ঢাকা, শুক্রবার   ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪

বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর অনন্য জীবন

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৮:৩৯, ২৩ আগস্ট ২০২৩ | আপডেট: ১৪:১৯, ২৪ আগস্ট ২০২৩

ভারতবর্ষের পবিত্র ভূমিতে জন্ম হয়েছে বহু জ্ঞানী ও মনীষীদের। এদের মধ্যে হলেন একজন লোকনাথ ব্রহ্মচারী তিনি ছিলেন একজন হিন্দু ধর্ম গুরু। তিনি বাবা লোকনাথ নাম সর্বাধিক পরিচিত। বর্তমান পশ্চিম বাংলার অন্তর্গত চব্বিশ পরগনা জেলার চৌরাশি চাকলা মৌজায় এক ধার্মিক ঘোষাল পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। বাংলা ১১৩৭ বঙ্গাব্দে ও ইংরেজি ১৭৩০ খ্রিস্টাব্দে আগস্ট মাসে শুভ জন্মাষ্ঠমী তিথিতে তার জন্ম। তার পিতার নাম- রামনারায়ণ ঘোষাল এবং মাতা- কমলাদেবী। লোকনাথ ছিলেন পিতা মাতার চতুর্থ পুত্র সন্তান।

পিত রামনারায়ণ ছিলেন একজন ধর্মভীরু ও গুপ্ত সাধক। তিনি সব সময় তার ধ্যান জপ নিয়ে দিন কাটাতেন। রামনারায়ণ ঘোষালের একটি বাসনা ছিল যে একজন পুত্র সন্তানকে সন্যাসী বানাবেন। কিন্তু মাতা শ্রীমতি কমলাদেবী কোন মতে তার পুত্রদের সন্যাসী হতে দিতেন না। রামনারায়ণ বিশেষ কিছু না বলে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে লাগলেন। এরপর জন্ম হল চতুর্থ সন্তানের। রামনারায়ণ তার চতুর্থ পুত্র সন্তানের মুখ দর্শন করতে এসে পুত্রকে দেখে অবাক হন। বুঝতে পারেন এতদিনে ভগবান তার প্রতি প্রসন্ন হয়েছেন। কমলাদেবী নিজে থেকেই এই চতুর্থ পুত্রকে সান্যাসী বানানোর সম্মতি দেন।

চৌরাশি চাকলা গ্রামের কাছেই কাঁকড়া গ্রাম। সবাই গ্রামখানিকে কচুয়া গ্রাম বলতেন। এই গ্রামে বাস করতেন ভগবান গাঙ্গুলি তিনি ছিলেন পরম নিষ্ঠাবান এবং সর্বশাস্ত্র সুপন্ডিত ছিলেন।

রামনারায়ণ ভগবান গাঙ্গুলির অসাধারন শাস্ত্রজ্ঞান এবং গুপ্ত সাধনার কথা জানতেন। রামনারায়ণ চিন্তা ভাবনা করে দেখলেন তার পুত্র লোকনাথকে যদি ভগবান গাঙ্গুলির হাতে দেওয়া যায় তাহলে তার মনের বাসনা পূরণ হবে। এই চিন্তা করে রামনারায়ণ একদিন ভগবান গাঙ্গুলির বাড়িতে গেলেন। রামনারায়ণ লোকনাথের জন্মবৃত্তান্ত বললেন গাঙ্গুলি মহাশয়কে, শুধু তাই নয়, গাঙ্গুলি মহাশয়কে লোকনাথকে আচার্যরূপে উপনয়ন সংস্কার করিয়ে অধ্যাত্ম জীবনের গুরুভার গ্রহণ করার জন্য বিনীত অনুরোধ জানালেন।

লোকনাথ আচার্য গাঙ্গুলির শিষ্যত্ব লাভ করেন একই সঙ্গে তার প্রিয় বন্ধু বেণীমাধব চক্রবর্তী ও আচার্য গাঙ্গুলির শিষ্যত্ব লাভ করেন। লোকনাথ ও তার বন্ধু বেণীমাধবের তখন বয়স ছিল মাত্র এগারো বছর।

একান্ন পিঠের মধ্যে অন্যতম মহাপীঠ হল কালীঘাট। শক্তি সাধনার অন্যতম মহাপীঠ হল – কালীঘাট। তন্ত্রসাধকগন এই কালী ঘটে বসে তন্ত্রসাধনা করতেন। বর্তমানে আমরা কালীঘাটের যে রূপ দেখতে পাই সেই সময় এমনটি ছিলনা। কালী মন্দিরের চারিদিক ঘিরে ছিল বড় বড় গাছ গাছালিতে পরিপূর্ণ। তখন লোকজনের বেশি যাতায়াত ছিল না।

গভীর জঙ্গল পরিবেশের মন্দিরে ছিলেন দেবীর অধিষ্ঠিত। গৃহত্যাগ করে ভগবান গাঙ্গুলি, লোকনাথ ও বেণীমাধব প্রথম এসেছিলেন এই শক্তি পিঠে। কারন- ভগবান গাঙ্গুলি জানতেন ক্লিচ্ছসাধক,ত্যাগ ও তিতীক্ষাময় জীবনের পথে অগ্রসর হতে হলে আগেই মহামায়ার চরণে আশ্রয় গ্রহণ করতে হবে, লাভ করতে হয় মায়ের পরম কৃপা।

গভীর জঙ্গল পরিবেশে এসে বালক দুটি ভয় হওয়া দূরের কথা, তারা সেখানে গিয়ে বেশ খুশি হয়ে উঠলেন। প্রথম সাধু ও সন্যাসীর বড় বড় জেতামণ্ডিত মস্তক, ভস্মমাখা দেহ দেখে অবাক হয়ে দূর থেকে চেয়ে থাকতেন। সন্যাসীদের ধ্যান ভঙ্গ করার জন্য লোকনাথ ও বেণীমাধব কখনো কখনো তাদের জটাধরে টান দেন,কখনো কৌপিন ধরে। সন্যাসীদের ধ্যান ভঙ্গ হলে তারা দেখতেন দুটি ছোটো ছোটো বালক এই দেখে সন্যাসীরা কিছুই বলতনা।

দিন দিন সাহস বেড়ে যায় লোকনাথ ও বেণীমাধবের। দুজনে মিলে আরো বেশি করে ধ্যানমগ্ধ সন্যাসীদের বিরক্ত করত লাগল। সন্ন্যাসীরা বিরক্ত হয়ে ভগবান গাঙ্গুলির কাছে অভিযোগ করেন। ভগবান গাঙ্গুলি সন্ন্যাসীর সব কথা শুনে মৃদু হেসে বলেন ওরা নিষ্পাপ দুটি বালক। আপনারা ওদের ক্ষমা করুন।

ভগবান গাঙ্গুলির কথা শুনে সন্ন্যাসীরা স্তম্ভদ হয়ে চিন্তা করে বালক দুটির দিকে দেখে তারা হেসে আবার নিজ নিজ আসনে গিয়ে ধ্যানমগ্ন হলেন।

সন্ন্যাসীরা সব ফায়ার যাওয়ার পর ভগবান গাঙ্গুলি লোকনাথ ও বেণীমাধবকে কাছে ডেকে বলল- সন্ন্যাসীরা যখন ধ্যান করে তোমরা দুজনে তাদের জটা ধরে ও কৌপিন ধরে টানাটানি করো কেন। যখন তোমরাও বড় হবে তোমাদেরও পড়তে হবে কৌপিন আর হবে বড় বড় জটা। তোমরা যখন ধ্যান করব তোমাদের ধ্যান ভঙ্গ ও বিরক্ত করলে তোমাদের কি ভালো লাগবে, তোমরাও দুঃখ পাবে।

গুরুদেব ভগবান গাঙ্গুলির কথা শুনে ভাবেন লোকনাথ। লোকনাথ গুরুদেবকে প্রশ্ন করলেন আজ আমরা যে পোষাক পরে আছি এগুলি তবে ক্ষণস্থায়ী। জটাও কৌপিন হবে তাদের চিরস্থায়ী। আবারও গুরুদেবকে প্রশ্নকরলেন লোকনাথ, আমরা যদি সন্ন্যাস হবার জন্য গৃহত্যাগ করে থাকি, তবে আমরা ভিক্ষা না করে বাড়ি থেকে পাঠানো খাদ্য দ্রব্য খেয়ে দিন কাটাচ্ছি কেন ?

লোকনাথের প্রশ্ন শুনে গুরু ভগবান গাঙ্গুলি চমকে উঠলেন। তিনি খুব খুশি হন। তুমি যা বললে শাস্ত্র অনুযায়ী সেটাই ঠিক। কিন্তু তুমি জানো,আমাদের আত্মীয় স্বজন সবাই জানে যে আমরা এই শক্তি পিঠে আছি। তাই তারা আমাদের জন্য খাদ্য দ্রব্য ও খরচ পাঠান। কিন্তু এটাও একটা ভিক্ষা। আমরা যদি এই স্থান ত্যাগ করে অন্য স্থানে চলে যায়, তবে তারা আর সে সব জিনিস আমাদের কাছে পাঠাতে পারবে না।

গুরুদেব ভগবান গাঙ্গুলির কথা শুনে- লোকনাথ সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন-বার বার তো একই জায়গা থেকে ভিক্ষা গ্রহণ করা উচিৎ সন্ন্যাসীর ধর্ম নয়। আমরা আর এই স্থানে থাকবোনা আপনি আমাদের অন্যত্রে নিয়ে চলুন। যেখানে আমাদের খবর বাড়ির লোক কেউ জানতে পারবে না। আমরা সেখানে গিয়ে প্রতিদিন ভিক্ষা করে যা পাবো তা দিয়েই সাধন ভজন করব।

শিষ্য লোকনাথের কথা শুনে গুরুদেব ভগবান গাঙ্গুলি বিস্ময় হতবাগ হয়ে যান। সত্যিই তো সন্ন্যাস ধর্মের কথায় বলেছে শিষ্য লোকনাথ। গুরুদেব মনে মনে খুশি হলেন কিন্তু কিছু তাদের বললেন না।

পরদিন গুরু ভগবান গাঙ্গুলি তার দুই শিষ্য নিয়ে কালীঘাটে মায়ের মন্দিরে গিয়ে মায়ের চরণে প্রণাম জানিয়ে কালীঘাট ত্যাগ করলেন।

ভগবান গাঙ্গুলি শিষ্যদের নিয়ে এমন একস্থানে পৌঁছালেন, নির্জন পরিবেশ ও লোকচক্ষুর অন্তরালে। এই স্থানটি ছিল উপযুক্ত স্থান।এই স্থান থেকে গ্রাম খুব বেশি দূরে ছিলনা তাই তারা ওই স্থানেই আস্তানা পাতলেন।

ব্রহ্মচর্য পালন করতে হলে প্রথমে প্রয়জন দেহ শুদ্ধির। তাই গুরু গাঙ্গুলি তার শিষ্যদের আদেশ দিলেন- সারাদিন উপবাসী থেকে রাত্রে হবিষণ্য গ্রহণ করার।

দীর্ঘদিন এই ব্রত পালন করার পর গুরুদেব শিষ্যদের আদেশ করলেন একান্তরা ব্রত পালন করার জন্য। এই ব্রত একদিন উপবাস থেকে পরদিন আহার করতে হয়। এরপর গুরুদেব আদেশ করলেন ত্রিরাত্রি ব্রত পালন করতে। এই ব্রতে তিনদিন উপবাস থেকে আহার করা।

এরপর শুরু হল পঞ্চই ব্রত অর্থাৎ পাঁচ দিন উপবাস থেকে একদিন আহার করা। এরপর শুরু হল নব রাত্রি পালন করা। গুরুদেব শিষ্যদের কঠিন থেকে কঠিনতম ব্রতপালন করতে লাগলেন। তাদের উপরে শুরু হয় নানা ধরনের পরীক্ষা। এত দিন নির্জন স্থানে ধ্যান করতেন। এবার গুরুর আদেশে হাটে আসুন করে ধ্যান করতে হয়। একদিন গুরুর এদেশে লোকনাথ ও বেণীমাধব এক জঙ্গলের মধ্যে সমাধি সাধনের আসন করে বসলেন। কিন্তু হঠাৎ কিছু পিঁপড়ের দল এসে দুজনকে কামড়াতে লাগলো। বার বার পিঁপড়ে কামড়ানোর জ্বালায় মন সংযোগ করতে না পারে তারা অবশেষে ফিরে এলেন। দ্বিতীয় দিন তারা আবার সেই স্থানে। তারা দেখলেন তাদের গুরুদেব চিনি ছড়িয়ে পিঁপড়েদের ডেকে আনছে। দুজনে মশা, পিঁপড়ে,কীটপতঙ্গর কামড় সহ্য করে ও সমাধি সাধন অভ্যাসে সফল হন।

শাস্ত্র অনুযায়ী বারো বছর সন্ন্যাস জীবন অতিবাহিত করার পর একবার ফায়ার আস্তে হয় জন্মভূমি দর্শনে। শাস্ত্রানুযায়ী গুরুদেব ভগবান গাঙ্গুলী শিষ্যদেরকে নিয়ে চললেন চৌরাশি চাকলা গ্রামে জন্মভূমি দর্শন করাতে। গ্রামে ফায়ার আশায় উদ্দীপনার সৃষ্টি হয় গ্রামে। লোকনাথ অর্ধৈখ ভাবে গুরুদেবকে বললেন। আর এক মুহূর্ত এই গ্রামে থাকতে চাইনা। গুরুদেব ভগবান গাঙ্গুলি লোকনাথের কথা শুনে হাসেন। তিনি আর একমুহূর্ত দেরি না করে চললেন হিমালয়ের পথে।

গুরুদেব ভগবান গাঙ্গুলি আর দুই শিষ্য গিয়ে উপস্থিত হলেন হিমালয়ের বরফাবৃত্ত এক নির্জন স্থানে। এখানে এসে আবারও দুই শিষ্য লোকনাথ ও বেণীমাধব কঠর থেকে কঠরতম সাধনা শুরু করলেন। এবং সেই সব সাধনায সফল হন। তাদের যখন কোনো সমস্যা দেখা যায় তখন গুরু ভগবান গাঙ্গুলি তার সমাধান করে দিতেন।

পঞ্চাশ বছরের সময় কঠিন তপস্যার মধ্যে গুরুদেব তার শিষ্যদের জ্ঞান, কর্ম ও অষ্টাঙ্গ শিখিয়ে ছিলেন। অবশেষে সমাধির উচ্চতম শিখরে এসে পৌঁছেছিলেন শিষ্যদ্বয়। বহু বছর সমাধির উচ্চ শিখরে অবস্থান করার পর শিষ্য লোকনাথ পরমত্ব লাভ করেন।

এই ভাবে লোকনাথ পূরণ ব্রহ্মস্বরূপ জগৎ হিতার্থে আবার জগৎ চেতনায় ফিরে এলেন,তখন লোকনাথের বয়স নব্বই বৎসর এবং গুরুদেব ভগবান গাঙ্গুলির বয়স তখন একশত পঞ্চাশ বৎসর।

৮০ বছর ধরে লোকনাথ কঠিন থেকে কঠিনতম সাধনায় পরম সিদ্ধি লাভ করেন। সাধনা চলা কালীন তিনি কোনো দিকে দৃষ্টিপাত করতে পারেননি। শুধু গুরুর দেওয়া আদেশ একের পর এক পালন করেছেন। সিদ্ধিলাভের পর লোকনাথের দৃষ্টি পড়ল গুরুদেবের উপর। গুরুদেবকে দেখে তার দুটি চোখে অশ্রু ঝরতে লাগলো।

লোকনাথ বেদনা ভরে কন্ঠে গুরুদেবকে বলল- গুরুদেব। আপনার পরম কৃপায় ও আপনার আদেশ মেনে আজ আমি সিদ্ধিলাভ করলাম। কিন্তু আপনার কি হল ? আপনি কি করে মুক্তি লাভ করবেন ?

শিষ্যের কথায় খুশি হবে গুদের ভগবান গাঙ্গুলি বললে- দুঃখ পাসনা লোকনাথ। আমি পবিত্র কাশীধামে গিয়ে আমি এই জীর্ন দেহটা ত্যাগ করে নতুন দেহ ধারণ করে আবার ফায়ার আসবো তোর কাছেই।

শিষ্যদের সিদ্ধিলাভের কিছু দিন পর গুরুদেব ভগবান গাঙ্গুলি শিষ্যদের কাছে ইসলাম ধর্মের মক্কা যাওয়ার প্রস্তাব করলেন। শিষ্যরা গুরুদেবের গুরুদেবের কথায় রাজি হল। গুরুদেব তার দুই শিষ্যকে নিয়ে মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।

পাহাড় পর্বত অরণ্য পার করে শিষ্যদের নিয়ে ভগবান গাঙ্গুলি পৌঁছালেন কাবুলে। সেখানে ‘মোল্লা সাদি’ নাম একজন ধর্ম শাস্ত্রজ্ঞ ধার্মিক মুসলমানের সঙ্গে পরিচয় হয়। ভগবান গাঙ্গুলি তার শিষ্যদের নিয়ে মোল্লা সাদির বাড়িতে অতিথি হয়ে গেলেন। বেশ কয়েকদিন মোল্লা সাদির বাড়িতে থেকে, কোরান পাঠ এবং ইসলাম ধর্ম বিষয় নিয়ে নানা আলোচনা হয় তাদের মধ্যে। এখানেই লোকনাথ কোরান শিক্ষা অর্জন করেছিলেন।

