ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২১ নভেম্বর ২০২৪

বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল: এক অনন্য বাঙ্গালীর প্রতিকৃতি

বাবুল চন্দ্র সূত্রধর

প্রকাশিত : ২৩:২৯, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৩

রাধাবিনোদ পাল- শুধু একজন ব্যক্তি নন, প্রতিষ্ঠান নন, এর চেয়েও বেশী কিছু। অন্তত বাংলাদেশের মানুষের জন্য। যদিও কোন এক অজ্ঞাত কারণে তাঁর সে ধরনের কোন পরিচিতি নেই আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশে। যে এলাকায় তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সে এলাকার আমার বেশ কিছু পরিচিতজনের কাছে জিজ্ঞেস করেও তেমন কোন তথ্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। জাতীয় বা স্থানীয়, উন্নয়ন বা অনুন্নয়ন- কোন আলোচনায় তাঁর নাম শোনা যায়, আমার এমনটি স্মরণে আসে না। অবশ্য এক জায়গায় তিনি অভূতপূর্ব মূল্যায়ন লাভ করেছিলেন।

তিনি কোন প্রাগৈতিহাসিক কালের লোক নন, তাঁর জন্ম ২৭ জানুয়ারী, ১৮৮৬ সনে; মৃত্যু ১০ জানুয়ারী, ১৯৬৭ সনে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার মাত্র চার বছর আগে। জন্মস্থান কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর উপজেলার মথুরাপুর ইউনিয়নের অন্তর্গত তারাগুনিয়া গ্রামে, এটি তাঁর মাতুলালয়। তাঁর পৈতৃক নিবাক্স পার্শ্ববর্তী মিরপুর উপজেলার সদরপুর ইউনিয়নের কাকিলাদহ গ্রামে।

"যতদিন জাপান থাকবে, বাঙ্গালী খাদ্যাভাবে অর্থকষ্টে মরবে না। জাপান হবে বাঙ্গালীর চিরকালের নি:স্বার্থ বন্ধু"- জাপানের প্রয়াত সম্রাট হিরোহিতো যার সম্মানে একথাটি ব্যক্ত করেন, তিনিই সেই রাধাবিনোদ পাল। সম্রাটের কথা শুধু বিবৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগীদের সম্মুখসারিতে অবস্থান করে সর্বদাই জাপান তার প্রতিশ্রুতি ও ভূমিকাকে সমুজ্জ্বল রেখেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি দানকারী প্রথম দেশগুলোর মধ্যেও জাপান অন্যতম।

রাধাবিনোদ পালের খ্যাতিসম্পন্ন অনেক পরিচয়ের মধ্যে প্রধান হচ্ছে দূরপ্রাচ্য বিষয়ক আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইব্যুনালের বিচারক (১৯৪৬-১৯৪৮), কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি (১৯৪১-১৯৪৩), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (১৯৪৪-১৯৪৬), আন্তর্জাতিক ল কমিশনের চেয়ারম্যান (১৯৫৮-১৯৬২), আন্তর্জাতিক আদালতের বিচারক (১৯৫৭) প্রভৃতি।

রাধাবিনোদের বাল্য ও শৈশব ছিল অত্যন্ত কষ্টের। রাধাবিনোদ যখন কেবলই শিশু, তখনই তাঁর বাবা বিপিন বিহারী পাল সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। আত্মীয়-স্বজনের সহযোগিতায় তাঁর পড়াশোনা ও আনুষঙ্গিক ব্যয় পরিচালিত হয়। আর এজন্য পরম সহায়ক হয়েছিল তাঁর তীক্ষ্ণ মেধা। তিনি ১৯০৩ সনে এস্ট্রান্স ও ১৯০৫ সনে রাজশাহী কলেজ থেকে এফএ সম্পন্ন করে কলকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে গণিতে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন যথাক্রমে ১৯০৭ ও ১৯০৮ সনে।

ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজে শিক্ষকতা দিয়ে রাধাবিনোদের কর্মজীবন শুরু হয়। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি আইন বিষয়ে পড়াশোনাও চালিয়ে যেতে থাকেন। ১৯১১ সনে তাঁর বিএল কোর্স সম্পন্ন হয়। ১৯২০ সনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এলএলএম পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং কলকাতা হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে যোগদান করেন। ১৯২৪ সনে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনশাস্ত্রে পি-এইচ. ডি. ডিগ্রী লাভ করেন। কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি থাকাকালেই তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নির্বাচিত হন। এই দায়িত্ব সুসম্পন্ন করে তিনি তাঁর গ্রামের বাড়ী তারাগুনিয়ায় চলে আসেন অবসর জীবন যাপনের উদ্দেশ্যে। ঠিক ঐ সময়েই আসে দূরপ্রাচ্য বিষয়ক আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইব্যুনাল (টোকিও ট্রায়াল)-এর বিচারক হিসেবে কাজ করার আমন্ত্রণপত্র। 

বনের বাঘকে খাঁচায় বন্দী করলেই সে ছাগল হয়ে যায় না, বাঘই থেকে যায়- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জয়ী মিত্রশিবির পশ্চিমা নেতৃবর্গ কথাটি হয়ত ভুলে গিয়েছিলেন। তারা একতরফা নুরেমবার্গ ট্রায়ালের সাফল্যে গদগদ হয়ে টোকিও ট্রায়ালের আয়োজন করে। এই ট্রায়ালের একমাত্র ভারতীয় বিচারক ছিলেন রাধাবিনোদ। বাকী ১০ জনের মধ্যে ছিলেন যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, কানাডা, সোভিয়েট ইউনিয়ন, নেদারল্যাণ্ডস, অস্ট্রেলিয়া, চীন, নিউজিল্যান্ড ও ফিলিপিন্সের একজন করে বিচারক। বিচারক নিয়োগকারী মিত্রশিবিরের কর্তারা ভেবেছিলেন, পরাধীন ও বৃটিশশাসিত ভারতের বিচারক অন্যান্য বিচারকদের কথামতই রায়ে সহযোগিতা করবেন। কিন্তু বাস্তবে ফল হয়েছিল বিপরীত। রাধাবিনোদ পাল টোকিও পৌঁছেই বুঝে ফেলেন যে তাঁকে একপ্রকার লোক দেখানো সমতা বিধানের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য বিচারকরা জাপানকে এককভাবে দায়ী করে রায় ঘোষণা করলে রাধাবিনোদ পাল এর বিরোধিতা করেন। বিচারকরা স্পষ্টত দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন; একপক্ষে দশ জন, অপরপক্ষে একজন- রাধাবিনোদ পাল। তিনি প্রথমেই একতরফা ট্রাইব্যুনাল গঠনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। উল্লেখ্য, ট্রাইব্যুনালটি গঠনের একক দায়িত্ব পান যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কর্মাধ্যক্ষ ডগলাস ম্যাক আর্থার, যিনি এ সময় রাধাবিনোদকে প্রভাবিত করার নানা ছল-চাতুরীর আশ্রয় গ্রহণ করেন। কিন্তু আদর্শের হিমালয় রাধাবিনোদ পালকে টলানো সম্ভব হয়নি।

বিচারপতি রাধাবিনোদ তাঁর ৮০০ পৃষ্টার রায়ে যুক্তি-প্রমাণ দেখান যে, যুদ্ধাপরাধের দায়ে জাপান যেমন দায়ী তেমনি মিত্রপক্ষও সমভাবে দায়ী। তিনি ট্রাইব্যুনালের রায়কে 'প্রহসন' হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, "জাপানকে এককভাবে যুদ্ধাপরাধের জন্য দায়ী করা হলে এটি হবে চরমতম ভুল। কারণ বাকী দেশগুলোও যুদ্ধাপরাধ করেছে। এর অন্যতম উদাহরণ হিরোশিমা নাগাসাকিতে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক বোমা হামলা। হিরোশিমায় প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার এবং নাগাসাকিতে প্রায় ৭৪ হাজার নিরীহ মানুষ মারা যান। যুদ্ধাপরাধের জন্য যদি জাপানের বিচার করতে হয়, তাহলে বাকীদেরও করতে হবে।” উল্লেখ করা আবশ্যক যে, রাধাবিনোদের রায়টি ছিল সে সময় পর্যন্ত আন্তর্জাতিক আদালতে দেওয়া সর্ববৃহৎ রায়, যার সর্বমোট পৃষ্টা ছিল ১২৩৫, ৮০০ পুষ্টা মূল রায় ও বাকীটুকু পর্যবেক্ষণ। ১৯৫৩ সনে এই রায়টি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়, জাপান এটিকে 'দি বাইবেল অফ পিস' বলে অভিহিত করে। পরবর্তীতে রাধাবিনোদ পালের এই রায় একটি ঐতিহাসিক রায়ের মর্যাদা লাভ করে। ফ্রান্স ও নেদারল্যাণ্ডসের বিচারকরা এই রায়ের খানিক পক্ষে অবস্থান নিতে চেয়েছিলেন, পারেন নি; পারবেনই বা কিভাবে- তাদের সিদ্ধান্ত তো আগে থেকেই ঠিক করে রাখা হয়েছিল! চূড়ান্ত রায়ে জাপানী শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের ৭ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৬ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ২ জনকে ২০ ও ৭ বছর করে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়।

