বি. চৌধুরী-ড. কামালের বৈঠকে যে কথা হলো
প্রকাশিত : ১৩:৪৮, ২৯ আগস্ট ২০১৮ | আপডেট: ১৪:৩৪, ২৯ আগস্ট ২০১৮
জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্য প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে গতকাল মঙ্গলবার রাতে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের বাসায় রাজনৈতিক নেতাদের এক বৈঠক হয়। বৈঠকে সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিকল্প ধারার প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীসহ (বি. চৌধুরী) ঐক্য প্রক্রিয়ায় জড়িত নেতারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক সূত্র জানায়, বৈঠকটি ততটা সুখকর ছিল না। তুমুল হট্টগোলের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে। সুলতান মোহাম্মদ মনসুর ও মাহি বি চৌধুরীর মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়েছে। মাহমুদুর রহমান মান্না ব্রিফিংয়ের আগেই বৈঠক ত্যাগ করেন। অনেক নেতাই বলে উঠেন কিচ্ছু হবে না।
কয়েক মাস ধরেই জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার কথা বলে আসছিলেন ড. কামাল হোসেন। গণফোরাম ও বদরুদোজ্জার নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট এ ব্যাপারে এগিয়েছে বলে জানা গেছে। অন্যদিকে, বিএনপিও বৃহত্তর ঐক্য গড়ার কাজ করে আসছে।
তবে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াতে ইসলামী থাকার কারণে অনেক দলই বিএনপির সঙ্গে ঐক্য প্রক্রিয়ায় যেতে চায়নি। তবে এখন ২০ দলকে আলাদা রেখে বিএনপি অন্য দলগুলোর সঙ্গে ঐক্য প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদিও গতরাতের বৈঠকে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত কোনো নেতা ছিলেন না। উপস্থিত ছিলেন বিএনপি ঘরানার বুদ্ধিজীবী ডা. জাফরুল্লাহ।
বিএনপির একটি সূত্র বলছে, বিএনপির অ্যাসাইনমেন্ট হিসেবে ডা. জাফরুল্লাহ অনেক দিন থেকেই বর্তমান সরকারের বাইরে থাকা দলগুলো নিয়ে বৃহত্তর ঐক্য গড়তে কাজ করে যাচ্ছেন। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিষয়টি সরাসরি দেখভাল করছেন।
যারা ছিলেন
গত কয়েক মাসের ধারাবাহিক বৈঠকের অংশ হিসেবে গতরাতের বৈঠকে সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিকল্পধারার সভাপতি অধ্যাপক ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন, জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, বিকল্পধারা মহাসচিব এম এ মান্নান উপস্থিত ছিলেন। রাত ১০টার দিকে বৈঠক শেষে ঐক্যের ঘোষণা দেন নেতারা। জেএসডির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন, বিকল্পধারার যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি. চৌধুরী, বিকল্পধারার সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার ওমর ফারুক উপস্থিত ছিলেন।
অপরদিকে গণফোরামের পক্ষ থেকে মোস্তফা মহসিন মন্টু, আওম শফিক উল্লাহ, জগলুল হায়দার আফ্রিক, মোশতাক আহমেদ উপস্থিত ছিলেন।
এছাড়া উপস্থিত ছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এবং জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সদস্য সচিব আ ব ম মোস্তফা আমিন, সাবেক ছাত্রনেতা সুলতান মো. মনসুর আহমেদ।
মঙ্গলবার রাত পৌনে দশটায় খানিকটা হট্টগোলের মধ্য দিয়েই শেষ হয় ওই বৈঠক। বৈঠকটির ব্যাপ্তি ছিল পৌনে দুই ঘন্টা। রাজধানীর বেইলি রোডে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের বাসার নিচ তলার ড্রইংরুমে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়।
হট্টগোল
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার পর তিন দলীয় যুক্তফ্রন্টের দুই নেতা জানান, ড. কামাল ও বি চৌধুরী যৌথভাবে কাজ করার বিষয়ে একমত হওয়ার পর একটি সাব-কমিটি গঠনের বিষয়ে আলোচনা হয়। সাংবাদিকদের সামনে এসে এই সাব-কমিটির বিষয়ে কথাও বলেন বি. চৌধুরী। কমিটিতে যাদের নাম উচ্চারিত হয়েছে, তারা হলেন- মোস্তফা মহসীন মন্টু, মেজর (অব.) আবদুল মান্নান, আবদুল মালেক রতন ও জাহিদুর রহমান।
শেষ নামটি যুক্ত হওয়ার পর ড. কামাল প্রশ্ন তোলেন, ‘কে এই জাহিদ?’ সেসময় জাহিদকে নাগরিক ঐক্যের নেতা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন মাহমুদুর রহমান মান্না। আর তখনই ড. কামাল বলে ওঠেন, ‘এমন নেতার নাম দিলে তো আরও দশ জনের নাম যোগ করতে হবে। তখন শুরু হয় হট্টগোল। নেতারা উঠে-বসেন।
সিনিয়র নেতারা চলে আসেন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে। একদিকে ড. কামাল হোসেনকে পাশে রেখে বি চৌধুরী বলছিলেন, জাতির এই ক্রান্তি লগ্নে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে তারা দুজন একমত হয়েছেন। অন্যদিকে পাশ থেকে আরেকজন নেতা বললেন, ‘কিছুই হবে না।’
সাংবাদিকদের সঙ্গে কথার বলার এক ফাঁকেই গণমাধ্যমকর্মীদের এড়িয়ে বেরিয়ে যান মাহমুদুর রহমান মান্না। তাই বি. চৌধুরী ও ড. কামাল যখন ব্রিফ করছিলেন তখন তাঁকে দেখা যায়নি। এ সময় ছিলেন জাসদের আ স ম রব। ব্রিফিংয়ের সময় যুক্তফ্রন্টের একনেতা হতাশা ভরা কণ্ঠেই বললেন, ‘কিছুই হচ্ছে না।’
বি চৌধুরী সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলা শেষ করার পরই সুলতান মুনসুর আহমদ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘২২ সেপ্টেম্বর সমাবেশে, সবাই থাকবেন।’ সঙ্গে-সঙ্গেই বিরোধিতা করেন বিকল্প ধারার যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি চৌধুরী। তিনি বললেন, ‘এসব বিষয়ে কোনো আলাপই হয়নি।’
কামালকে বিদেশ যেতে বারন রবের
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, বৈঠকে ঐক্যের বিষয়ে নেতারা বেশ জোর দিয়েছেন। ড. কামালকে জেএসডি-এর আসম আবদুর রব বলেন, আপনি আর দেশের বাইরে যেতে পারবেন না। তার বক্তব্যে বি চৌধুরী ও ড. কামাল হোসেনকে একসঙ্গে চলার জন্য জোরালো আহ্বান ছিল। এক পর্যায়ে ড. কামালকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, আপনি আর দেশের বাইরে যেতে পারবেন না। এখন থেকে নির্বাচন পর্যন্ত দেশের বাইরে যাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
বি চৌধুরী ও ড. কামালের উদ্দেশ্যে আসম রব আরও বলেন, ‘আমরা জাতীয় ঐক্যমতের সরকার গঠন করতে চাই। আপনারা দুজন সামনে আগায়া যান। আমরা সঙ্গে থাকব। আপনারা মিনিমাম কর্মসূচি দিলে সরকার পালাবার জায়গা পাবে না।
বি চৌধুরী ও ড. কামাল হোসেনকে উদ্দেশ্য করে আসম রব বলেন, ‘আপনারা সজ্জন ব্যক্তি। আপনারা দুজন ঠিক করুন, মাঠে নামবেন কিনা, আপনারা একসঙ্গে দাঁড়ালে আমরা যাব। আমরা বলছি, জাতির প্রয়োজনে আপনাদের দুজনকে লাগবে। আপনারা দুজন আগাবেন কিনা, বলেন।
কোয়ালিশন সরকার প্রাধান্য
আলোচনার একপর্যায়ে রব বলেন, ‘কোয়ালিশন সরকার বিএনপি গ্রহণ করবে কিনা?’ এ কথার জবাবে পাল্টা প্রশ্ন করে মেজর (অব.) মান্নান বলেন, ‘এক স্বৈরাচারকে বাদ দিয়ে আরেক স্বৈরাচারকে আনবো কি-না?’
বিকল্প ধারার মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নান আলোচনার শেষ দিকে এসে বিএনপির ১০ দফা প্রস্তাব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। প্রস্তাবনায় থাকা ‘রাষ্ট্র ক্ষমতার গ্রহণযোগ্য ভারসাম্য’ প্রসঙ্গে মান্নান বলেন, বিএনপি ভারসাম্যের পক্ষে না, এটা আবেগ দিয়ে করেছে। আজকে আমরা যে সংগ্রাম করছি, বিএনপির সময় একশগুণ বেশি সংগ্রাম করতে হয়েছে। আমরা এক স্বৈরাচারকে বাদ দিয়ে আরেক স্বৈরাচারকে আনবো কি-না?’
আবদুল মান্নানের বক্তব্যের জবাবে আসম রব বলেন, কোয়ালিশন সরকার বিএনপি গ্রহণ করবে কিনা?’
এসময় ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, নেতৃত্ব এক হবে না, যৌথ নেতৃত্ব হবে। বিএনপির অনেক দাবির সঙ্গে অন্যদের দাবির মধ্যে মিল আছে।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী আরও বলেন, সরকার গঠন করতে পারলে মন্ত্রণালয় ৫/৫ ভাগ হবে প্রয়োজনে। রাষ্ট্রপতি পদটা নিয়ে চিন্তা করতে হবে। মোটকথা আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে, কৃষক শ্রমিকের পক্ষে। তাদের স্বার্থটা কিন্তু দেখতে হবে।
বৈঠকে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, আমরা ক্ষমতার ভারসাম্য চাই। সংসদে কেউ মেজরিটি অর্জন করলেই ভারসাম্য হয়ে যায় না। এসময় তিনি মালয়েশিয়াসহ দুয়েকটি রাষ্ট্রের কথা উদাহরণ হিসেবে বর্ণনা দেন। শেষদিকে তিনি বলেন, আমরা ভারসাম্য নিষ্পত্তি করার বিষয়ে চিন্তা করব নাকি ঐক্য দরকার?
এক পর্যায়ে জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, আমরা এদেশে আইনের শাসন দেখতে চাই। বড় দল কেউ আসতে চাইলে ওয়েলকাম। আগে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা জরুরি।
পৌনে দুই ঘণ্টার বৈঠকে কয়েক দফায় বিএনপির ১০ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করেন অনেকে। বৈঠক শুরুর আগে যে দুয়েকজন নেতা ১০ দফা প্রস্তাবের বিষয় অস্বীকার করেছেন, তারাই বৈঠকে ১০ প্রস্তাবের ভালোমন্দ নিয়ে কথা বলেছেন।
যদিও বৈঠকের পরে এ প্রসঙ্গে বি চৌধুরী বলেন, বিএনপির প্রস্তাব সম্পর্কে কোনও আলোচনাই হয়নি। বৈঠকে যুক্তফ্রন্টের পক্ষ থেকে সাত দফা ও গণফোরামের পক্ষ থেকে সাত দফা উপস্থাপিত হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
/ এআর /
আরও পড়ুন