কোরান পাঠ ও ইসলাম ধর্ম সমন্ধে নানা আলচনার মাধ্যমে তারা বুঝতে পেরেছিলেন, যে হিন্দু বা মুসলমান ধর্ম কোন প্রকার প্রভেদ নেই। আসলে সত্য সমন্ধে জ্ঞান না থাকার কারনে মানুষে মানুষে এত প্রভেদ দেখা যায়।

তারা কাবুলে বেশ কিছুদিন থাকার পর চলে আসেন মদিনায়। মুসলমানরা ও তাদের যথাযোগ্য সন্মান করেন। এখানে এসেও বেড ও কোরান নিয়ে এবং হিন্দু ধর্ম ও ইসলাম ধর্ম নিয়ে অনেক আলচনা করেন। মদিনা থেকে তার মরুভূমির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। পথে একজন উচ্চস্তরের মুসলমান ফকিরের নাম শুনে তারা তার আস্তানায় যায় দর্শন করার জন্য। তার বয়স প্রায় ৪০০ বছর। তিনি এক নির্জন স্থানে নিজেকে আত্মগোপন করে সবসময় সমাধি অবস্থায় থাকতেন। এর নাম আব্দুল গফুর। লোকনাথকে দেখে তার সমাধি ভঙ্গ হয়। তিনি লোকনাথের সাথে আলিঙ্গন করেন এবং ধর্ম সমন্ধেও আলোচনা করেন। এই মহাপুরুষকে দর্শন করে তারা মক্কায় গিয়েছিলেন।

মক্কায় বেশ কিছুদিন থাকে পর ভগবান গাঙ্গুলি শিষ্যদের কাশীধামে যাওয়ার অভিলাষ জানান। তারা কাশি ধামের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। দীর্ঘপথ অতিক্রম করে অবশেষে তারা উপস্থিত হলেন কাশি ধামে। পতিত পাবনী গঙ্গায় স্নান করে ভগবান গাঙ্গুলি বিশ্বনাথের চরণে বন্দনা করলেন। পূরণ হল তার মনোবাসনা। কিন্তু তার মনে চিন্তা থেকে গেল শিষ্যদের নিয়ে।

হঠাৎ তার মনে পড়ল মহাযোগী ত্রৈলঙ্গ স্বামীর কথা। আর দেরি না করে শিষ্যদের নিয়ে ত্রৈলঙ্গ স্বামীর কুঠিরে পৌচ্ছালেন। সেখানে সারাদিন শাস্ত্র আলোচনা, ধর্ম আলোচনা করে বেশ কিছুদিন আনন্দে কেটে যায়।

একদিন ত্রৈলঙ্গ স্বামীর কুটিরে বসে গুরু ভগবান গাঙ্গুলি তার শিষ্য লোকনাথ ও বেণীমাধবকে ডাকেন। দুজনে হাত ধরে ত্রৈলঙ্গ স্বামীর হাতে তুলে দিলেন। আর বলল- আজ থেকে এদের সমস্ত দায়িত্ব আপনার। মহাযোগী ত্রৈলঙ্গ স্বামী বললেন- এতে চিন্তার কি আছে? তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। সব দায়িত্ব পরমেশ্বরের,তুমি মনে কোনো প্রকার দ্বিধা রেখোনা।
পরের দিন ভগবান গাঙ্গুলী গেলেন পাতঃস্নানে। দীর্ঘসময় কেটে গেলো কিন্তু গুরু দেব ফিরে না আসায়। শিষ্যরা চঞ্চল হয়ে উঠলো। তারা আর দেরি না করে লোকনাথ বেণীমাধব এবং আশ্রমের কয়েক জনকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন মানিক নিকার ঘাটে।

সেখানে এসে তারা দেখল গুরুদেব মগ্ন হয়ে আছেন। এই দৃশ্য দেখে চমকে উঠলেন, তবে কি গুরুদেব মহা প্রস্থানের পথে পারি জমিয়েছেন। লোকনাথ শ্রদ্ধা সহকারে তিনি গুরুদেবকে স্পর্শ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে ঢলে পড়লেন ভগবান গাঙ্গুলির শরীর।

ভগবান গাঙ্গুলি ছিলেন গৃহী সন্ন্যাসী। তাই তার দেহ পতিতাদ্বারিনী গঙ্গার কোলে মণিকর্ণিকার মহাশ্মশানে তার চিতাশয্যা রচনা করা হল। পুত্রের কার্য করলেন শিষ্য লোকনাথ, মুখাগ্নি করলেন তিনি। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল চিতাগ্নি। তারপর কিছুক্ষনের মধ্যেই গুরু ভগবান গাঙ্গুলির পঞ্চভৌতিক নশ্বর দেহ পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে গেল।

গুরুদেব ভগবান গাঙ্গুলির পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম শেষ করে লোকনাথ ও বেণীমাধব ত্রৈলঙ্গ স্বামীর কুটিরেই কিছুদিন কাটালেন, ধ্যান সাধন করে।

হাঠৎ লোকনাথের মনে দেশ ভ্রমনের ইচ্ছা জাগলো। লোকনাথ বন্ধু বেণীমাধবকে তার মনের কথা জানালেন। বেণীমাধব রাজি হলেন তার কথায়। ত্রৈলঙ্গ স্বামীও তাদের সঙ্গী হলেন। তিনজনে বেরিয়ে পড়লেন দেশভ্রমণের উদ্দেশ্যে। এবার তারা গেলেন-আরবে, সেখানে কয়েকদিন কাটিয়ে, গেলেন ইসরায়েলে এখানে থেকে পারস্য,তারপর গেলেন আফগানিস্তান। এখানে কয়েকদিন বিশ্রাম নিয়ে তারা ইউরোপের পথে পারিদিলেন এবং ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমন করে আবার তারা ফায়ার এলেন ভারতে।

আরব, ইস্রায়েল, পারস্য, আফগানিস্তান ও ইউরোপ তারা যেখানেই গিয়েছেন সেখানেই যথেষ্ঠ সন্মান পেয়েছেন। দুর্গম পথ অতিক্রম করে তারা ফায়ার এলেন ভারতের বুকে। হাঠৎ লোকনাথের ইচ্ছা হয় মহাপ্রস্থানের পথে অগ্রসর হবার জন্য। বন্ধু বেণীমাধবকে জানায় তার মনের ইচ্ছা। বেণীমাধব রাজি হযে বারফাবৃত্ত পথ দিয়ে তারা এসে পৌঁছালেন বদ্রীনাথে। তারা কিছুদিন কাটালেন বদ্রীনাথ মন্দির আশ্রমে।

সেখান থেকে তারা পথ চলা শুরু করলো। বরফের ভিতর দিয়ে মাইলের পর মাইল হেটে তারা পৌচ্ছালেন সাইবেরিয়াতে। সেখানে সূর্যোদয় না হওয়ায় চারিদিক অন্ধকার হওয়ায়। বাধ্য হয়ে তারা আলোর আশায় অপেক্ষা করতে থাকেন। আবার চলতে শুরু করেন সমভূমির দিকে। অবশেষে তারা পৌচ্ছালেন চীন দেশে।

একদিন বেণীমাধব লোকনাথকে জানান যে তিনি তন্ত্রসাধনার মহাপীঠ কামাক্ষায় যেতে চান। লোকনাথের বাল্যকালের সঙ্গী বেণীমাধব একদিন বিদায় নিয়ে রওনা হন দেবী দর্শনের কামনায় কামাক্ষার পথে। আর লোকনাথ চললেন চন্দ্রনাথ পাহাড় সংলগ্ন গভীর অরণ্যের মধ্যে দিয়ে নিমভুমির পথে।

হটাৎ একদিন জঙ্গলে আগুন লাগে। দেখতে দেখতে জঙ্গলে আগুনের লেলিহান শিকা ছড়িয়ে পরে। পশু পক্ষীর দল সব প্রাণের ভয়ে ছুটে পালতে লাগলো। সেই জঙ্গলের এক বৃক্ষতলে জটাধারী সন্ন্যাসি ধ্যানমগ্ন অবস্থায় বসে আছেন। সন্ন্যাসীর চারিদিকে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। একটু হলে অগ্নির লেলিহান গ্রাস করবে সন্ন্যাসীকে।

সন্ন্যাসীর ধ্যান ভঙ্গ হলে দেখেন চারিদিকে আগুন জলছে। বেরনোর রাস্তা না পেয়ে সন্ন্যাসী করুনাময় শ্রী মধুসূধনকে স্মরন করতে লাগলেন।

লোকনাথ যোগবলে আগুনের মধ্যে প্রবেশ করেন। সন্ন্যাসীকে শিশুর মতো কোলে তুলে নিয়ে নিরাপদ স্থানে পৌচ্ছালেন। ইনি হলেন মহাপুরুষ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী। লোকনাথ বাবা আগুনের হাত থেকে একেই বাঁচিয়ে ছিলেন।

চন্দ্রপাহাড় ত্যাগ করে ত্রিপুরা জেলার দাউদকান্দি গ্রামে এসে একটি নির্জন বৃক্ষতলে আসন করে বসেন। বারদী গ্রামের ডেঙ্গু কর্মকার ফৌজদারি মামলায় আসামী হয়ে দাউদকান্দিতে ছিল। ডেঙ্গু উদভ্রান্ত হয়ে নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। হাঠৎ এক বৃক্ষতলে জটাজূটধারী বাবা লোকনাথকে দেখে দৌড়ে এসে চরণ ধরে কাঁদতে থাকে। ডেঙ্গু বাবা লোকনাথকে তার সব ঘটনা খুলে বলল। শেষে গম্ভীর কন্ঠে বলেন-তুই এই মামলায় বেকসুর খালাস পাবি, এখন তুই ঘরে ফায়ার যা বাবাকে প্রণাম করে ডেঙ্গু বারো ফিরে আসে। পরের দিন রায়, সবাই জানতো ডেঙ্গু কঠিন শাস্তি পাবে। বিচারপতি ডেঙ্গুকে বেকসুর খালাস করে দিলেন। ডেঙ্গু সঙ্গে সঙ্গে সেই বৃক্ষের কাছে ছুতে এসে বাবার চরণ ধরে দু নয়নের জলে ধুয়ে দিলেন।

ডেঙ্গু বাবাকে সাথে করে তার বাড়িতে নিয়ে এল বারদীতে। একদিন বাবা লোকনাথ বড়দির গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। হঠাৎ দেখেন কয়েকজন ব্রাহ্মণ যজ্ঞপবিতে জেটা পাকিয়ে ফেলে নিজেদের মধ্যে কলহ শুরু করেছে। বাবা তাদের দিকে এগিয়ে যেতেই ব্রহ্মনরা পাগল বলে তাড়াতাড়ি করতে লাগল। বাবা হেসে বললেন-তোমরাতো দেখছি ব্রাহ্মণ-পৈতেতে জট খুলতে পারছো না। গায়িত্রী জপ করেইতো জট খুলে যাবে।

পাগলের কথায় সবাই অবাক।তারা বলে- জপতো করলাম কিন্তু খুলছে আর কোথায় ?

পাগল হেসে বললেন-বেশ তবে আমি মন্ত্র গায়ত্রী জপ করছি মন্ত্র উচ্চারণ করতে লাগলেন কিছুক্ষনের মধ্যেই পৈতের জট খুলে গেছে।

এই ব্যাপার দেখে ব্রাহ্মণরা বুঝতে পারেন ইনি সাধারণ মানুষ হতে পারেননা, ইনি মহাপুরুষ। সকল ব্রাহ্মণ মাইল বাবার চরণ ধরে ক্ষমা চাইতে লাগেন। এই ঘটনার কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ায় দলে দলে ডেঙ্গুর বাড়িতে বাবাকে দর্শনের জন্য ছুটে আসে।

বেশ কিছু কাল কেটে যায় এই ভাবে,হাঠৎ ডেঙ্গু ইহজগতের সব ময় কাটিয়ে পরলোকে গমন করেন। ডেঙ্গুর পরিবারে নেমে আসে শোকের ছায়া। বাবা বাড়িতে থাকার ফলেই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। তারা বাবাকে বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার কথা বলে। বাবা ডেঙ্গুর গৃহ ত্যাগ করে চলে যায়। বড়দির জমিদার বাবাকে তারবাড়িতে সমাদর নিয়ে যান।

বাড়িতে কিছুদিন থাকার পরে বাবাকে বলেন আশ্রমের জন্য একটি স্থান নির্বাচন করার জন্য। বাবা অরাজি হন। কিন্তু ভক্তদের একান্ত ইচ্ছায় রাজীবন।

ছাওয়াল বাঘিনী নদীর তীরে একটি জমি আশ্রমের জন্য নির্ধারণ করেন বাবা। বাবা যে জায়গাটি নির্বাচন করেছিলেন সেই জায়গাটি ছিল শ্মশান। ছাওয়াল বাঘিনী নদীর তীরে গড়ে উঠল একটি আশ্রম। এই বারদী আশ্রমে বাবা দীর্ঘদিন কাটিয়ে ছিলেন।

বাবা বারদীতে অবস্থান কালীন বহু ভক্তগন আসতেন বাবার কৃপার জন্য। একদিন লোকনাথ বাবার সমাধি ভঙ্গ হয়েছে। এমন সময় এক ভক্ত এসে বাবার চরণ ধরে নয়নের অশ্রু জলে ভেসে যায় ভক্তটির বুক।

বাবা লোকনাথ বললেন- কি হয়েছে তোর ? এত কাঁদছিস কেন রে ?
ভক্তটি বললেন- বাবা আমার পুত্রকে বাঁচান, যক্ষারোগে আক্রান্তহয়ে মৃত্যুরদিকে এগচ্ছে। আমার একমাত্র সন্তান আপনি তাকে রোগমুক্ত করুন।বাবা ছেলেটি ভালো ভাবে দেখে বললেন- তোর ছেলের আয়ু শেষ হয়ে এসেছে। যাকে বাঁচানো সম্ভব হবে না। ভক্তের কথায় বাবা পুত্রের ব্যাধি নিজের শরীরে গ্রহণ করলেন। ছেলেটি দিন দিন সুস্থ হয়ে ওঠে। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যে ছেলেটির অকাল মৃত্যু হয়। ভক্তটি পুত্র শোকে ব্যাকুল হয়ে বাবাকে জানাতে আসে- বাবা বলেন- ওরে যে সময় হয়েছিল রে আর তো ওকে রাখা যাবে না। ওকে চলে যেতে দে। সময় হলে সকলকেই চলে যেতে হয়। বাবা লোকনাথের শরীরে আরজি ত্রুমে ত্রুমে বেড়েই চলেছে। মহাপ্রাণের সময় এগিয়ে আসছে। ভক্তদের কাছে তিনি ঘোষণা করেন। ১৯শে জ্যৈষ্ঠ আমি এই নশ্বর দেহ ত্যাগ করবো। আমার দেহটা তোরা আগুনে পুড়িয়ে ডিবি। বাবার কথা শুনে ভক্তদের কাছে বিনা মেঘে বজ্রপাত পড়ল মাথায়।

দূর দূর থেকে ছুতে আসছে আবাল-বৃদ্ধ সকলে তাদের প্রাণের দেবতাকে দেখতে, সবার চোখে মুখে ফুটে উঠছে আসন্ন বিরহের বেদনা।

বাবা আসন ত্যাগ করে আশ্রমের বারান্দায় এসে বসলেন। অসংখ্য ভক্ত তাকে প্রণাম জানালো। বাবা স্নিগধ মধুর হেসে সকলকে প্রসাদ গ্রহণ করতে বললেন। বাবার নির্দেশে ভক্তরা প্রসাদ গ্রহণ করল। আহার শেষ করে বাবা ফায়ার গেলেন ঘরে আবার আসন বসলেন। ভক্তরা অপেক্ষা করতে থাকেন।

ঘরের ভিতর থেকে বাবা ভক্তদের উদ্দেশ্যে বললেন-ওরে তোরা এত কাতর হয়েপড়ছিস কেন! আমি যেমন তেমনি থাকবো শুধু এই জীর্ন পুরাতন শরীরটা থাকবেনা। আমার কি আর মৃত্যু আছেরে ? তোরা আমাকে ভক্তি আর বিশ্বাস করে ডাকলেই দেখবি তোদের কথা শুনবো।

এই ভাবে ভক্তদের উপদেশ দিয়ে বাবা মহাসমাধিতে মগ্ন হয়ে গেলেন। ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যাওয়ার পরেও বাবার সমাধি ভঙ্গ হচ্ছে না, দেখে ভক্তগন ব্যাকুল হয়ে পড়েন। তবে কি বাবা ইহলোক ছেড়ে পরলোকগমন করলেন।

বাংলা ১২৯৭ সালের ১৯ জ্যৈষ্ঠ। বেলা ১১তা ৪৫ মিনিট। একজন ভক্ত বাবার দেহ স্পর্শ করলেন বাবার প্রাণহীন দেহটা মাটিতে ঢলে পড়ল। শোকের ছায়া নেমে আসল বারদীতে। এছাড়া ও সমগ্র ভরতে নেমে এল শোকের ছায়া। বাবার দেহ নিয়ে আসা হয় আশ্রমের প্রাঙ্গনে। বাবার শেষ নির্দেশ অনুযায়ী সাজানো হলো চন্দন কাঠের চিতাশয্যা। তার উপর বাবার পবিত্র দেহটা শয়ন করানো হল।চিতায় অগ্নি সংযোগ করা হয়। দেখতে দেখতে আগুনের লেলিহান শিখা বিস্তার করে সর্বগ্রাসী ক্ষুধা নিয়ে জ্বলে ওঠে চিতাগ্নি। অলৌকিক মহাতাপসের নশ্বর দেহ ভস্মীভূত হয়ে যায়। বিলি হয়ে যায় পঞ্চভূতে।

এমএম//


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি