বা নাচেন, তারাও যদি ২০–৩০ মিনিট এভাবে হার্টরেট ধরে রাখতে পারেন, কাজ হয়৷
হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, হার্ট ভাল রাখতে নিয়ন্ত্রিত ব্যায়াম করা দরকার৷ কিন্তু শুধু ব্যায়ামেই সব হবে এমন নয়৷ মানুষের হার্টের গঠন ও কার্যপদ্ধতি এতই জটিল যে তার আচরণের ব্যখ্যা সব সময় পাওয়া যায় না৷ একজনের রোগ হয়ত ওষুধ, নিয়ম ও ব্যায়ামে বশে থাকে, সেই একই রোগে আর একজনের অপারশেন লাগে৷ আর কোল্যাটারালরা হাত–পায়ের রক্ত সংবাহনের ক্ষেত্রে যে রকম সক্রিয় ভূমিকা নেয়, হার্টে সব সময় তা হয় না৷ কাজেই খুব বুঝেশুনে পা ফেলা উচিত৷
ব্যায়ামের বিকল্প, ইইসিপি
ইইসিপি হল এমন এক কাটাছেঁড়াবিহীন ও ওষুধবিহীন পদ্ধতি যা মোটামুটি ৩৫টি সিটিংয়ের মধ্যে বুকব্যথা ও হার্ট ফেলিওরে আক্রান্ত রোগীর সমস্যার সুরাহা করে৷ রক্তচাপ মাপার সময় যেমন পট্টি দিয়ে হাতের উপরের অংশ কষে বাঁধা হয়, এখানে তেমন পট্টি বাঁধা হয় পায়ের ডিমের কাছে, হাঁটুর উপরের অংশে ও থাইয়ে৷ হৃদস্পন্দন চলাকালীন হার্ট যখন রিল্যাক্সড হয় পট্টিগুলো একে একে দ্রুত ফুলে ওঠে৷ এই চাপ উপর দিকে গিয়ে কোল্যাটারাল ধমনীগুলোর মুখে রক্তচাপ বাড়ায়৷ সেই চাপে ধমনীগুলোর মধ্যে একটু একটু করে রক্ত যেতে শুরু করে৷ ফলে মূল ধমনী বন্ধ থাকা সত্ত্বেও হার্টের পেশীতে শুরু হয় রক্ত সঞ্চালন৷ ক্রনিক স্টেবল অ্যানজাইনা থাকলে এই পদ্ধতিতে ভাল কাজ হয়৷ মোটামুটি বছর পাঁচেক তারা ভাল থাকতে পারেন৷
হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একে বাইপাস বা অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টির বিকল্প বলা যায় না৷ শারীরিক কারণে অপারেশন না করা গেলে সাময়িকভাবে কষ্ট কমানোর জন্য ইইসিপি করা যেতে পারে৷
লেজার সার্জারি, সার্জিকাল কোল্যাটারালাইসেশন
আশির দশকের শেষ থেকে নব্বইয়ের গোড়ার দিক পর্যন্ত টিএমআর বা ট্রান্স মায়োকার্ডিয়াল লেজার রিভ্যাসকুলারাইজেশনে রমরমা বাজার ছিল৷ শারীরিক কারণে যারা বাইপাস বা স্টেন্টিং করতে পারতেন না, তাদের হার্টের পেশীতে হলমিয়াম লেজার দিয়ে ছোট ছোট ফুটো করে দেওয়া হত, যাতে স্পঞ্জের মতো কিছু রক্ত শুষে নিয়ে সে তার কাজ চালাতে পারে৷ প্রথম দিকে বেশ ভালই কাজ হচ্ছিল৷ উপসর্গ কম থাকছিল৷ ব্যথার প্রকোপ থেকে মুক্তি পাচ্ছিলেন রোগীরা৷ কিন্তু কিছু দিন চলার পরই দেখা গেল, এতে স্রেফ কষ্টই কমছে, রোগের উন্নতি হচ্ছে না বিশেষ৷ এমনকি পদ্ধতিটি করার জন্য মানুষ বেশিদিন বেঁচেছেন, এমন নজিরও পাওয়া যায়নি৷
বায়োকেমিক্যাল অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি
এর আর এক নাম চিলেশন থেরাপি৷ ইডিটিএ নামে এক রাসায়নিকের সঙ্গে ধমনিতে জমা চর্বির ডেলার চিলেশন তথা রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটিয়ে তাকে গলিয়ে প্রথমে রক্তে, তার পর প্রস্রাবের মাধ্যমে বার করে আনাই হল প্রধান উদ্দেশ্য৷ ধমনীতে ওষুধটি প্রবেশ করিয়ে দেওয়ার পর শুধু সময়ের অপেক্ষা৷
কিন্তু সত্যিই কি তাই? তাহলে ‘আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন’ ও ‘আমেরিকান কলেজ অব কার্ডিওলজি’ তাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না কেন? কেন ‘এফডিএ’ তাকে ছাড়পত্র দিচ্ছে না৷
এতে রক্তের ক্যালসিয়াম লেভেল বিপদসীমার নীচে নেমে যায়, ফলে কিডনি নষ্ট হয়ে যায় আর মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে। হার্টের চিকিৎসায় একে বহার করতে গেলে এ রকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
অর্থাৎ বাইপাসকে বাইপাস করতে গেলে রোগ হওয়ার অপেক্ষায় বসে থাকলে হবে না৷ সাবধান হতে হবে আগে থেকে৷ যে যে কারণে ইসকিমিক হার্ট ডিজিজ হতে পারে, তাদের সামলে চলার চেষ্টা করতে হবে৷ বশে রাখতে হবে ওজন, রক্তচাপ, সুগার, কোলেস্টেরল ও ধুমপান৷ ত্যাগ করতে হবে অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট ও তেল–ঘি খাওয়ার অভ্যাস৷ রিফাইন্ড তেল হলে তো বিশেষ করে৷ এর সঙ্গে নিয়মিত কিছু ব্যায়াম করতে হবে৷ কার্ডিও, স্ট্রেন্থ ট্রেনিং ও যোগা মিলে দিনে ৪৫ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা৷ সপ্তাহে অন্তত ৫ দিন৷ চলতে হবে ডাক্তারের পরামর্শ মতো৷
সূত্র: আনন্দবাজার