বাবার স্বাক্ষরে সবার বেতন হলেও তার নিজের হয় না
প্রকাশিত : ১৬:১৪, ৩ মে ২০২০ | আপডেট: ১৬:৫০, ৪ মে ২০২০
বরিশালের শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এ বছর এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি মাত্র। ছোট বোন আফিয়া আঞ্জুম ইমলিও এ বিদ্যালয়টির ৪র্থ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। আমি স্বভাবতই বিতর্কসহ অন্যান্য সহ-শিক্ষা কার্যক্রমে নিয়োজিত ছিলাম। গল্পের বই-ই ছিল আমার দুনিয়া। নানা আয়োজনে যোগদানকারী মাধ্যমিক পড়ুয়া মেয়ের খরচ বাবার কাছে স্বাভাবিকভাবেই অনেকটা বেশি। স্কুল, প্রাইভেট, কোচিং এসবের পেছনেও খরচের বিশাল ফিরিস্তি। তবে একটা এমপিওভুক্ত কলেজের অধ্যক্ষ বাবার জন্য এটা বহন করতে খুব বেশি অসুবিধা হওয়ার কথা না।
বাবা আমার জয়কুল আদর্শ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় ও সংযুক্ত কারিগরি স্কুল এন্ড কলেজ, কাউখালি’র অধ্যক্ষ মো. জসিম উদ্দীন। আশ্চর্যের বিষয় রাতের ঘুম হয় না তার সংসারের টাকা যোগানের চিন্তায়। চার জনের ছোট্ট পরিবারটির খরচ, আমাদের দুই বোনের পড়ালেখা, দাদা-দাদির বাজার খরচ, ঔষধের খরচ তার মতো এক ব্যক্তির জন্য তেমন কিছুই না। এমনটিই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এসব খরচ বাদ থাক, প্রতি মাসের কিস্তির টাকা জোগাড়ের কথা ভাবতে ভাবতেই ৪৫ ঊর্ধ্ব মানুষটা অকাল বার্ধক্যে পৌঁছে গেছেন। কেন জানেন?
প্রায় সাড়ে ৩ বছর আগে বাবা উলানিয়া মুজাফফর খান ডিগ্রী কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। এরপর রাত জেগে আমাদের সাথে পাল্লা দিয়ে প্রস্তুতি নিয়ে সকল আনুষ্ঠানিকতায় যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন। সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে জয়কুল আদর্শ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় ও সংযুক্ত কারিগরি স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন। কিন্তু এই সাড়ে ৩ বছর ধরে কলেজের কোনো এক কাগজের সমস্যার কারণে তিনি ঈদ, কুরবানির বোনাস দূরে থাক, বেতনের একটা টাকা পর্যন্ত তুলতে পারেননি। প্রথম প্রথম সবাই বলতেন, খুব তাড়াতাড়িই সব ঠিক হয়ে যাবে। সেই আশায় দিন, মাস, বছর গুণতে লাগলাম। অনেক জায়গায় তো বাবাকে লাখ টাকা পর্যন্ত ঢালতে হয়েছে এর সমাধানের জন্য। কিন্তু তারা শুধু বলতেন, সামনের সপ্তাহে খবর বলব। সেই সামনের সপ্তাহ আর শেষই হলো না।
স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন জায়গা থেকে টাকা ধার করে তাদের টাকা দেয় বাবা। সবাই ধারও দেয়। কারণ বাবা একজন অধ্যক্ষ। এরপর একটা ফ্ল্যাটের মালিক। যাইহোক, এভাবে কাজ হবে না বুঝে আইনী সহায়তার জন্য কোর্টে মামলা তোলা হলো। অনেক মাস পরে আমাদের পক্ষে রায়ও হল। কর্তৃপক্ষ দেরী করে আপিল করল। দেরী করলে নাকি আপিল খারিজ হয়ে যায়। কিন্তু তার জন্য তো মামলাটা বেঞ্চে উঠতে হবে। চলতি বছরের জুলাইয়ের শেষে রায় হওয়ার কথা। এখন এই করোনা পরিস্থিতিতে হয়তো জুলাইতেও সেটা হবে না।
আমি কোর্ট-কেস-মামলা বুঝি না। বুঝি আমার বাবার কষ্ট। জীবনের এই কঠিন সংগ্রামের মধ্যে আমাদের সংসার পরিচালনার জন্য অনেক নিচে নামতে হয়েছে বাবাকে। অনেক ঋণী হয়ে গেছেন তিনি। শুধু আমাদের ভালো পরিবেশে রাখবেন বলে, ভালো স্কুলে পড়াবেন বলে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে, কিছু জমি বিক্রি করে ও আম্মুর কিছু গয়না বিক্রি করে বরিশাল শহরে ফ্ল্যাট কেনেন। সেটা ২০১৪ সাল। প্রত্যেক মাসে অনেক টাকা কিস্তি পরিশোধ করতে হয়। ফ্ল্যাট কেনার পরপরই বাবার পায়ে বড় ধরণের একটা অস্ত্রপচার হয়। অনেক টাকা খরচ হয়। তখনও অনেক টাকা আত্মীয়-নিকটাত্মীয়দের থেকে ধার নিতে হয়। সেই দেনা শোধ করতে না করতেই এই কলেজে যোগদান করেন এবং আজ পর্যন্ত বেতন তুলতে পারেননি। এই কলেজে আব্বুর আগেও ৩ জন অধ্যক্ষ ছিলেন এবং বেতনও তুলেছেন।
সব থেকে বিষাদের ব্যাপার হলো- আব্বুর স্বাক্ষরেই অন্যান্য শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন হয়। কিন্তু তার বেতন হয় না। আব্বুর ওপর প্রথমে খুব রাগ হতো যখন বিতর্কে ঢাকা যাওয়ার সুযোগ পেলেও নিয়ে যেতে চাইতেন না। গল্পের বই কিনে দিতে চাইতেন না। তখন বুঝিনি। আজ বুঝি কেন গল্পের বই, বিতর্ক, কুইজ ইত্যাদি উৎসাহদাতা বাবা হঠাৎ এমন হয়ে গেলেন।
সে যাই হোক, অর্থ উপার্জনের উপায় না পেয়ে আম্মু কোরআন ও বাচ্চাদের একাডেমিক পড়া পড়িয়ে উপার্জন শুরু করলেন। যেখানে তিনি আগে বিনামূল্যে পড়াতেন। আব্বুও কয়েকটা বাচ্চা পড়াতেন। আর একটা দোকান ভাড়া দিয়ে কিছু আয় হতো। এর বেশিরভাগই আমাদের পড়াশোনায় লেগে যেত। এরওপরে আম্মুকে ডায়াবেটিস, হাই ব্লাড প্রেশার, থাইরয়েড ইত্যাদি রোগের ঔষধ নিয়মিত খেতে হয়। আব্বুর ডায়াবেটিস, লো প্রেশার রয়েছে। এখন তা কি অবস্থায় আছে জানি না। কারণ অনেক বছর যাবৎ ডাক্তারের শরণাপন্ন হননি তিনি। কারণ হাসপাতালে আসা-যাওয়ার খরচ, ফি দিয়ে সে বাসায় ভালো বাজার আনতে পারবেন, আর ডক্টর দেখাইলে তো অনেক ঔষধ কিনতে হবে। যখন আমাদের কোনো আবদার মেটাতে না পেরে আমাদের বকা দিয়ে চলে যেতেন, তখন আমাদের থেকে হাজার গুন কষ্ট তিনি নিজে পেতেন, এখন বুঝি। যখন সারা মাসের খরচ, কিস্তি, পাওনাদারের চিন্তা মাথায় ঘোরে তখন একেক দিন লোকটা পাগলের মত করে। তখন হয়ত মরে যেতে ইচ্ছে হয়, কিন্তু মরতে পারে না। কারণ কিস্তি আর ঋণের বোঝা সইতে না পেরে আমাদেরও যে মরতে হবে।
দিন যত বাড়ে দুঃসময়ের সাহায্যকারী বন্ধুও তত কমে। অনেক প্রাভাবশালী-পয়সাওয়ালা আত্মীয় এমনকি নিকটাত্মীয় ও আছেন। যাদের জন্য আব্বু সারাজীবন মাথার ঘাম পায়ে ফেলেছেন। তারা ফোন করে একদিন খোঁজও নেয় না। খেতে পারছি কিনা, চলতে পারছি কিনা, ঈদে, কুরবানীতেও নাহ। এমনকি কুরবানী না দেওয়ায় একবার কল করেও বলেনি কেউ, বাচ্চাদের নিয়ে তাদের বাসায় যাওয়ার জন্য। তারা সাহায্য করে না, কারণ আমাদের অপরাধ একটাই, নিজেদের ফ্ল্যাট আছে। এই একই অপরাধে এই করোনা পরিস্থিতিতে কারও কাছে সাহায্যও চাইতে পারি না। এই ফ্ল্যাট বিক্রির অনেক চেষ্টা করেছি, যাতে সব পাওনা মিটিয়ে দিতে পারি। সব গুছিয়েও এসেছিল। কিন্তু করোনার প্রকোপ বাড়ায় তা আর হয়নি। আর এই করোনার মধ্যে কেউ বাবার কাছে পড়তেও আসে না, আম্মুও কাউকে পড়াতে যান না। দোকানের ভাড়াটিয়াও চলে গেছে। মানবিকতার খাতিরে এ মাসের ভাড়াও চাইতে পারেননি। খাবার দাবার যা আছে বাসায় তা দিয়ে হয়তো আর কয়েকটা দিন চলবে।
যারা দরিদ্র সীমায় অবস্থান করছে তারা ত্রাণ নিতে পারেন। বড়লোকের মধ্যে যারা আছেন, সেদিনও দেখলাম আম, কলা, ডাব সব কিছুতে ভরা তাদের বিশাল স্টোর রুম। কিন্তু আমরা যারা মধ্যবিত্ত আর এত সমস্যার মধ্যে আছি, তারা তাদের দুঃখের কথা, অভাবের কথা কাকে বলবে? কে অন্ন জোগাবে এই দূর্যোগের মধ্যে? ৪র্থ শ্রেণিতে পড়া মেয়েটাও যখন রোজা রেখে আল্লাহর কাছে মোনাজাত ধরে বাবার বেতনের জন্য আল্লাহকে বলে। ওর সামনে যেসব ইফতার দেওয়ার কথা তা দিতে পারেন না বাবা। মেয়েরা তা হাসি মুখে মেনে নিলেও বাবার আত্মার অবস্থা তখন কেমন হয়? নিজেকে কতটা অপরাধি মনে হয়?
আমরা যদি মানবেতর জীবন যাপন করেও যদি বেঁচে থাকতে পারতাম, তাও হত। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে হাতে একটা কানা কড়িও নেই। এবার তো তাহলে সপরিবারে মরে যেতে হবে। তাই ভাবলাম আত্মসম্মান নিয়ে আর কত দিন এভাবে মুখ বুজে থেকে মরে যাব? আমরা তো অপরাধী না? বেতনটা তো আমাদের অধিকার।
আব্বু জানলে হয়ত আমাকে জানাতে দিত না। তাই আব্বুকে না জানিয়ে আপনাদের আমাদের পরিবারের কথা জানালাম। সেই অপরাধী বাবার আদরের মেয়ে হয়ে আমার আবেদন বেতনের ব্যবস্থা যাতে হয়ে যায়। আর বেতন এর ব্যবস্থা যত দিনে না হয় তত দিন যেন আমরা খেয়ে পরে বাঁচতে পারি তাই সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। লেখাটা অনেক বড় হয়ে গেছে, কিন্তু তাও এই সাড়ে ৩ বছরের কষ্ট আমি ফুটিয়ে তুলতে পারলাম না। আপনারা অনুগ্রহ করে উচ্চ স্তরের লোকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিন।
এমএস/এনএস
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।