ঢাকা, রবিবার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪

ছয় মাসে ঝড়ল ১৮৮৩ প্রাণ

বিচারহীনতায় বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা

প্রকাশিত : ১৪:৫৮, ১ আগস্ট ২০১৮ | আপডেট: ১১:৪৮, ৪ আগস্ট ২০১৮

গত ৩ এপ্রিল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে দুটি বাসের রেষারেষিতে হাত হারান সরকারি তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীব। দুই সপ্তাহ মৃত্যুর সঙ্গে পাল্লা লড়ে ১৬ এপ্রিল হার মানেন তিনি। এর মধ্য দিয়ে সারা দেশে নতুন করে আবারো আলোচনায় আসে সড়ক দূর্ঘটনা।

রাজীবের রক্তের দাগ পিচঢালা সড়ক থেকে মুছতে না মুছতেই ২১ এপ্রিল বনানীতে বাসের ধাক্কায় পা হারান গৃহকর্মী রোজিনা। পরে তাকেও হার মানতে হয় মৃত্যুর কাছে। এভাবে শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশেই একের পর এক সড়ক দূর্ঘটনা যখন চারপাশের জগতটা করে তোলছে মৃত্যপুরী ঠিক তখন এলো আরও একটি আঘাত।

২৯ জুলাই রাজধানীর কুর্মিটোলায় সড়কের পাশে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলো রমিজ উদ্দিন কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থী। এসময় জাবালে নূর পরিবহণ নামের দুটি বাস পাল্লা দিতে দিতে  সোজা শিক্ষার্থীদের শরীরের উপর দিয়ে ‍উঠিয়ে দেয়। এতে তাৎক্ষণিকভাবে দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয় ঘটনাস্থলেই। আহত হয় আরো কয়েকজন, যারা বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

এভাবে একের পর এক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলেও এটি বন্ধে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছে `নিরাপদ সড়ক চাই` নামে একটি সংগঠন। চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের নেতৃত্বে চলা সংগঠনটির সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম আজাদ জানান, গত ছয় মাসে সড়কে প্রাণ গেছে অন্তত ১৮৮৩ জনের।

বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা, টেলিভিশন চ্যানেল ও অনলাইন পোর্টালের তথ্যানুযায়ী করা প্রতিষ্ঠানটির প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চলতি জানুয়ারী মাস থেকে জুন পর্যন্ত দেশে সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার পাঁচশ ৪৯ টি। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ৩ হাজার আটশ ৩১ জন। নিহতের সংখ্যা ১ হাজার আটশ ৮৩ জন।

এসএম আজাদ হোসেন আরো জানান, এ সব সড়ক দূর্ঘটনার মধ্যে জানুয়ারিতে ৩২৪ টি, ফেব্রুয়ারিতে ২৪৮ টি, মার্চে ২১১ টি, এপ্রিলে ২৫৬ টি, মে মাসে ২৩৭ টি ও জুনে ২৭৩ টি ঘটনা ঘটে। এসকল দূর্ঘটনায় জানুয়ারীতে ৩৫৮ জন, ফেব্রুয়ারীতে ৩২২ জন, মার্চে ২৫৬ জন, এপ্রিলে ৩০১ জন, মে মাসে ২৬৫ জন ও জুনে ৩৮১ জন নিহত হয়।

নিরাপদ সড়ক চাই-এর তথ্যানুযায়ী, এসব সড়ক দুর্ঘটনায় বেশির ভাগই বাস, ট্রাক, দুটি বাস, দুটি ট্রাক- এর মধ্যে সংগঠিত হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনাগুলোতে ক্ষতিগ্রস্ত বাসের সংখ্যা ৪৭৫ টি। ট্রাকের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। শুধুমাত্র ছ`মাসে ক্ষতিগ্রস্ত ট্রাকের সংখ্যা ৪৩২ টি। এরপরেই রয়েছে মোটর সাইকেলের সংখ্যা।

জানুয়ারি থেকে জুন সময়কালে দেশে ২৯০ জন মোটর সাইকেল আরোহী সড়ক দূর্ঘটনার শিকার হন। এছাড়া একই সময়ে ৬৪ টি কাভার্টভ্যান, ১০টি নসিমন, ১৫ টি মাহেন্দ্র, ১৬ টি কার ও ৬ টি মাইক্রোবাস সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়।

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি দাঁড়ায় জুন মাসে। যদিও সবচেয়ে বেশি দূর্ঘটনা জানুয়ারী মাসে হয়েছিল ( ৩২৪ টি) তবে জুন মাসে নিহতের সংখ্যা সর্বাধিক। এসময় ৩৮১ জনের প্রাণ গেছে সড়কে।

এসব সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও আইনের প্রয়োগ না হওয়াকে দায়ী করেছেন। সড়ক দূর্ঘটনার সঙ্গে দায়ী ব্যক্তির শাস্তির বিধান থাকলেও কার্যত এখনো কোনো বিচার কার্যকর করা সম্ভব হয়নি বলে জানান যাত্রী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোজাম্মেল হক চৌধুরী। একুশে টেলিভিশন অনলাইনের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, এ যাবৎকালে যত সড়ক দূর্ঘটনা ঘটেছে তার ৮০% নানাভাবে প্রশাসন- মালিক- চালক বা দোষী ব্যক্তিদের মধ্যস্থতায় নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। ২০% ঘটনায় মামলা হয়। তবে যেসব ঘটনায় মামলা হয় তার মধ্যে ৯৯% কোনো না কোনো তদবিরে ছাড় পেয়ে যায়। বাকি ১% - এর শাস্তি শেষ পর্যন্ত নানা অদৃশ্য কারণে বা আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় বাস্তবায়ন হয় না।

সড়ক দুর্ঘটনার জন্য মূলত কাকে দায়ী করবেন এমন প্রশ্নের জবাবে মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, এখানে আইনের শাসন নেই। সড়কে কোনো শৃংখলা নেই। তিনি আরও বলেন, দেশে এমন কোনো গ্রাম নেই যেখানে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত কোনো রোগী নেই।

মানুষ এক সময় এটাকে নিয়তি মনে করত। তিনি বলেন, বিভিন্ন মহাসড়কে ডিভাইডার নির্মিত হওয়ার পর বড় সড়ক দুর্ঘটনার পরিমাণ কমে আসে। তখন প্রমাণিত হয়, এটার জন্য নিয়তি নয় মানুষ দায়ী। অনেকটা একই কথার পুণরাবৃত্তি করলেন সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক এনায়েত উল্লাহ খান। একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে তিনি বলেন, শহীদ রমিজ উদ্দিন কলেজের ছাত্রদের গায়ে বাস তুলে দেওয়ার জন্য পুরোপুরি চালক দায়ী। দীর্ঘদিন ধরে বিচারহীণতার সংস্কৃতি গড়ে উঠায়, কোনো জবাবদিহিতা না থাকায় পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। এনায়েত উল্লাহ খান এ সময় দোষী চালকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।

সড়ক পরিবহন ব্যাবস্থায় নিরাপত্তা রক্ষা ও শৃংখলার দায়িত্ব সরকারের ট্রাফিক বিভাগের। তবে সেই বিভাগের কাছে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কোন তথ্যই নেই। এ নিয়ে তাদের নেই কোনো গবেষণাও। সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধ না হওয়ার বিষয়ে কোনো ধরনের দায়ভার নিতেও আপত্তি ট্রাফিক বিভাগের। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিসি ( মিডিয়া) মাসুদুর রহমান একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে বলেন, গাড়ি আমরা চালাই না। চালায় চালক। চালক ও পথচারী যেন আইন মেনে চলে তার জন্য আমরা উদ্যোগ নিয়ে থাকি মাত্র। তিনি বলেন, একেক দূর্ঘটনার জন্য একেক জন দায়ী। কোথাও চালক দায়ী, কোথাও হেলপার দায়ী। কোথাও গাড়ির ফিটনেস না থাকা দায়ী।  প্রত্যেকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে সড়ক দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব বলে মনে করেন পুলিশের এই কর্মকর্তা।

সড়ক দুর্ঘটনাকে নিছক দুর্ঘটনা বলতে নারাজ গনসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি। একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে তিনি বলেন, সড়ক দূর্ঘটনা নিছক দুর্ঘটনা নয়। এটি কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড। শ্রমিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে মালিকপক্ষের আতাত, সর্বস্তরে জবাবদিহিহীন বেপরোয়া মনোভাব। সামগ্রিকভাবে একটা অস্থির সমাজব্যবস্থার জন্ম দিয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে এমন হত্যাকাণ্ড বারবার ঘটছে।

জোনায়েদ সাকি এসময় নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানের মন্তব্যকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘মন্ত্রীদের এমন বক্তব্য নাগরিকদের জীবন ও মর্যাদাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো। জবাবদিহিতামূলক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন না হলে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ সম্ভব নয়।’

/ আআ / এআর


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি