ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪

বাসায় থাকি

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২০:২১, ১২ এপ্রিল ২০২০ | আপডেট: ২০:২৩, ১২ এপ্রিল ২০২০

শামীম আজাদ বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত ব্রিটিশ কবি ও সাহিত্যিক। তিনি বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের লন্ডন শাখার চেয়ারপার্সন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। উপন্যাস, কবিতাসহ বিভিন্ন বিষয়ের উপর তার ৩৫টি বই প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও সাহিত্যের বিভিন্ন ধারা নিয়ে অসংখ্য প্রবন্ধ দেশ বিদেশের বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। বিচিত্র পুরষ্কার ছাড়াও তিনি আরও অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। 

শুরু করলাম খাবার রেশন করা। বিলেতে লকডাউনের ৩য় সপ্তাহ। এখন বেশ বুঝে গেছি কি ধরবো, কি ধরবো না। ফুলকপির শেষ পাতাটা খাওয়া, কদুর খোসা ভাজি আর একবেলা ভাত। বাঙালি দোকান থেকে দু’সপ্তাহ আগে কিনে আনা কদু খেয়েছি একসপ্তাহ আগে। তখনি তার খোসা সুন্দর করে কুঁচো করে কেটে পলিথিন প্যাকেটে তুলে রেখেছি। কাল রাতে তা নামিয়ে রেখেছি। এই সকালেই তা সাদা শুকনো ও কোপানো পেঁয়াজের সঙ্গে শুকনো আধা ছেঁচা লাল মরিচগুঁড়ো, এক চিমটি হ্লুদগুঁড়ো ও লবন মাখিয়ে রেখে দেবো। ওর সঙ্গে দেবো এক টেবিল চামুচ ভোজ্য তেল। আমি বহু বছর ওভাবেই মেখে আগে রেখে দি এবং ঢাকনা সেঁটে রান্না করি। কোনো কিছু ভুনি না, বাগার দিই না। 

তার দুটো কারণ। এক, ভুনা ও বাগার খাদ্য সুস্বাদু করার চাইতেও তীব্র গন্ধে বাড়ীর প্রতিটি আসবাব, পোশাক, নিজের চুল ও গা বেয়ে উঠে ঠিক করোনার মতো বসে থাকে। দুই, বিলেতের ঘরের ভেতর মশলাপাতির  সুগন্ধটা শুধু খাবার সময়ই যা ভাল লাগে। পরে সে সুগন্ধ এক দূর্গন্ধে পরিণত হয়। কদুর খোসা ভাজার সময় একটা ডিম দিলে স্বাদ ভাল হয়। কিন্তু দেবো না। কিছু ডিম একসঙ্গে অর্ডার করলে পরে ডেলিভারী বয় এনে দিয়েছিল। তার সবক’টি উৎসব করে খেতে পারতাম আমরা। কিন্তু এখন তার সময় না।

বাইরে যাই না কতদিন! বাসা থেকে জুমে এদেশের ছেলেমেয়েদের জন্য বাংলা বলার ক্লাশ শুরু করেছি। অনলাইন খবার অর্ডার করা শিখেছি। এবার আর ভলেন্টিয়ার বা ঈশিতাকে না বলে দাম হলেও ডেলিভারী অর্ডার করেছিলাম। তাতে এসেছিলো ডিম, ২ প্যাকেট শাক, এক আঁটি বেগুনী ব্রকলী, এক আঁটি কেইল পাতা, একটি ফুলকপি, একটি লেবু, ৪টি কমলা, একটি বেশ মোটাসোটা আলু, একটি মাঝারি মাপের মিষ্টি আলু, একটা শশা! তাজা সব্জী খাইনি দু’সপ্তাহ। ডিম আবার মেয়াদ পেরিয়ে গেলে খামোখাই নষ্ট হয়ে যাবে। তাই এই প্রথমবারের মতো ডিম ফ্রিজারে রেখেছি। ছ’টা বাইরে রেখে বাকি ছ’টা শক্ত সেদ্ধ করে খোসাসহ ঠান্ডা করে স্বচ্ছ ব্যাগে ভরে দিয়েছি। প্রয়োজনে খাবার আগে দুটো করে হাল্কা গরম জলে ভিজিয়ে রাখবো। তারপর সুন্দর করে নিশ্চয়ই খোসা ছাড়ানো যাবে। তার আগে ফ্রিজার থেকে সঞ্চয় করে রাখা পাউরুটিও বের করে নেবো- স্যান্ডুইচ করার জন্য।

এতো তাজা সব্জী দেখে চোখ চক চক করে উঠেছিলো। হায়রে মানব মন! তবু খেতে চায়। আমার প্রিয় কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর ঊটপাখি কবিতায় লিখেছিলেন-

‘কোথায় লুকোবে ধূ ধূ মরুভূমি
ক্ষয়ে ক্ষয়ে ছায়া মরে গেছে পদতলে
আজ দিগন্তে মরীচিকাও নেই
নির্বাক নীল, নির্মম মহাকাশ....’’

এই নির্মম মহাকাশের নিচে তবু খেতে মন চায়। মনে হয়, হে কবি মৃত্যু নয়। ক্ষুধাই কেবল, ক্ষুধাই ধ্রুব সখা। আরো এক অবিশ্বাস্য কথা বার বার মনে হয়। মনে হয়, এ বিপদে আমার কেউ মরবে না। আমরা সবাই বেঁচে থাকবো এক বদলে যাওয়া পৃথিবীতে এক বদলে যাওয়া অভ্যাসে। প্রকৃতিকে আরো মায়া করবো। বাদুর বাঁদর ও বন্য প্রাণিকে আর জ্বালাবো না। এক বিন্দু খাদ্য পেলেও নিজেকে ভাগ্যবান মনে করবো। সবাই যাতে ন্যূনতম আহার পাই তার জন্য একেবারে নিজের দোরগোড়ায় যে আছেন তার খবর নেবো। আর নিজের জন্য যা যোগাড় হবে বদলে যাওয়া অভ্যাসে তা পরিষ্কার করে তুলে অল্প অল্প করে খাবো।  

তাই আজ ঘরে আসা সবগুলো জিনিসকে স্নান দিতে প্রথমে খুবই হাল্কা ক্ষার গোলা জলে নেড়ে নেড়ে পরিস্কার করে নিলাম। তারপর মিঠা পানিতে ধুয়ে, পরিষ্কার কাপড়ে মুছে জল পুরো শুকানোর জন্য সাদা কিচেন টাওলের উপর কিছুক্ষণ বসিয়ে রাখলাম। তারপর সে সব্জীর কোনো কিছু না ফেলে কিছু হাল্কা সেদ্ধ করে ঠান্ডা করে এমনকি কয়েকটি ডিমও ভালো সেদ্ধ করে ঠান্ডা হলে খোসাসহ ফ্রিজারে সঞ্চয় করলাম। ভিনেগার না, লবণ জল না, এই দুষ্টু করোনা মরে একমাত্র সাবানের জলে। তাই নিজের বুদ্ধিতেই তাই করি আমরা। কখনো কি ভেবেছি সব্জীও সাবান জলে গা ধুবে? কিন্তু আমি খাবো খাবো না করলে তাদের ২৪ ঘণ্টা না ছুঁয়ে তারপর হাতে দস্তানা পরে প্রচুর জলে ধুয়ে নিলেই হয়। রান্না করা সব্জী যা কি না প্রচুর উত্তাপে করা হয়, করোনা বাঁচে না।

এই যে করোনার তাণ্ডব চলছে। প্রতি নিয়ত এক দু’জন নয়, শ’য়ে শ’য়ে দুম দুম করে মানুষ মরে যাচ্ছেন। চলে যাচ্ছেন শত শত লোকের প্রিয়জন, তাতে খাবার চিন্তা করলেই লজ্জা লাগে। বার বার একাত্তরের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। তফাত শুধু একটা। একাত্তরের শত্রুকে চোখে দেখা যেতো। করোনা দেখা তো যায়ই না, বরং ২৪ ঘন্টা একসূতো দূরে দাঁড়িয়ে হাসছে অবিরত। আর আমরা হাত ধুতে ধুতে হয়রান হয়েও দেখছি তা করেও আমাদেরই প্রিয়জন চলে যাচ্ছেন- একা। তাকে যাবার বেলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতেও পারছি না।

লন্ডনের করোনা পরিস্থিতি আশংকাজনক হারে বাড়ার অন্যতম কারণ, “তবুও যারা বাইরে ঘুরছে” এবং অন্যদের কথা ভাবছেনা। তারা মূলত তরুণ। তরুণরা নিজেরা ঝুঁকির দলে না হলেও এরাই এর প্রধান বাহক হয়ে উঠেছে। নিজেরা যেহেতু যৌবনের শক্তিতে টিঁকে যাবার ক্ষমতা রাখে, তাই তারা বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অথচ এ যদি বাইরের দেশের সংগে নিজ দেশের যুদ্ধ হতো তাহলে কিন্তু তারাই সবার আগে গিয়ে নাম লেখাতো। দেশের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত হতো। যেমন আমাদের প্রজন্ম করেছিলো একাত্তরে।

করোনা আসলে আমাদের সকলের স্মরণাতীত কালের সকল মহামারী, যুদ্ধ, মড়ক, দূর্ঘটনা সব কিছুর চাইতে মারাত্মক, বড়, আনবিক বোমার চাইতেও বিধ্বংসী, ক্ষমতাশালী ও খতরনাক।

কিন্তু আশার কথা, এর সংগে যুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য যা করতে হয় তা অত্যন্ত সহজ ও সরল। এর নাম “শুধু বাসায় থাকা”। অর্থাৎ মানুষের সংগে দেখা না করা। বাইরের একজন আরেকজনকে না ছোঁয়া, একজনের শ্বাস থেকে আরেকজনের মধ্যে তিনফিট দূরত্ব বজায় রাখা। সিম্পল! সত্যি এতই সোজা একটা মহামারী রোগের থেকে দূরে থাকা।

সোজা না বাংলাদেশে। কি করে এটা সম্ভব হবে? হবে না। কিন্তু যারা তা করে থাকতে পারেন তারা যদি তা মানেন তা হলে অন্তত মৃতের সংখ্যা বা আক্রান্তের সংখ্যা কম হতে পারে। অতি অবশ্যই আমাদের স্বাস্থ্য কর্মীগণ যারা মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে আমাদের বাঁচাবার চেষ্টা করছেন- তাদের উপর চাপ একটু লঘু হতে পারে। দয়া করে ধর্মীয় ও আনন্দ আড্ডা জীবন থেকে বাদ দিয়ে সত্যিকারের ধর্ম পালন করা দরকার। শতাব্দীর সবচাইতে বড় শত্রুকে মোকাবিলা করতে হলে আমাদের উচিত মানবজাতিকে রক্ষা করার জন্য যুদ্ধে নামা। মানে ঘরের বাইরে না গিয়ে বাসায় বসে থাকা।

লন্ডন
১২ এপ্রিল ২০২০


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি