বাবার যোগ্য সন্তান
প্রকাশিত : ১৭:১৮, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ | আপডেট: ০৯:৫৮, ৩ অক্টোবর ২০১৮
বাবা হারানো একজন মেয়ে হিসেবে জানি, বাবার যোগ্য সন্তান বলার চেয়ে বড় কোন প্রশংসা আমাদের কাছে আর কিছু হয় না। সেই অনুভুতি দিয়ে আমি বুঝি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা জগৎজুড়ে যতই প্রশংসিত হন, যত অর্জনই তার থাকুক না কেন, `বঙ্গবন্ধুর যোগ্য সন্তান` এটাই তার সবচেয়ে বড় অর্জন।
বঙ্গবন্ধুর যোগ্য সন্তান হওয়া কি চাট্টিখানি কথা? সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালির জীবনের যে অর্জন তা কি হাজার বছরে কোন বাঙ্গালী পেরেছে করতে? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বাঙ্গালীর শত বছরের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ও সংগ্রামের সার্থক পরিণতির রচয়িতা। তার রেখে যাওয়া এইবিশাল পদচিহ্নের কাছাকাছি যাওয়া কি সহজ? সহজ কি হয়েছে তার মেয়ের জন্যও? তাঁকে কি অনেক উচ্চ মূল্য দিতে হয়নি তাঁর বাবার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার চেষ্টা করতে গিয়ে?
বরং, একথা সত্য যে বঙ্গবন্ধুর মেয়ে বলেই হয়ত প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে অনেক বেশি বন্ধুর পথ পার হতে হয়েছে। সব হারানো দেশের মানুষের শেষ ভরসার প্রতীক হয়ে ওঠেন তিনি। পর্বত সমান আশা-আকাঙ্খা ছিল মানুষের তাঁর কাছ থেকে - যেই আকাঙ্খার অনেকটাই ছিল অবাস্তব এবং সময় সাপেক্ষ। অধৈর্য মানুষের বিবেচনাহীন সমালোচনা কম সহ্য করতে হয়নি তাঁকে।
অথচ কি দেশ তিনি হাতে পেয়েছিলেন? `৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গে গলা টিপে শ্বাস রোধ করা হয় মুক্তিযুদ্ধের সব আদর্শ ও চেতনার। বরং ঠিক উল্টো পথে আবার পাকিস্থানীকরণের চক্রান্তে পড়ে হারিয়ে যেতে বসেছিল আমাদের সব কিছু– আমাদের জাতীয়তাবোধ, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, সাম্যবাদের আকাঙ্ক্ষা সব ধূলিস্যাৎ হয়ে গিয়েছিল। দেশ বিরোধী যুদ্ধাপরাধীরা বসে ছিল ক্ষমতার মসনদে। আমাদের আত্মপরিচয় ভুলিয়ে, ইতিহাস বিকৃত করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জনকে ধ্বংসের দাড় প্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল তারা। সেই ক্রান্তিলগ্নে, দমন-পীড়নে নিষ্পেষিত মৃতপ্রায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির কাছে শেখ হাসিনা আবির্ভূত হন ত্রাতার ভুমিকায়। নিজের বুকে সব আঘাত টেনে নিয়ে বাঙালি জাতিকে অন্ধকারের অতল থেকে তুলে আনেন এক হাতে।
তার এই কণ্টকাকীর্ণ রাজনৈতিক যাত্রা পথে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য শত্রুদের চক্রান্তছিল সার্বক্ষণিক। তিনি যখন দেশে ফিরে আসেন তখন বাবার খুনীরা ছিল শাসন ক্ষমতায়। জীবনের ঝুঁকি নিয়েই তিনি ফিরে আসেন মৃত্যু ভয় তুচ্ছ করে। আর এই দিয়েই শুরু হয় তাঁর প্রতি পদক্ষেপে বঙ্গবন্ধুর কন্যা হবার প্রমাণ দেওয়া। জীবনের ঝুঁকি নিয়েই দেশের জন্য কাজ করেছেন তিনি সারাজীবন, ঠিক তার পিতার মত।
তাঁর ওপর কমপক্ষে ১৯ বার হামলা হয়েছে। ভাবলে বিস্ময়কর লাগে কি নিষ্ঠুর তাঁর রাজনৈতিক বিরোধীরা! রাজনীতির দাবা খেলায় জয়ী হতে হয় জনগণের মন জয় করে। অথচ, তাঁর বিরোধীরা তাঁর রাজনীতির সঙ্গে না পেরে, বার বার চেষ্টা করেছে তাঁকে হত্যা করতে। কি নিষ্ঠুর! কি কুটিল। আর তা হবেই না বা কেন? মনে রাখতে হবে তাঁর বিরোধী কারা। তাঁর বিরোধীরা তারাই যারা বাংলাদেশের উদ্ভব চায় নাই, ত্রিশ লক্ষ মানুষের গণহত্যাকারী, ৪ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম লুণ্ঠনকারী, তাঁর পিতা বঙ্গবন্ধুসহ তাঁর পুরো পরিবারের হন্তারক, স্বাধীনতা বিরোধী চক্র। তারাই তো তাঁর রাজনৈতিক বিরোধী শুধু নয়, তারাই সেই কুচক্রি গোষ্ঠী যারা তাঁকে হত্যা করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যে পুনরুত্থান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ঘটিয়েছেন- সেই চেতনাকেই ধ্বংস করতে চায়।
এহেন চক্রান্ত কারীদের চক্রান্তকে মোকাবিলা করে তাঁকে আগাতে হয়েছে। শুধু কি বাইরে তিনি শত্রু পরিবেষ্টিত? তাঁর ঘরও কি বিভীষণে পূর্ণ নয়? প্রতি পলে পলে তাঁকে দলের ভিতর অজস্র চক্রান্তকারীকে মোকাবিলা করে আগাতে হয়েছে। প্রকাশ্য শত্রুর চেয়ে তাঁরা কম ক্ষতিকর ছিল না। ধীশক্তি, সাহস ও ধৈর্য দিয়ে একে একে তাঁদের সবাইকে তিনি পরাজিত করে আজ নিজের জন্য এক অনন্য অবস্থান তৈরি করছেন যেখানে মানুষ তাঁকে এখন তাঁর বাবার সঙ্গে তুলনা করা শুরু করেছে।
কি বিশাল অর্জন এটা! চিন্তা করা যায়? হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের বিশাল ব্যক্তিত্ব আর ততোধিক বড় অর্জনের সমান হয়তো কেউ হতে পারবে না কোনদিনও কিন্তু তাঁর সঙ্গে তুলনীয় হবার মতো উচ্চ অবস্থানে স্বাধীন বাংলাদেশের আর কোন রাজনীতিবিদ কি যেতে পেরেছেন? যিনি পারলেন তিনি সেই বঙ্গবন্ধু রক্তের উত্তরাধিকার জননেত্রী শেখ হাসিনা। মানুষ এখন এক বাক্যে স্বীকার করে যে তিনি তাঁর বাবার যোগ্য সন্তান।
আমাদের মত শহীদ পরিবারের যারা আছেন এই দেশ শুধু তাঁদের স্বদেশ নয়, আরও অনেক কিছু। এই দেশ আমাদের স্বজনের রক্তের বিনিময়ে, আমাদের পরিবারের সব সুখের বিনিময়ে পাওয়া এক পবিত্র ভূমি। `৭৫-এর পট পরিবর্তনের পর শহীদ স্বজনরা শুধু তাঁদের স্বজনদের হত্যাকারীদের ক্ষমতার শীর্ষেই দেখে নাই, তাদের দ্বারা বার বার নিষ্পেষিত, নির্যাতিত হয়েছেন। শহীদ পরিবাররা তাঁদের শহীদ স্বজনদের নির্মম হত্যা কাণ্ডের বিচারের আশা এক প্রকার ছেড়েই দিয়েছিলেন। বিচারের আশা এক অলীক স্বপ্নে পরিণত হয়েছিল।
সেই অলীক স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। তার খুব কাছের রাজনৈতিক সহযোগীরা অনেকেই তাঁকে বারণ করেছিলেন। কিন্তু তিনি ঘরে বাইরে দেশে বিদেশে সব বাধা তুচ্ছ করে মানবতার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। দেশের সূর্য সন্তানদের যে কুলাঙ্গাররা হত্যা করলো, তাদের বিচার করছেন। সেই বিচার প্রক্রিয়া চালিয়ে নেবার জন্য তাঁকে অচিন্তনীয় বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। তিনি ছিলেন অবিচল। তিনি এই বিচারের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রমাণ করেছে তিনি ইস্পাতের মত দৃঢ় মনোবল ও সাহসের অধিকারী। এমন সাহস ও মনোবল ছিল তাঁর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের মাঝে। তাই তো তিনি তাঁর পিতার যোগ্য কন্যা।
আজ মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ গড়ার, সোনার বাংলা গড়ার, তাঁর বাবার অসমাপ্ত কাজ শেষ করার অঙ্গীকার নিয়ে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা । বঙ্গবন্ধু আমাদের দিয়েছিলেন স্বাধীন দেশ, শেখ হাসিনা গড়ে দিচ্ছেন সোনার বাংলা। মাঝে মাঝে ভাবি, মৃত্যুর ওপার থেকে যদি দেখা যায়- তবে তাঁর মেয়েটিকে নিয়ে নিশ্চয়ই অনেক গর্বিত হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু, নিশ্চয়ই অনেক দোয়া করছেন তাঁর মেয়েটিকে - যেমনি ভাবে আমরা সবাই আজ গর্ব করি আমাদের নেত্রীকে নিয়ে, যেমনি ভাবে অশ্রুজলে ভিজে তাঁর সর্বাঙ্গীণ মঙ্গলের জন্য দোয়া করে বাংলাদেশের ষোল কোটি মানুষ। তিনি দীর্ঘজীবী হউন, তাঁর হাত ধরে বাংলাদেশ এগিয়ে যাক উন্নয়নের পথে–তাঁর জন্মদিনের এই শুভক্ষণে কায়মনো বাক্যে এই প্রার্থনা করি।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক (চক্ষু), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।
এসএইচ/