তবে রাধাবিনোদ পালের জন্য জাপান বিরাট অঙ্কের আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রদান থেকে রেহাই পেয়ে যায়। শুধু তাই নয় রাধাবিনোদ জাপানের সার্বিক উন্নয়নের জন্য পরবর্তীতেও তাঁর চিন্তার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। ১৯৫২ সনে ৬ আগস্ট হিরোশিমা দিবস পালনে জাপান এই মহাপ্রাণকে প্রধান অতিথির আসনে বসায়। বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, "যদি জাপানীরা আবার যুদ্ধে জড়ায় তবে হিরোশিমার সেই নৃশংসতায় নিহত মানুষের প্রতি চূড়ান্ত অবমাননা করা হবে।" তাঁর দিকনির্দেশনামূলক পরামর্শে জাপান সভ্য ও আধুনিক সমাজ গঠনে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়. যার ধারাবাহিকতা আজোবধি প্রবহমান। আজ জাপান বিশ্বের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সর্বোৎকৃষ্ট মডেলের শিরোপায় ভূষিত ও সম্মানিত।

শান্তি প্রতিষ্ঠা কিংবা অশান্তির লালন- সর্বদাই দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক ব্যাপার। রাধাবিনোদ পালের সুদূরপ্রসারী পরামর্শে জাপান তার সকল শক্তিমত্তা, জ্ঞান-বুদ্ধি, প্রকৌশল-প্রযুক্তি নিয়োগ করেছিল দেশের সার্বিক উন্নয়নের পক্ষে। যুদ্ধংদেহী ও আক্রমণাত্মক মনো- সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে তারা প্রাণপণে ব্যাপৃত হয় স্বদেশের প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি ধূলিকণাকে সম্মান জানাতে- কোথাও যেন কোনরূপ দু:খ:কষ্ট না থাকে, অপ্রাপ্তি না থাকে, সে ব্রতে সনিষ্ঠ হয়ে তারা ভুলে গেল অন্যকে আঘাত করার কথা। জাপানীদের এহেন ব্রতনিষ্ঠার কথা ক্রমেই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধে জড়িত বিভিন্ন রাষ্ট্রও মনোনিবেশ করে স্ব স্ব জাতি গঠনের কাজে। শান্তির পক্ষে, উন্নয়নের পক্ষে এবং সর্বোপরি মানবিকতার পক্ষে জোট-মহাজোটের আত্মপ্রকাশের দুর্মূল্য পন্থাটিও এভাবেই উন্মুক্ত হয়।

১৯৬৭ সনে টোকিওতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পৈশাচিকতায় নিহতদের স্মরণে নির্মিত হয় ইয়াসুকুনি স্মৃতিসৌধ, যেখানে একটিমাত্র নামীয় স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে, যিনি যুদ্ধে জড়িত ছিলেন না, মারাও যাননি। তিনি রাধাবিনোদ পাল। জাপানে তাঁর নামে রয়েছে রাজপথ, যাদুঘর, রয়েছে ভাস্কর্যও। জাপান সরকার তাঁকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় উপাধি 'কোক্কা কুনশোও' বা 'ফার্স্ট অর্ডার অফ সেক্রেড ট্রেজার' পদক প্রদানের মাধ্যমে সম্মানিত করেছে। কৃতজ্ঞতার নিদর্শনস্বরূপ ২০০৭ সনে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ভারত সফরে এসে ঠিকই কলকাতায় রাধাবিনোদ পালের ছেলে প্রশান্ত পাল ও তাঁর পরিবারবর্গের সাথে দেখা করে যান। তাঁর ঐতিহাসিক রায়, দৃঢ়তা ও নৈতিকতার ওপর অনেক প্রামাণ্যচিত্রও তৈরী হয়েছে।

প্রসঙ্গত, বাঙ্গালী জাতির জন্য একটি বিষয় সদা-স্মর্তব্য বলে মনে করি। জাপান আমাদের শ্রেষ্ট উন্নয়ন সহযোগী বলে যেমনি উচ্চস্বরে মাতামাতি করতে পারি, রাধাবিনোদ পালকে নিয়ে মাতামাতি করারও তেমনি মনো-সংস্কৃতিক পরিবেশ যেন তৈরী করতে পারি। এই মহান ব্যক্তিত্বের কর্মযজ্ঞের সাথে সাযুজ্য বজায় রেখে জাতীয়ভাবে একটি স্থাপনা নির্মাণ করা হোক, এই আবেদন রাখছি। বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের পথে ঈর্ষণীয়ভাবে সগৌরবে এগিয়ে চলছে, এরই ধারাবাহিকতায় বিচারপতি ড. রাধাবিনোদ পালের অমর কীর্তিকে সর্বমহলে স্মরণীয় করে রাখা যেতে পারে বলে মনে করি।

লেখক: বাবুল চন্দ্র সূত্রধর, মানবাধিকারকর্মী ও গবেষক 


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি