ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ নভেম্বর ২০২৪

যৌথ নেতৃত্বে বৃহত্তর ঐক্যজোট

বিএনপিকে আসতে হলে মানতে হবে কঠিন তিন শর্ত

প্রকাশিত : ১৪:৩২, ২০ আগস্ট ২০১৮ | আপডেট: ১৬:৪২, ২১ আগস্ট ২০১৮

আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগামী ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হবে। সংসদ নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করতে মাঠ গোছাতে ব্যস্ত সময় পার করছে নির্বাচন কমিশন। ইতোমধ্যে নির্বাচনের ৮০ ভাগ কাজ শেষ করেছে বলে কমিশন সূত্রে জানানো হয়েছে।

এদিকে নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের বাইরে একটি বৃহৎ রাজনৈতিক জোট গড়ার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। খ্যাতনামা আইনজীবী ড.কামাল হোসেন ও বিকল্পধারার সভাপতি সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক এ কি এম বদরুদ্দোজা এ জোট গঠনে কলকাঠি নাড়ছেন। নেপথ্যে থেকে তাদের সহায়তা করছেন মাহমুদুর রহমান মান্না, আ স ম রব, ডা. জাফরউল্লাহর মতো ব্যাক্তিরা। বহু আগ থেকেই এই পথপরিক্রমা শুরু হলেও গত এক সপ্তাহ ধরে সম্ভাব্য এই জোটের কারিগরদের মধ্যে কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে। বৃহৎ এই জোট আলোর মুখ দেখলে বিএনপির সঙ্গে মিলে যুগপত আন্দোলনে নামার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন রাজনৈতিক পর‌্যবেক্ষকরা।

স্বভাবতই এই জোটে অবস্থান নেবে শুধু সরকারবিরোধীরা। তবে এ ঐক্যেজোটে বিএনপিকে যোগ দিতে হবে তিন শর্ত মেনে। এমনটাই জানিয়েছেন বিশিষ্ট আইনজীবী ও গণফোরাম সভাপতি ড.কামাল হোসেন।

জোটের বিষয়ে তিনি বলেন, দেশে সুষ্ঠু রাজনীতির বিকাশ করা এই জোটের মূল লক্ষ হবে। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সুন্দর রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিকাশ হবে এই প্রত্যাশা থাকবে জোটের সকলের। এ জোটে বিএনপিও আসতে পারে। তবে তাদের আসতে হবে তিন শর্ত মেনে।

শর্তগুলো ইতোমধ্যেই বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির জৈষ্ঠ্য দুই সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ব্যারিস্টার মওদূদ আহমদকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে গণফোরামের পক্ষ থেকে। শর্তগুলো বিষয়ে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল বলেন- প্রথমত, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য কোনোভাবেই আমরা (গণফোরাম) জোট করব না। বিএনপি জামায়াতকে নিয়ে এজোটে আসতে পারবে না।

দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে, জোটগতভাবে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি করা যাবে না। বিএনপি নিজেদের মতো করে তাদের দলের প্রধানের মুক্তির দাবিতে সোচ্চার থাকতে পারে, প্রয়োজনে আইনি লড়াইও অব্যাহত রাখতে পারে। এক্ষেত্রে ড. কামাল হোসেনকে জড়ানো যাবে না।

তৃতীয় শর্ত হচ্ছে জোটগতভাবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া যাবে না। বিএনপি চাইলে দলগতভাবে তারেক রহমানের প্রসঙ্গটি সামনে আনতে পারে। কিন্তু এর সঙ্গে জোটের কোনো সম্পর্ক থাকবে না। এই শর্ত মেনে বিএনপি যদি আমাদের জোটে আসতে পারে তাহলে আমরা তাকে গ্রহণ করব।

সংশ্লিষ্টসূত্রে জানা গেছে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এবং ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠকের পর সরকারবিরোধী জোট গঠনে সায় দিয়েছেন ড. কামাল হোসেন। গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, ভোটাধিকার রক্ষায় সব দলের অংশগ্রহণে আগামীতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনসহ বিভিন্ন দাবিতে বিএনপির সঙ্গে জোট গঠনে আপত্তি নেই তার। তবে বিএনপিকে শর্তগুলো মেনে চলতে হবে।

 সূত্র জানায়, গণফোরামের পক্ষ থেকে বিএনপির তিন শীর্ষ নেতাকে সাত দফা লিখিতভাবে দেয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন হিসেবে সংবিধানকে সমুন্নত রেখেই রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে। ক্ষমতায় এসে স্থানীয় সরকারসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে, স্বাধীনতাবিরোধী ও ঋণখেলাপিদের নির্বাচনে বাইরে রাখা, নির্বাচন কমিশনকে আরও স্বাধীন এবং শক্তিশালী করা, না ভোটের বিধান যুক্ত করাসহ নির্বাচনী ব্যবস্থায় আমূল সংস্কার করতে হবে। জনগণের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করা, সংবিধান অনুযায়ী ন্যায়পাল নিয়োগ করতে হবে।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনা এবং একই ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে না পারার বিধান যুক্ত করতে হবে। নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখা, স্বাধীন ও শক্তিশালী করা, বিনা বিচারে হত্যা বন্ধ করতে হবে। মন্ত্রী-এমপি-আমলাসহ সবার সম্পদের হিসাব প্রকাশ করতে হবে। প্রশাসন, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দলীয় প্রভাবের বাইরে রাখা, মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে তাদের যথাযথ মূল্যায়ন করা।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, আমরা আমাদের পক্ষ থেকে সাত দফা প্রস্তাবনা দিয়েছি। এর বিপরীতে বিএনপির পক্ষ থেকেও তাদের মতামত পাঠানো হয়েছে। এনিয়ে শিগগির আলোচনায় বসব আমরা। আলোচনার টেবিলে বাকি বিষয়গুলো চূড়ান্ত হবে।

তিনি বলেন, আমরা গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, মানুষের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনা, এ জন্য সব দলের অংশগ্রহণে আগামীতে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য এবং বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আদায়সহ বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী শিবিরে থাকা দলগুলোর সঙ্গে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলতে রাজি। তবে এ ঐক্য কাউকে ক্ষমতা থেকে নামানো, আবার নতুন করে কাউকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য নয়- এ ঐক্য হতে হবে একটি অর্থবহ পরিবর্তনের আশায়।

তিনি বলেন, বর্তমান সরকার যেসব ভুল করছে আমরা চাই সেসব ভুল ভবিষ্যতে আর না হোক। বিএনপি ক্ষমতায় গিয়ে বর্তমান সরকারের মতোই যদি আচরণ করে, তাহলে লাভ হবে না। জনগণও হতাশ হবে। ভবিষ্যতে আর লুটপাট হবে না, ব্যাংক ডাকাতি হবে না, অর্থ পাচার ঠেকানো হবে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা হবে, শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হবে, ভিন্ন মতের ওপর দমন-পীড়ন হবে না, গণতন্ত্রকে গলাটিপে হত্যা করা হবে না- বিএনপিকেও এ নিশ্চয়তা দিতে হবে। এসব বিষয়ে নিশ্চয়তা পাওয়া গেলেই বৃহত্তর জোট হবে।

এদিকে গতরাতে (রোববার) সাবেক রাষ্ট্রপতি বি চৌধুরী ও গনফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের মধ্যে রূদ্ধদ্বার বৈঠক হয়েছে। সেখানে বৃহৎ জোট গঠনের বিষয়ে একমত হয়েছেন তারা।

বদরুদ্দোজা চৌধুরী এবং কামাল হোসেনের ওই বৈঠকে তিনটি সিদ্ধান্ত হয় বলে জানা গেছে। এছাড়া নির্বাচন সামনে রেখে জাতীয় ঐক্যের বিষয়ে তাঁরা একমত হয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন জেএসডি সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন।

তিনি জানান, আজকের বৈঠকে তিনটি সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রথমত, সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট ও কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরাম যৌথভাবে জাতীয় ঐক্য নিয়ে কাজ করবেন।

দ্বিতীয়ত, আজ সোমবার এই দুই নেতা কর্মসূচি নির্ধারণ করবেন।

তৃতীয়ত, ঈদের পরে সুবিধাজনক সময়ে যৌথভাবে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জাতীয় ঐক্য ঘোষণা দেবেন। সেই সঙ্গে মহাসমাবেশ ও অন্যান্য কর্মসূচির ঘোষণা আসতে পারে।

বৈঠকে অন্যান্যের মধ্যে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, বিকল্পধারার মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নান, গণফোরামের কার্যকরী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, জেএসডির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন, বিকল্পধারার যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি. চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার ওমর ফারুক, জেএসডির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শহীদউদ্দিন মাহমুদ ও নাগরিক ঐক্যের শহীদুল্লাহ কায়সার উপস্থিত ছিলেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ড. কামালের কঠিন শর্তগুলো মেনে বিএনপি এই জোটে যোগ দেবে কিনা সেটি নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। কারণ এসব শর্ত মানলে বিএনপির রাজনীতি থাকে না। তাদের বর্তমান নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। সেই সঙ্গে তাদের দীর্ঘদিনের মিত্র জামায়াতের সঙ্গে গাটছাড়া ভেঙে যাবে। সবমিলিয়ে ড. কামালের শর্তে বেকায়দায় পড়েছে বিএনপি।

টিআার/ এআর

 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি